রাজনৈতিক স্বার্থে ইসলামের জন্ম হয়েছে। সেজন্য ইসলাম একাধারে । জড়বাদী সামরিক মজহব ও রাজনীতি। যারা নির্বিচারে কোরানে আত্মসমর্পণ করে তারাই মুসলমান। পৌত্তলিক, ইহুদি ও খ্রিস্টান বিরোধী কোরানের লক্ষ্য পার্থিব ভোগবিলাস ও ইসলামি সাম্রাজ্যবাদ। অথচ উপনিষদের। সারাংশ গীতার লক্ষ্য ভগবদ্ভক্তি-সহ নিষ্কাম কর্ম। এখানেই ধর্মের অবস্থান। আধ্যাত্মিক স্বার্থেই ভারতীয় ধর্মগুলির সৃষ্টি হয়েছে। কোরান পৃথিবীকে দুটি। এলাকায় ভাগ করেছে। দারুল-ইসলাম তথা মুসলমান এলাকা এবং দারুল-হারাব তথা শত্রু এলাকা। উভয় এলাকার মুসলমান আচরণ ভিন্ন প্রকার হয়। কোরানের একেশ্বরবাদ মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক করেছে। গণতন্ত্রের বিরোধিতা মুসলমানকে সন্ত্রাসবাদী। করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষা মুসলমানকে পরধর্মবিদ্বেষী-জেহাদি করেছে। ইসলামি শাসন। হচ্ছে শরিয়তি আইনের শাসন। গণতান্ত্রিক শাসন হচ্ছে অভিন্ন দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের শাসন। গণতন্ত্রে ধর্মীয় আইন নিষিদ্ধ। গণতন্ত্র মানে আপাদমস্তক নির্বাচন নয়। একমাত্র ক্ষমতা লাভের স্থানগুলিতে নির্বাচন থাকে। যেমন— লোকসভা, বিধানসভা, পুরসভা, পঞ্চায়েত ইত্যাদি। অন্যত্র থাকে সর্বদলীয় কমিটি। যেমন—সর্বদলীয় ছাত্র কমিটি, শিক্ষক কমিটি, অভিভাবক কমিটি, শ্রমিক কমিটি, কৃষক কমিটি ইত্যাদি। এছাড়া। নির্বাচনে সর্বাধিক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে সর্বদলীয় কমিটির নেতৃত্বে সরকার গঠন করা যায়। এক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষ থাকে না।
কোরানের ভিত্তি লজিক বিরোধী বিশ্বাস। এজন্য ইসলামের কোনো সংস্কার করা যায় না। কোরানকে আপ্তবাক্য বলা যায় না। কারণ কোরানে কোনো অতিন্দ্রীয় বিষয় ও আধ্যাত্মিকতা নেই। এছাড়া ইসলামি মজহবের জনক মহম্মদকে সিদ্ধ পুরুষ বলা যায় না। কারণ সিদ্ধ মানবের অন্যতম লক্ষণ ‘অখণ্ড জ্ঞান’। ঘোরতর দ্বৈতবাদী সামরিক নেতা। মহম্মদ নিজেকে শেষ পয়গম্বর বলে ঘোষণা করেছেন এবং সাম্রাজ্যবাদী হিংসাকে সমর্থন করে বলেছেন যে ইসলামই একমাত্র সত্যধর্ম, অন্যান্য সমস্ত ধর্মই মিথ্যা। অথচ গীতায়। অদ্বৈতবাদী অবতার কৃষ্ণ সর্বধর্মসমন্বয় ও যুক্তিসম্মত হিংসাকে সমর্থন করে বলেছেন ‘সম্ভবামি যুগে যুগে। এজন্য পৃথিবীর আদি ধর্ম অপৌরুষেয় সনাতন ধর্ম সংস্কারমূলক ও বিচারমূলক। মাতৃপ্রধান ভারতীয় সংস্কৃতিতে নারী কখনোই ভোগ্যপণ্য নয়, কিন্তু নারী স্বাধীনতার বিরোধী মধ্যযুগীয় কোরানে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য নারীকে ভোগের উপকরণ মাত্র মনে করা হয়। লাভ জেহাদের মাধ্যমে কাফের নারীকে যৌনদাসীতে। পরিণত করারও ব্যবস্থা আছে।
