কামাখ্যা মহাপীঠের ইতিবৃত্ত

কোচবিহার রাজ্যের অধিপতিগণ শিববংশীয় বলে প্রসিদ্ধ। কথিত আছে যে কোচ রমণীর গর্ভে মহাদেবের ঔরসে বিশু ও শিশু নামে দুটি বালক জন্মগ্রহণ করে। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে বাহুবলে জন্মস্থানের আধিপত্য লাভ করেন। অতপর বিশ্বসিংহ ও শিবসিংহ নাম ধারণ পূর্বক ক্রমশ রাজ্যের বিস্তার করতে গিয়ে সমগ্র কামরূপ প্রদেশের অধিশ্বর হয়ে ওঠেন। বিশ্বসিংহ সিংহাসনে আরোহণ করে শিবসিংহকে রাজ্যের প্রধান আমাত্ম হিসেবে নিযুক্ত করেন। বিশ্বসিংহের রাজত্বকাল ছিল ১৫০৯ থেকে ১৫৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। মহাদেবের ঔরসজাত কোচবিহার রাজবংশের আদিপুরুষ এই বিশ্বসিংহ। মহারাজই কামাখ্যা মহাপীঠ পুনরুদ্ধার করেন। এই বিষয় রায় গুণাভিরাম বড়ুয়া বাহাদুরকৃত ‘আসাম বুরঞ্জি’ নামক গ্রন্থে। লিপিবদ্ধ আছে।

বিশ্বসিংহ রাজা হয়ে প্রবল প্রতাপে রাজ্য শাসন করতে লাগলেন। কামতাপুর রাজ্য এবং অন্যান্য মেছ ও কোচজাতীয় । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজাদিগকে পরাস্ত করে তিনি ও তাঁর ভ্রাতা উভয়েই উজাইয়া গুয়াবাটীর। দিকে অগ্রসর হন। একদিন দুইভাই নীলাচল পর্বতে এসে উপস্থিত হন। পর্বতের কোনো এক স্থানে একটি মাটির ঢিবি ছিল। সেখানে মিলিত হওয়া লোকদের কাছ থেকে। ভ্রাতৃদ্বয় বুঝতে পারলেন যে, ঢিবির নীচে। এক জাগ্রত দেবতা আছেন। তারা দেবতার মাহাত্ম্য অবগত হলেন এবং বুঝতে পারলেন স্থানটি একটি শক্তিপীঠ। বিশ্বসিংহ তখন সংকল্প করলেন যে, যদি তার দেশ সুস্থির হয় এবং রাজ্য নিষ্কণ্টক হয় তবে শক্তিপীঠে সোনার মন্দির তৈরি করে দেবেন। রাজা নিজ রাজ্যে ফিরে আসার পর ক্রমশ দেশ সুস্থির হলো। তিনি সমস্ত পণ্ডিতকে আহ্বান করে সেই দেবস্থানের বিষয় অনুসন্ধান করাতে তা কামাখ্যা। পীঠস্থান বলে জানলেন। অতপর রাজা। সেই স্থানেই মন্দির নির্মাণ করলেন এবং সোনার মন্দিরের পরিবর্তে প্রতি ইস্টকখণ্ডে একরতি করে সোনা রেখে নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করলেন। বিশ্বসিংহ যে মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, তা ১৫৫৩ খ্রিস্টাব্দে। কালাপাহাড় কর্তৃক বিধ্বস্ত হয়। তখন। বিশ্বসিংহের পুত্র নরনারায়ণ কামরূপ। প্রদেশের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ভগ্ন মন্দিরের পুনঃসংস্কার করেছিলেন। ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে সংস্কার কার্যের সূচনা করে ১৫৬৫ খ্রিস্টাব্দে নতুন করে মন্দিরের প্রতিষ্ঠা হয়। অদ্যাবধি নরনারায়ণের কীর্তিখ্যাপক একটা প্রস্তরফলক কামাখ্যা মন্দিরের দ্বারদেশে বিদ্যমান রয়েছে। মন্দিরের ভিতরে মহারাজের ও তার ভ্রাতা সেনাপতি শুক্লধ্বজের মূর্তিদ্বয় তাদের কীর্তি-কাহিনির সাক্ষ্যদান করছে।

