ভারতীয় ও বঙ্গীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্র স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত

ভারতীয় সংস্কৃতিতে শ্রীরামচন্দ্র একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। বিভিন্ন হিন্দু পুরাণ অনুসারে বিষ্ণুর দশাবতারের অন্যতম হলেন অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রাম। ফলে রামচন্দ্র অন্যতম হিন্দু দেবতাও। ভারতীয় ঐতিহ্য মানুষের দেবত্বে উত্তীর্ণ হওয়া এবং দেবতার মনুষ্যরূপ ধারণ একটি সাধারণ ঘটনা। ভারতের দুই শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের অন্যতম রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র এই রামচন্দ্র। যে রামায়ণের ওপর নির্ভর করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন ভাষায় যুগে যুগে রচিত হয়েছে অসংখ্য কাব্য, নাটকসহ অগুনতি সাহিত্য। ভারতীয় সংস্কৃতির বিস্তার যেখানেই ঘটেছে সেখানেই শ্রীরামও পৌঁছে গেছেন। তাই সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়াতেই রামচন্দ্রের প্রভাব দেখা যায়।
ভারতীয় জনজীবনে রামচন্দ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “বাল্মীকির রামচরিত কথাকে কেবলমাত্র কবির কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন।…ইহার। সরল অনুষ্টুপ ছন্দে ভারতবর্ষের সহস্র বছরের হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া আসিতেছে।” ভারতবর্ষের সব থেকে বড়ো উৎসব ‘দীপাবলী’– যা রামচন্দ্রের লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় ফেরা উপলক্ষ্যে পালিত হয়। দশেরা’ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অন্যতম বড়ো উৎসব— যা রামচন্দ্রের লঙ্কাধিপতি রাবণকে পরাজিত করা উপলক্ষ্যে উদ্যাপিত হয়। অর্থাৎ শ্রীলঙ্কা থেকে অযোধ্যায় পৌঁছতে শ্রীরামচন্দ্রের সময় লেগেছিল ২১ দিন। মজার কথা হলো যে, আধুনিক প্রযুক্তিও বলছে শ্রীলঙ্কা থেকে পায়ে হেঁটে অযোধ্যা পৌঁছতে কোনো মানুষের প্রায় ২১ দিন লাগতে পারে। উত্তর ভারতের বহু মানুষ পরস্পরকে সম্বোধন করেন ‘রাম রাম’ বলে। মৃত্যুর পর শোনা যায়—‘রাম নাম সত্য হ্যায়। এই ভাবে প্রত্যেক ভারতীয়র জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছেন রামচন্দ্র। ভারতীয় সংস্কৃতিতে আদর্শ প্রজানুরঞ্জক, প্রজা কল্যাণকারী। রাজ্য— যে রাজ্যে সাধারণ মানুষ সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে তাকে ‘রামরাজ্য’ বলা হয়ে থাকে। এই ‘রামরাজ্য স্থাপনের কথা গান্ধীজীও বলতেন। অনেকের মতে, গান্ধীজী মৃত্যুর আগের শেষ কথাও ছিল—“হে রাম।
এবার আসা যাক আমাদের বঙ্গভূমির দিকে। বাঙ্গালির সবথেকে বড়ো উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা। আমরা সকলেই জানি শরৎকালে মায়ের অকাল বোধন প্রথম করেছিলেন রামচন্দ্র, তার আগে মূলত পূজা হতো বসন্তকালে। এই অনুযায়ীই আজও বাঙ্গালি শরৎকালে মাতৃ আরাধনা করে চলেছে। বাঙ্গালি শিশুদের আজও শেখানো হয়। ভূতের ভয় পেলে বলতে—“ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি/রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে, ভয়টা আমার কী?”