কোরানে কয়েকটি বিষয় মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। যেমন— কোরানের কোনো অংশ অমান্য বা সমালোচনা করলে, মহম্মদকে নবি হিসেবে অমান্য বা সমালোচনা করলে, আল্লাহকে অমান্য বা সমালোচনা করলে, কোনো মুসলমান। ধর্মান্তরিত হলে, কোনো মুসলমান নারী অমুসলমান পুরুষকে বিবাহ করলে, কোনো মুসলমান নারী অমুসলমান। পুরুষের সঙ্গে কথা বললে ও জেহাদের মাধ্যমে ইসলামের বিস্তার না ঘটালে। ইসলামি যুদ্ধ হলো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে ও মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। জেহাদের মাধ্যমে দখলীকৃত। ভূসম্পত্তি হলো ‘ওয়াকফ সম্পত্তি। যদিও ইসলামি দেশে ‘ওয়াকফ প্রথা নিষিদ্ধ। ক্রুশেড-জেহাদের মূলে আছে গড ও আল্লার নামে জমি দখলের লড়াই। মুসলমানরা ইসলাম প্রসারের স্বার্থে অমুসলমানদের কাছে মিথ্যা বলতে পারে ও ছলনার আশ্রয় নিতে পারে। এজন্য ইসলামি ইতিহাস হলো কাফের হত্যার ইতিহাস, বিধর্মীদের ধর্মস্থান ধ্বংসের । ইতিহাস ও বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ইতিহাস।
কোরানের একেশ্বরবাদ অনুসারে মানব চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন আল্লাহ, স্বর্গ, নরক আছে। যেসব মুসলমান জেহাদের মাধ্যমে কাফের বিধর্মীকে মুসলমান। করতে পারে, মরণের পরে আকাশস্থিত আল্লাহ তাদের ইন্দ্রিয়সুখে পূর্ণ স্বর্গে প্রেরণ করে ও অবশিষ্টদের নরকে। নিক্ষেপ করে। একই কথা খ্রিস্টানদের গডের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান অনুসারে আকাশে কোনো সাম্প্রদায়িক সত্তা নেই। আল্লাহ ও গড় কল্পনামাত্র। এজন্য পৃথিবীর কোনো । মুসলমান ও খ্রিস্টান আল্লাহ ও গডের পরিচয় জানে না। ইদানীং শিক্ষিত মুসলমান ও খ্রিস্টানের মধ্যে। সাম্প্রদায়িকতা বা নাস্তিকতার প্রাবল্য দেখা যাচ্ছে। পক্ষান্তরে অদ্বৈতবেদান্ত অনুসারে মানবচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো ভগবান, স্বর্গ, নরক নেই। মানবমনের উচ্চস্তর স্বর্গ, নিম্নস্তর নরক। মানুষ তথা শক্তির স্বরূপই হলো প্রেমময়। সর্বময় ভগবান, ভগবানকে ভালোবাসলেই বিশ্বপ্রেম হয়ে যায়। বিশ্বপ্রেমের প্রতীক অর্ধনারীশ্বর রাধাকৃষ্ণ। প্রবৃত্তি ও নিবৃত্তি নিয়ে মনুষ্য জীবন ভগবানের ইচ্ছাযোগে কালযুক্ত ভাগ্য ও অবিদ্যা মায়া নিয়ন্ত্রিত। এজন্য মানুষের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ। ভগবানই একমাত্র হেতুকর্তা, মানুষ প্রযোজ্যকর্তা মাত্র। মানুষের কর্ম সকাম কিন্তু ভগবানের কর্ম নিষ্কাম। অবিদ্যা মায়ার অধীনেই মানুষ পাপকর্ম করে। ভাগ্য ও কর্ম পরস্পরের পরিপূরক। মানুষ ভাগ্য নিয়ে ইহলোকে আসে ও কর্মসংস্কার নিয়ে পরলোকে চলে যায়। ভগবান ভাগ্যানুসারে মানুষকে ভক্তি, শক্তি, মুক্তি ইত্যাদি দান করেন। যৌন পবিত্রতা ও আর্থিক পবিত্রতাই হলো শ্রেষ্ঠ পবিত্রতা। পরাবিদ্যা ও অপরাবিদ্যার সমন্বয়ে শিক্ষার সম্পূর্ণর্তা। কৃষি ও শিল্প পরস্পরের পরিপূরক। কৃষি থেকে শিল্প, গ্রাম থেকে নগর, রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রসমাজতন্ত্র মানবসভ্যতার বিবর্তনমাত্র।
