মহারাষ্ট্রের (Maharashtra) পালঘরে (Palghar) দুই হিন্দু সন্ন্যাসীকে পিটিয়ে মারা হল। ঘটনার নৃশংসতায় সারা দেশ স্তম্ভিত হয়ে গেছে। সত্তর বছর বয়েসের সাধু কল্পবৃক্ষ গিরি পুলিশের হাত ধরে বেঁচে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছিলেন। ৩৫ বছরের সন্ন্যাসী সুশীল গিরি ছুটে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গত ১৭ এপ্রিল রাতে মহারাষ্ট্র (Maharashtra) পুলিশের অন্তত সাত আট জনের উপস্থিতিতে একদল মৌলবাদী পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেললো দুইজন সন্ন্যাসী এবং তাঁদের গাড়ি চালক ৩০ বছরের নিলেশ তেলগারেকে।

মহারাষ্ট্রের নাসিকে ত্রিম্বাকেশ্বর শিব মন্দির থেকে হেঁটে মিনিট দশেকের রাস্তা দক্ষিণমুখী হনুমান মন্দির। সেই মন্দিরেই শ্রী পঞ্চদাশনম জুনা আখাড়া। কাশীর জুনা আখাড়ার নাসিক কেন্দ্র সেটি। প্রবীণ কল্পবৃক্ষ গিরিজিকে সবাই খুব ভালোবাসতো আর শ্রদ্ধা করতো, তাঁকে ত্রিম্বাকেশ্বর মন্দির থেকে আখাড়া পর্যন্ত সকলে এক ডাকে ‘চিকনা বাবা’ বলে চিনতো। নাসিকে যতবার কুম্ভ মেলা হয়েছে সব সময় বাইরে থেকে আসা সাধু, সন্ত বা ভক্তদের মায়ের মত যত্ন করতেন চিকনা বাবা।

২০১৫ সালে নাসিকে কুম্ভ মেলার সময় এমনই সেবা পেয়েছিলেন জয় দেবনন্দ তীর্থনাথ। কল্পবৃক্ষ গিরিজির সেবা ভাবের কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেললেন কলকাতার এই সন্ন্যাসী। “অমন মানুষকে দেখে কেউ পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে?”

গত ১৬ এপ্রিল কল্পবৃক্ষ গিরিজির গুরু ভাইয়ের শিষ্য রাম গিরিজি দেহ ছেড়ে গেছেন। রাম গিরিজি থাকতেন গুজরাতের সুপাত্র বেহেরা গুরু আশ্রমে। রাম গিরিজি, গণপিটুনিতে মৃত অপর সন্ন্যাসী সুশীল গিরিজির গুরুদেব ছিলেন তাই করোনা ভাইরাসের জন্য দেশ জোড়া লকডাউনের মধ্যেও তাঁদের মহারাষ্ট্র থেকে গুজরাত যাওয়ার এত আকুতি ছিল। দাদরা নগর হাভেলি সীমান্ত থেকে তাঁদের লকডাউনের জন্য ফিরিয়ে দিলে তাঁরা পালঘরের গ্রামের রাস্তা নেন। ধাবাদি খানবেলের পথে গাড়চিনচালে ঘটল অঘটন। ঘটনাস্থলের ফরেস্ট চেকপোস্টের থেকে সন্ন্যাসীদের গাড়ি আটকে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশে খবর দেওয়া হয়। পুলিশের বিশেষ বাহিনী যখন আসে তখন সন্ন্যাসীরা বন দফতরের প্রহরা চৌকিতে বসেছিলেন। সামান্য মারধর করা হয়েছিল। পুলিশের সামনেই, পুলিশের গাড়ি ভেঙ্গে ওই সত্তর বছরের বৃদ্ধ মানুষটিকে সঙ্গে এক তরুণ সন্ন্যাসী আর যুবক গাড়ির চালককে পিটিয়ে মারা হলো। এটা কিভাবে সম্ভব হলো? অদ্ভুত মনে হয় না?