হাওড়ার রামরাজাতলা, হুগলীর শ্রীরামপুর-সহ গোটা বাঙ্গলা জুড়ে অসংখ্য স্থান রামের সঙ্গে (মূলত রামনগর, রামপুর ইত্যাদি) সম্পর্ক রয়েছে। এবার আমরা যদি বঙ্গের প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইতিহাসের দিকে নজর দিই তাহলে সেখানেও রামের প্রবল উপস্থিতি লক্ষ্য করব। বাংলায় রচিত সংস্কৃত সাহিত্যগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ হলো সন্ধ্যাকর নন্দীর লেখা ‘রামচরিত’। পাল বংশীয় রাজা রাম পালের সভাকবি ছিলেন সন্ধ্যাকর নন্দী। এই ‘রামচরিত’ কাব্য হলো একটি দ্ব্যর্থবোধক কাব্য—অর্থাৎ এখানে একই সঙ্গে তিনি রামচন্দ্রের কৃতিত্ব বর্ণনার আড়ালে পাল বংশীয় নৃপতি রাম পালের নানা কীর্তি-কাহিনির বর্ণনা করেছেন। মধ্যযুগে বাঙ্গলায় কৃত্তিবাস ওঝা ‘শ্রীরাম পাঁচালি’ রচনা করেন— এই কৃত্তিবাসী রামায়ণ আজও বাঙ্গালির ঘরে ঘরে পঠিত হয়। ৫১টি শক্তিপীঠের অন্যতম হলো— বীরভূমের লাভপুরের ফুল্লরা দেবীর মন্দির। সতীর অধর (নীচের ঠোট) এখানে পড়েছিল। বিশ্বাস যে, মন্দিরের পাশের বড়ো পুষ্করিণী থেকেই হনুমান রামচন্দ্রের জন্য ১০৮টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করেন— যা দেবী দুর্গার পূজার জন্য তার প্রয়োজন ছিল। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পরিবারের উপাস্য দেবতা ছিলেন শ্রীরাম। তাই পরিবারের তিন পুত্রের নামই শুরু হয় রাম দিয়ে। রানি রাসমণি দেবীর পরিবারের কুলদেবতাও ছিলেন রঘুবীর— যা আদতে রঘু বংশীয় বীর রামচন্দ্রকেই বোঝাচ্ছে। সুকুমার সেন দেখাচ্ছেন যে, রামচন্দ্রকে নিয়ে “রসঘন রাম। নব দুর্বাদল শ্যাম।” বিশিষ্ট ক্ষেত্র সমীক্ষক ও লোকসংস্কৃতিবিদ ড. স্বপন কুমার ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন লেখায় বঙ্গীয় সংস্কৃতির সঙ্গে রামচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, বাঙ্গলার বৈষ্ণব সংস্কৃতির ধারায় রামের অস্তিত্ব বিরাজমান। অন্যতম চৈতন্য জীবনীকার দয়ানন্দের নিজের পরিবার ছিল রামচন্দ্রের পরিবার। চৈতন্যদেবের বন্ধু মুরারী গুপ্ত নিজে ছিলেন রামভক্ত। রাঢ় বাঙ্গলার অন্যতম দেবতা হলেন ধর্মরাজ। এই ধর্মরাজপালায় বহু জায়গায় রামায়ণের গান হয়। এছাড়াও বাঙ্গলায় প্রচুর পরিমাণে টেম্পল কয়েন পাওয়া গেছে রামচন্দ্রকেন্দ্রিক। পঞ্চদশ-অষ্টাদশ শতকের এইসব মুদ্রা রাঢ় বাঙ্গলার মাটির তলা থেকেই পাওয়া গেছে। স্বপন কুমার ঠাকুর দেখিয়েছেন, বাঙ্গলার বিভিন্ন বিশেষত শুধুমাত্র কাটোয়া মহকুমাতেই প্রায় ২০টি প্রাচীন রামচন্দ্রের বিগ্রহ আছে। এতকিছুর পরেও যাঁদের মনে হয় যে রামচন্দ্র বঙ্গীয় সংস্কৃতির অংশ নয়—তাঁদের হয় বাঙ্গালি সংস্কৃতির সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, নচেৎ তারা জেনে। বুঝে মিথ্যাচার করছেন।
আমরা জানি যে মধ্যযুগে বহিরাগত আক্রমণকারীদের দ্বারা হাজার হাজার হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈন মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং বহু জায়গাতেই পুরনো মন্দিরের ওপরেই মসজিদ নির্মিত হয়। ভারতবর্ষে মুঘল শাসনের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের নির্দেশে তাঁর সেনাপতি মির বাকি রাম জন্মভূমি অযোধ্যায় রামচন্দ্র সম্পর্কিত সমস্ত মন্দির ধ্বংস করে ১৫২৮-এ একটি মসজিদ স্থাপন করেন। এই মসজিদটি বাবরি মসজিদ নামে বেশি পরিচিত, কিন্তু ১৯৪০-এর দশকের আগে এটি পরিচিত ছিল। ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ নামে। মসজিদটি একটি ছোটো টিলার ওপর অবস্থিত— যার নাম “রামকোট’ (রামের দুর্গ)।
ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কারে ভূষিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ (এএসআই)-এর প্রাক্তন রিজিওনাল ডিরেক্টর (উত্তর) ও সুপারিন্টেনডেন্ট আর্কিওলজিস্ট প্রখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ কে. কে. মুহাম্মদের নেতৃত্বে একটি দল অযোধ্যার বিতর্কিত জায়গায় উৎখনন চালিয়ে মসজিদের তলায় পুরনো স্থাপত্যের হদিস পান। মুহাম্মদ ২০১৬-তে। মালায়লম ভাষায় প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীতে (যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘আমি একজন ভারতীয়’) লেখেন যে, মার্কসবাদী ইতিহাসবিদরা কট্টরপন্থী মুসলমান গোষ্ঠীগুলিকে সমর্থন করায় অযোধ্যা বিতর্কের গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছনো কঠিন হয়ে পড়ে। মুহাম্মদ এই বইয়ে দাবি করেছেন, অযোধ্যায় হওয়া প্রত্নতাত্মিক খননকার্যে মসজিদের তলায় মন্দির থাকার পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু বামপন্থী ইতিহাসবিদরা একে অস্বীকার করে এলাহাবাদ হাইকোর্টকে ভুল পথে চালানোর চেষ্টা করে। ২০০৩-এ ‘ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ এলাহাবাদ হাইকোর্টে রিপোর্ট জমা দেয় যে, মসজিদের নীচে খ্রিস্টিয়। দশম শতকের একটি স্থাপত্য রয়েছে। এবং ওই অঞ্চলটিতে অন্তত ৩৩০০ বছর আগে থেকে মানুষ বসবাস করত। এবং অন্তত ১০০০ বছরের পুরনো স্থাপত্যের ওপর এই মসজিদটি খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকের প্রথম দিকে তৈরি করা হয়। ২০১০-এ তার রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট আইএসআই-এর এই সন্ধানকে মান্যতা দিয়ে মেনে নেয় যে, ওই জায়গাটিতে একটি বৃহদাকার হিন্দু ধর্মীয় স্থাপত্য ছিল।
অযোধ্যায় বিবদমান জায়গাটি বিগত কয়েক শতক ধরে অসংখ্য সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করেছে। ঊনবিংশ শতকেও ব্রিটিশ কোর্টে ওই জায়গাটির দখল নিয়ে মামলা চলে। স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদালত এই নিয়ে মামলা চলছে। শিয়া ওয়াকফ বোর্ড ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে যে, রামজন্মভূমিতে রামমন্দির নির্মিত হলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তা সত্ত্বেও অনেক ওজর আপত্তি এবং ৪০ দিন শুনানির পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গত ৯ নভেম্বর রামজন্মভূমির পক্ষে রায় দিয়েছেন। মিটে গেল কয়েক শত বছরের বিতর্ক। ভারতবর্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায় সমস্ত গণতন্ত্রপ্রেমী সুনাগরিক মাথা পেতে মেনে নিলেন। ভারতবর্ষে পুনরায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হলেন শ্রীরাম।
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.