মানুষের বাড়িঘর জোর করে দখল করার ঘটনা পৃথিবীর খুব বেশি দেশে সচরাচর ঘটে না। বাংলাদেশ ও পাকিস্তান এটি একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এর শিকার এই দুই দেশের হিন্দুরা। পাকিস্তানকে আমরা বর্বর, সন্ত্রাসী দশ বলে আখ্যায়িত করি। আর বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চারণভূমি বলতে বলতে আমাদের মুখে ফেনা উঠে যাচ্ছে! কী চমৎকার সম্প্রীতি!
প্রতিদিন হিন্দুরা দেশত্যাগ করছে, কন্যা হারাচ্ছে, গৃহবধূ লাঞ্ছিতা হচ্ছেন, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত, চাঁদা আদায়, লুটপাট, মূর্তিভাঙা, মন্দিরে আক্রমণ হরদম চলছে তো চলছেই, থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। দেশ এখন করোনা মহামারীর জন্যে লকডাউন। রমজান গেল। ইদ গেল। তাতে কী? হিন্দুর ওপর অত্যাচার বন্ধের জন্যে এসব যথেষ্ট নয়। | ১৯৪৬ সালে কলকাতার পর নোয়াখালীতে হিন্দু নরসংহার, দেশভাগ, সেই শুরু। ১৯৪৭-এ অধুনা বাংলাদেশ বা আগেকার পূর্ব-পাকিস্তানে হিন্দুর ওপর যে অত্যাচার শুরু হয়েছিল, ২০২০ সালে তা অব্যাহত রয়েছে। শুধু স্থান-কাল-পাত্র ও অত্যাচারের ধরন পালটেছে। রাষ্ট্রযন্ত্র এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক শক্তি ছিল, এখনো আছে, কখনো-সখনো সেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ, অথবা নীরব দর্শক। পাকিস্তান ১৯৫০ সালে ‘জমিদারি প্রথা বাতিল করে। মানুষ এটি স্বাগত জানায়। এই আইন শুধু পূর্ব-পাকিস্তানে কার্যকর হলো, কারণ জমিদাররা প্রায় সবাই হিন্দু। জমিদাররা কলকাতা চলে গেলেন। মুসলমানরা হিন্দুর সম্পত্তি লুটপাট করলেন। জমি দখল সেই শুরু? এই আইনের প্রচারিত মহৎ লক্ষ্য ছিল গরিব কৃষককে জমি দেওয়া। সেটা হয়নি। এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু বিতাড়ন, তা সফল।
একই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে (১৯৬৫) ‘শত্রু সম্পত্তি’আইনটি প্রণয়ন করে। ভারত একই আইন করেছিল, যুদ্ধের সময় শত্রু দেশের নাগরিকের সম্পত্তি শত্রুদেশ যাতে উপকৃত হতে না পারে, এজন্যে এ আইনটি করা হয়। ভারতে যথাসময়ে আইনটির অবলুপ্তি ঘটে এবং এর কোনো অপপ্রয়োগ ছিল না। পূর্ব-পাকিস্তানে এরপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। একটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে। ‘শত্রু সম্পত্তি আইন ভোল পালটে ‘অর্পিত সম্পত্তি হয়েছে। রাজা এসেছেন, রাজা | গেছেন, এই আইনের বহুবিধ অপপ্রয়োগ হয়েছে। মধ্যখান থেকে সরকার হিন্দুদের কাছ থেকে প্রায় ত্রিশ লক্ষ একর সম্পত্তি জোর করে নিয়ে মুসলমানদের দিয়েছে। হিসাবটি অধ্যাপক আবুল বারাকাত ও মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের। ২০১৩-তে আইনটি বাতিল হয়েছে। কোনো হিন্দু তার সম্পত্তি ফেরত বা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন বলে কেউ শোনেনি।
হিন্দুর অপরাধ সে ভারত চলে যায়। লোকে বলে, স্বেচ্ছায় যায়। আরও বলে, মুসলমানরা তো ভারত থেকে আসেনি? এই লোকগুলো জেগে ঘুমায়! বুঝে কিন্তু বলে না যে, ভারতের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী মুসলমানদের পাশে আছেন, কথা বলেন। ভারত সরকার সকল নাগরিককে সমান চোখে দেখে। বিচারব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে হিন্দুদের পক্ষে কেউ নেই। দু’চারজন থাকলেও তাদের কণ্ঠস্বর ভয়ে নীচু। সারকারি আমলারা হিন্দু বিরোধী। বিচার নাই। বাংলাদেশে শুধুমাত্র ওয়াজে হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে যত কথাবার্তা হয়, বিশ্বের কোথাও এমন নজির নেই। ২০০১-এর পর হিন্দুদের ওপর যত ভয়াবহ অত্যাচার হয়েছে, তার বিচার হয়নি। গত পঞ্চাশ বছরে জেহাদিরা হাজার হাজার মূর্তি ভেঙেছে, আজ পর্যন্ত একজনের বিচার হয়নি। বাংলাদেশে আক্রান্ত হয়নি এমন মন্দির খুঁজে পাওয়া যাবে না। হিন্দুর মেয়ে গণিমতের মাল। বিনোদন জগতে প্রায় প্রতিটি হিন্দু মেয়ে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়। স্ববাবতই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অর্থহীন হয়ে গেছে।