কেন সম্ভব হল? সেই রহস্য খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল ঘটনাস্থলে অনেক বাঘা বাঘা রাজনৈতিক নেতা উপস্থিত ছিলেন। ঘটনাস্থল দাহানু বিধানসভার অন্তর্গত। দাহানু বিধানসভার বর্তমান বিধায়ক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মা) নিকোলে বিনোদ বিভা। দাহানু বিধানসভা পালঘর লোকসভার মধ্যে পড়ে। এই লোকসভাটি এবার এনসিপি জিতেছে।
সেদিন ঘটনাস্থলে এনসিপি দলের জেলা পরিষদ সদস্য কাশীনাথ চৌধুরীকে ভিডিও ক্লিপিং এ দেখা গেছে। ভিডিওতে প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে সিপিআইএম দলের ডাকসাইটে নেতা বিষ্ণু মাতারা, সুভাষ ধাবন এবং ধমার নাম উঠে আসছে। তাই পুলিশের এত বড় দলটি কেন তিনজন অসহায় মানুষকে সেদিন বাঁচাতে পারেনি, তার সার্বিক বিশ্লেষণ ও নিরপেক্ষ তদন্তের প্রয়োজন। আর যদি ঘটনার পিছনে কোনও পরিকল্পনা থাকে, তবে সেই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

ভিডিও ফুটেজে সাধুদের প্রহার শুরু করার মুহূর্তে কেউ একজন, ‘মার শোহেব মার’ বলে নির্দেশ দিচ্ছে শোনা যাচ্ছে। এই শোহেব কি গ্রেফতার হয়েছে? পুলিশের হেফাজতে যে ১১০ জন গ্রামবাসী আছেন তার মধ্যে যদি শোহেব থেকে থাকে, তবে সেই বলতে পারবে ওই নির্দেশ তাকে কে দিচ্ছিল?

এলাকার মূল অধিবাসী ছিলেন ওয়ার্লি জনজাতির মানুষেরা। সেইসঙ্গে দুবলা আর ধোবি জনজাতির সামান্য কিছু। এখন শিল্পায়নের জন্য পার্সি, ইরানি, মুসলমান, জৈন আর গুজরাতি সব সম্প্রদায়ের লোকই আছেন। জনজাতিদের কিছু অংশ হিন্দু ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই বিধানসভায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়েছেন অনেকে। ২০১৯ সালে বিধানসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মা) কেবলমাত্র একটি আসনই পেয়েছে। সেটি এই দাহানু বিধানসভা আসন। করোনা লকডাউনের মধ্যে এত লোক জড়ো করে ওই দুটি দলের নেতারা রাত্রে রাস্তার উপর কি করছিলেন? “চোর আসছে” এই গুজবই বা কাদের ছাড়ানো? এই পরিবেশে ‘সফ্ট টার্গেট’ হয়ে গেছেন গেরুয়া পরিহিত সন্ন্যাসীরা।

বামেদের শাসনে হিন্দু সন্ন্যাসীদের কখনো চোরের বদনাম দিয়ে, কখনো ছেলে ধরা বলে পিটিয়ে বা পুড়িয়ে মেরে ফেলা নতুন ঘটনা নয়। বহু ঘটনা ঘটেছে। প্রায় কোনও অপরাধীই শাস্তি পায়নি। ১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল। গড়িয়ার একটি সেবা কেন্দ্র চালাতেন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী সম্প্রদায়। ৩০ কি ৩২ বছরের সন্ন্যাসিনী আনন্দ প্রচেতা ওই সেবাকেন্দ্র চালাতে। সেদিন সঙ্ঘের একটি সমাবেশে সারা রাজ্য থেকে দাদা ভাইরা (সন্যাসীরা) এসেছেন শুনে আনন্দ প্রচেতা এসেছিলেন বালিগঞ্জে। তাঁর সেবা কেন্দ্রের খবর দিতে।

আনন্দ প্রচেতা দেখলেন একটি ট্যাক্সি থেকে প্রথমে কয়েকজন গেরুয়া ধারী সন্ন্যাসী দাদাভাইকে কিছু লোক টেনে নামাচ্ছে। দাদা ভাইদের গায়ে হাত দিচ্ছে দেখে ওই সন্ন্যাসিনী ছুটে গিয়েছিলেন। সেদিন ‘ছেলেধরা’ বলে ১৬ জন সন্ন্যাসীর সঙ্গে সন্ন্যাসিনী আনন্দ প্রচেতাকেও প্রথমে পিটিয়ে মেরে, তারপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। দিনের বেলায় বালিগঞ্জের বিজন সেতুর সামনে। ৩৪ বছরের বাম শাসনে এই চরম অমানবিক সন্ন্যাসী হত্যার কোনও বিচার হয়নি। একজন অপরাধীও শাস্তি পায়নি।