আধুনিক বিজ্ঞান অদ্বৈতবাদী দর্শনের সমর্থক কিন্তু দ্বৈতবাদী দর্শন তথা একেশ্বরবাদের বিরোধী। বিবেকানন্দের মতে দ্বৈতবাদ ও জড়বাদ অভিন্ন। অদ্বৈতবেদান্ত দর্শন ও আধুনিক বিজ্ঞান পরস্পর পরিপূরক। অদ্বৈতবেদান্তের জ্ঞানবাদী ভাষ্য অনুসারে ভগবান। তিনকালেই অখণ্ড আছেন। নির্বিকল্প সমাধিতে সেটি বোঝা যায়। এটিই মানুষের স্বরূপ। কিন্তু অবিদ্যা মায়ার জন্য অখণ্ডে দ্বৈতভ্রান্তি হয়, চৈতন্যে জড়ভ্রান্তি হয়, ক্ষুদ্র আমি-আমার ভ্রান্তি হয়, নাস্তিকতা আসে। অনির্বচনীয় অবিদ্যা মায়া হলো ভ্রম উৎপাদনকারী অজ্ঞানতা। এর সাহায্যে ভগবান সমগ্র জগৎকে সম্মোহিত করে রাখেন। অবিদ্যা মায়ার জন্য তত্ত্বের সঙ্গে বাস্তবকে মেলানো কঠিন হয়ে যায়। এজন্য নিত্য ব্রহ্ম চরম সত্য কিন্তু লীলা স্বালম্বন ভ্রান্তি মাত্র। যেমন রঞ্জুতে সর্পভ্রান্তি, শুক্তিতে রজতভ্রান্তি তেমন ব্রহ্মে জগৎভ্রান্তি। পক্ষান্তরে অদ্বৈতবেদান্তের ভক্তিবাদী ভাষ্য অনুসারে ভগবান আপন স্বরূপে। অখণ্ড হলেও লীলার জন্য বহুশক্তিরূপে নিজেকে বিভক্ত করেন। কারণ তিনি। রসময়, আনন্দময়। জলের মধ্য থেকে তরঙ্গ উঠে যেমন জলেই বিলীন হয়, নিরাকার জল থেকে যেমন সাকার বরফ তৈরি হয় তেমন জড়, জীব, উদ্ভিদ, মানুষ, প্রতিমা, দেবতা, অন্ন ইত্যাদি সমস্তই নিরাকার সচ্চিদানন্দ সমুদ্রের নাম-রূপের তরঙ্গবিকার মাত্র। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সারাংশই হলো নিরাকার অর্ধনারীশ্বর সচ্চিদানন্দ (একাধারে কালের বাইরে নিষ্ক্রিয় সৎ স্বরূপ পুরুষ ও কালের ভিতরে সক্রিয় চিদানন্দ স্বরূপ প্রকৃতি)। জন্ম-মৃত্যু হলো ঘর বদলের খেলা। শক্তিমান ও শক্তি পরস্পর পরিপূরক। এজন্য নিত্য ব্রহ্ম চরম সত্য কিন্তু লীলা তথা জগৎ ব্যবহারিক সত্য। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞান ও ভক্তি পরস্পর পরিপূরক। জ্ঞানে জানা যায় কিন্তু ভক্তিতে পাওয়া যায়। সেজন্য ভক্তির মধ্য দিয়ে জ্ঞানের দিকে চলা, সীমার মধ্য দিয়ে অসীমের দিকে চলাই জীবনের ধর্ম। সচ্চিদানন্দ যুক্ত মানবতাই একমাত্র মনুষ্যধর্ম। জীবনের প্রাথমিক লক্ষ্য ভগবদ্ভক্তি, অর্থোপার্জন ও বিষয়ভোগ। কিন্তু চরম লক্ষ্য অখণ্ডজ্ঞান তথা আত্মজ্ঞান তথা মুক্তি।‘সোহহং’ বা ‘তত্ত্বমসি’ বা ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’– জীবনের শেষ কথা। ভগবদ্ভক্তি ছাড়া সংসার থাকে না, রিপু সংযত হয় না, মনে অবসাদ আসে। ধর্মানুশীলন, যোগানুশীলনের মাধ্যমে চিত্তশুদ্ধি হলেই ভগবদ্ভক্তি অর্জিত হয়। পরস্পরের পরিপূরক নারী-পুরুষের মধ্যে প্রাকৃতিক বৈষম্য থাকলেও জন্মগত ত্রিবিধ মৌলিক অধিকারের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমস্ত মানুষ সমান। ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য মানুষকে ত্রিবিধ সংগ্রাম করতে হয়। ত্রিবিধ মৌলিক অধিকার (১) আর্থিক কর্ম ও আর্থিক নিরাপত্তার অধিকার, (২) মাতৃভাষা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্যের অধিকার, (৩) আধ্যাত্মিক কর্ম ও ব্যক্তি স্বাধীনতার। অধিকার। ত্রিবিধ সংগ্রাম (১) সামাজিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, (২) প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, (৩) ষড় রিপুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
অদ্বৈতবাদ অনুসারে সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মাত্র চার আনা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, অবশিষ্ট বারো আনাই অতিন্দ্রিয়। কোয়ান্টাম স্তরে যেমন অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে তেমন স্থূল জগতেও ঘটে। নিরাকার ঈশ্বর থেকে সমস্ত কিছু সৃষ্টি হয় আবার প্রলয়কালে সমস্ত কিছু নিরাকার ঈশ্বরে বিলীন হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে। শিল্পবিপ্লবের ফলে একেশ্বরবাদী সাম্প্রদায়িক ইসলাম ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেছে কিন্তু খ্রিস্টান সভ্যতা আধুনিক হয়েছে। শিল্প বিপ্লবের পরিণাম হলো বিজ্ঞানের উন্নতি, ব্যবহারিক জীবনে যুক্তিবাদ, ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতা, ইতালির ঐক্য আন্দোলন, নভেম্বর বিপ্লব, বঙ্গপ্রদেশ তথা ভারতের সাংস্কৃতিক । নবজাগরণ। জাতীয়তা মানে জাতি বৈরিতা নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও অত্যাচারীর বিরুদ্ধে অত্যাচারিতের সংগ্রাম। জাতীয়তাবোধ ছাড়া রাষ্ট্র। পরিচালনা অসম্ভব। জাতি ও নাগরিকত্ব আলাদা। বহির্ভারতে প্রধানত তিন প্রকার দেশ দেখা যায়। (১) সেকুলার গণতান্ত্রিক জাতি দেশ (রাষ্ট্রধর্ম ও রাষ্ট্রনীতি বাইবেল, রাষ্ট্রশক্তির উৎস শিক্ষিত জনতা)। (২) থিয়োক্র্যাটিক মুসলমান দেশ। (দেশধর্ম ও দেশনীতি কোরান, শক্তির উৎস সেনাবাহিনী)। (৩) একদলীয় কমিউনিস্ট দেশ (দেশনীতি কমিউনিজম, শক্তির উৎস সেনাবাহিনী)।
ভারতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ক্ষেত্র হচ্ছে সংস্কৃত ভাষা- সাহিত্য ও । অদ্বৈতবেদান্ত দর্শন। ৫১টি সতীশক্তিপীঠ প্রাচীন ভারতের ভৌগোলিক পরিচয় বহন করছে। ভারতের জাতীয়ত্ব ও হিন্দুত্ব অভিন্ন। ভারতীয় জাতীয়তা বৈদান্তিক জাতীয়তা। বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার প্রতিক্রিয়ায় সৈয়দ আহমেদ ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রচার করেছিলেন। বিবেকানন্দের মত অনুসারে ভারত হবে। ‘বৈদান্তিক গণসমাজতান্ত্রিক সার্বভৌম । ভারতীয় গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র (রাষ্ট্রদর্শন অদ্বৈতবেদান্ত, রাষ্ট্রনীতি গীতা (জাতীয় গ্রন্থ), রাষ্ট্রশক্তির উৎস শিক্ষিত জনতা)।
অমিত চক্রবর্তী
2019-10-18