একজন শায়লা খান বন্যা লিখেছেন, বাংলাদেশে এখন নব্বই শতাংশ মানুষ মৌলবাদের চর্চা করে। দিনে দিনে দেশটা মৌলবাদের আখড়া হয়ে উঠছে। যাঁরা প্রতিবাদ করছে, তারা হারিয়ে যাচ্ছে বা জেলে পচছে। সদিচ্ছা থাকলে এই সরকার অবস্থার পরিবর্তন করতে পারতো। তিনি বলছেন, হেফাজতিদের কথায় শিক্ষা ব্যবস্থা ইসলামিকরণ হয়েছে, ভাস্কর্য সরানো হয়েছে। হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, বাউলদের জেলে ভরে দেওয়া হচ্ছে, মুক্তচিন্তার মানুষদের মেরে ফেলা হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না। শেখ হাসিনা নিজে বলেছেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া যাবে না। কিন্তু সেই অনুভূতি শুধু ইসলাম ধর্মের জন্যে প্রযোজ্য। ওয়াজ মাহফিল মোল্লারা হিন্দুধর্ম নিয়ে যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। এর জন্য কেউ জেলে যাচ্ছে না। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ ধর্মভিত্তিক মানবতা দেখায়, তাই বিদ্যানন্দের কিশোর কুমার দাসের বিরুদ্ধে মামলা হয়। তিনি বলেন, সবাই মিলে যে দেশটা স্বাধীন করলো, সেই দেশটা কী হিন্দুরা এখন নিজের দেশ বলে দাবি করতে পারছে, না ভাবতে পারছে? নিজ দেশে পরবাসী থাকার যন্ত্রণা শুধু ভুক্তভোগী জানে!
ভদ্রমহিলাকে আমি চিনি না, তাকে সালাম। তার মতো মানুষ এখন বাংলাদেশে নাই বা থাকতে পারেন না। তিনি এসব কথা লিখতে পারছেন কারণ তিনি বিদেশে থাকেন। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্যে বিএনপি-জামাতকে দায়ী করে নিজেদের হাত পরিষ্কার রাখতে সচেষ্ট। ঘটনা হচ্ছে, হিন্দু নির্যাতনের জন্যে দেশের বড়ো বড়ো সব দল দায়ী। সবার হাত হিন্দুর রক্তে রঞ্জিত। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বুনেছেন মেজর জিয়া, এরশাদ। খালেদা জিয়া তা লালন করেছেন, আওয়ামি লিগ তাতে জল ঢেলেছে। চারাগাছ তাই এখন মহীরুহ। হিন্দু বা সংখ্যালঘু মুক্তমনা বা বাউলরা এর খেসারত দিচ্ছেন। দিনে দিনে বাংলাদেশে হয়তো আর একটি একাত্তর অনিবার্য হয়ে উঠছে। একাত্তরে হিন্দুরা বংেলাদেশকে বিশ্বাস করেছিল, বিশ্বাসের মর্যাদা কেউ রাখেননি। সামনে হিন্দুরা কী আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে?
হিন্দুদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে, কেউ প্রতিবাদ করে না। বরং বলে, হিন্দুরা ভারতকে ভালোবাসে, তাই দেশত্যাগ করছে। ভারত বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভালো না বেসে কি উপায় আছে ? গণতন্ত্র আপনারও পছন্দ, তাই আপনি আপনার পুত্র-কন্যাকে ইউরোপ-আমেরিকায় পাঠান, কোনো মুসলমান দেশে নয়। ভারত আপনার অপছন্দ, কারণ ওখানে হিন্দুরা বসবাস করেন! কেউ স্বীকার করুন বা না করুন, বাংলাদেশ থেকে হিন্দুরা দেশত্যাগ করছে। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অত্যাচারে। মুখে যতই শান্তির বুলি আওড়ান না কেন, বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালেই ‘শান্তির মা’ মারা গেছে। বাস্তব হচ্ছে, বাংলাদেশের হিন্দুরা জন্ম থেকেই জ্বলছে। জ্বলতে জ্বলতে অঙ্গার হয়ে গেছে। সম্ভবত তাই সময় এসেছে উঠে দাঁড়াবার। বেঁচে থাকার সংগ্রামে জীবন বাজি রেখে রুখে দাঁড়াবার।
শিতাংশু গুহ