১৯৯৬ সাল। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট তখন মধ্যগগনে। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জয়নগর যাওয়ার পথে গোচারণ স্টেশনের কাছে খাকুরদহ হাট। হাটের পাশেই শ্মশান। সেখানে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি আশ্রম আছে। আশ্রমের মহন্ত ছিলেন ৬৫ বছর বয়সী হরি দাস বাবাজী। সে বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি সকালে জিহাদি মৌলবাদীরা প্রকাশ্য দিবালোকে হত্যা করে পুড়িয়ে দিয়েছিল ওই প্রৌঢ় সন্ন্যাসীকে। তাঁর অপরাধ ছিল তিনি মৌলবাদীদের কথামতো অষ্টপ্রহর সংকীর্তন বন্ধ করতে রাজি হননি। হরি দাস বাবাজী হত্যাকারীরা আজ পর্যন্ত শাস্তি পায়নি।

এ রাজ্যের একশ্রেণীর সংবাদমাধ্যম এবং তথাকথিত সুশীল সমাজের একটি অঘোষিত ‘করতে নেই’ তালিকা আছে। একটি গোপন নীতিবোধের পুস্তিকা আছে। উগ্র সাম্প্রদায়িক বিশ্লেষণ করা যায়, ‘অসহিষ্ণুতার’ নাম করে অন্তিম ব্যক্তি পর্যন্ত সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়ানো যায়, দিল্লির দাঙ্গার ছবি হিসেবে একজন ফেজ টুপি পরিহিত মানুষকে মাটিতে ফেলে একদল মানুষ প্রহার করছে,– এমন ছবি প্রথম পাতায় ছাপানো যায়! কিন্তু হিন্দু সন্ন্যাসীকে পিটিয়ে মারলে সেটা ‘বলতে নেই’। বাংলাদেশে নির্মম হিন্দু নির্যাতন হলে সেটা দেখতে নেই।

এই ভন্ডামি কিন্তু বাংলার প্রাতঃস্মরণীয় মনীষীদের মধ্যে ছিল না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) আর্য সমাজের স্বামী শ্রদ্ধানন্দের (Swami Shraddhananda) বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত সত্বর ভেঙে দিতে হবে, না হলে প্রভূত বিপদ, গুরুদেব সেদিন সেটাই বলেছিলেন।

শিক্ষা আন্দোলনে অনবদ্য ভূমিকা ছিল স্বামী শ্রদ্ধানন্দের। স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অগ্রণী সেনাপতি ছিলেন তিনি। ইংরেজদের দমনমূলক ‘রাওলাট অ্যাক্ট’ বিরোধী আন্দোলনে তিনি দিল্লিতে হাজার হাজার মানুষকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯২৬ সালের ২৩ শে ডিসেম্বর আব্দুল রশিদ নামে এক মৌলবাদী তাঁকে কাপুরুষের মতো হত্যা করে। আব্দুল একটি কম্বল গায়ে দিয়ে স্বামীজীর বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসে। স্বামী শ্রদ্ধানন্দের সঙ্গে তাঁর সহযোগী ধর্মপাল ছিলেন। আব্দুল জল খেতে চায়। ধর্মপালজি তাকে জল এনে দেন। আব্দুল জল পান করার পরে ধর্মপাল খালি গ্লাস রাখতে ঘরের মধ্যে আসেন। সেই সুযোগে আব্দুল পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক থেকে গুলি করে হত্যা করে স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে।

এই ঘটনার সময় গুয়াহাটিতে কংগ্রেসের অধিবেশন চলছিল। গান্ধীজী ২৫ ডিসেম্বর স্বামী শ্রদ্ধানন্দের নির্মম হত্যার ঘটনার ওপর শোক প্রস্তাব আনেন। সেদিন তাঁর বক্তব্যে তিনি শ্রীমদ্ভাগবত গীতার বাণী উল্লেখ করে বলেন, হিন্দুরা সকল জীবে ব্রহ্মের অস্তিত্ব বিশ্বাস করে। সেই চরম সহিষ্ণু ধর্মের সাধু মহাত্মাদের বিরুদ্ধে যারা বিদ্বেষ ছড়ান, তারাই প্রকৃত অপরাধী।

আজ ২০২০ সালে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, কে প্রকৃত মানবতাবাদী? আজ এরাজ্যের যেসব কবি, সাহিত্যিক, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, নাট্যব্যক্তিত্ব চুপ করে আছেন, কারণ হিন্দু সন্ন্যাসী গণপ্রহারে মারা গেলে প্রতিবাদ করলে তাঁদের গায়ে সাম্প্রদায়িকতার দাগ লাগবে। তাঁরা ঠিক কাজ করছেন? নাকি রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজীরা ঠিক কাজ করেছিলেন?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.