কোচবিহার অধিপতিগণের পূর্বপুরুষদের সঙ্গে প্রথমাবস্থায় মা কামাখ্যার সম্পর্ক অতি ঘনিষ্ঠ হলেও পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে দেবীর বড়ো একটা সম্পর্ক দেখতে পাওয়া যায়নি। এমনকী মহাপীঠে এসে সেই বংশের কেউ দর্শন,স্পর্শন, এমনকী পূজাদিও নিবেদন করতে আসেননি। এই সম্বন্ধে বিভিন্ন প্রবাদ বিদ্যমান। মা কামাখ্যার পূজা পরিচালনার উদ্দেশ্যে রাজা নরনারায়ণ নিজ রাজ্য কোচবিহার থেকে ব্রাহ্মণ এনে নিযুক্ত করেন। তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন। কেন্দুকলাই নামক পূজারি ব্রাহ্মণ। কোনো এক অলৌকিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই কেন্দুকলাই ব্রাহ্মণ দ্বারা কোচবিহারের রাজপরিবারের সদস্যরা দেবী দর্শনে। নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত হন। ভিন্ন মতে নরনারায়ণ স্বপ্নদৃষ্ট হয়ে এরূপ নিষেধের অধীনতা। প্রাপ্ত হন। অন্যভাবে কেউ কেউ অনুমান করছেন, শিবভক্ত কোচ রাজারা শক্তিপীঠের মাহাত্ম নিয়ে ক্রমে ক্রমে। উদাসীন হয়ে পড়েন। ফলে রাজা ও রাজার পরিবারের লোকেরা নীলাচলের দিকে দৃষ্টিপাত করতে বিরত থাকেন এবং ছত্রদ্বারা আড়াল করে যাতায়াত করে চলেন। এই অবস্থায় কোচবিহার অধিপতিগণ যে কামাখ্যা মাতার সেবাপূজা বিষয়ে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করবেন তা বলা। বাহুল্য মাত্র। বিশেষত কালক্রমে। কামাখ্যাধাম তাদের রাজ্যের সীমার বহির্ভূত হয়ে পড়েছিল। অসমের অধিপতি আহোম জাতীয় ইন্দ্রবংশীয় রাজগণ কর্তৃক এই স্থান অধিকৃত হয়। তাদের মধ্যে স্বর্গদেব গদাধর সিংহ, রুদ্র সিংহ ও শিবসিংহের সময়ে। রাজপরিবারের শাক্তধর্মের প্রতি সবিশেষ অনুরাগ দেখা গিয়েছিল। রুদ্র সিংহ। শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে নদীয়া-শান্তিপুর থেকে কৃষ্ণরাম সার্বভৌম নামে একজন সাধক মহাপুরুষকে স্বরাজ্যে আনয়ন করেন। কামাখ্যা ও কামরূপের অন্যান্য দেবালয়ে এখন পর্যন্ত যেরূপ পূজাবিধি প্রচলিত আছে এই কৃষ্ণরাম। কর্তৃক তা প্রবর্তিত হয়েছিল। পরিশেষে বলা যেতে পারে যে, কামাখ্যা মহাপীঠ কোচবিহার অধিপতিগণের দ্বারা প্রথমত পুনরুদ্ধার এবং সেবিত হলেও অবশেষে তারা ঔদাসীন্য প্রদর্শন করায়। আহোমবংশীয় রাজগণই ক্রমশ এই পীঠের সেবা-পূজার ভার গ্রহণ করেছিলেন।

জহরলাল পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.