আমরা অনেকেই ভুলে গিয়েছি তাকে। মেধাবী এই ব্যক্তিটি জীবদ্দশাতেও ছিলেন বড্ড উপেক্ষিত।দারিদ্র্যের কষাঘাতে যখন রাধানাথ কলেজ ছাড়লেন তখন তার একটি চাকরির বড্ড দরকার ছিল। তখন যোগ দিলেন ‘দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভে’র কলকাতা অফিসে গণণাকারী হিসেবে। প্রতি মাসে মাইনে পেতেন মাত্র তিরিশ টাকা। এ পদে নিযুক্ত হওয়া প্রথম ভারতীয় ছিলেন রাধানাথ শিকদার। সে সময় দ্য গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিক সার্ভেতে একটি পদের জন্য সুপারিশ করেন সার্ভেয়র জেনারেল জর্জ এভারেস্টকে। জেনারেল এভারেস্টের তখন গোলকীয় ত্রিকোণমিতি এবং বক্র জ্যামিতিতে দক্ষ একজন গণিতবিদ প্রয়োজন। কারণ এভারেস্টের মূল কাজ ছিল দক্ষিণ ভারত থেকে নেপাল পর্যন্ত যে দ্রাঘিমাংশীয় চাপ রয়েছে তার সঠিক পরিমাপ বের করা। ফলে ঐ অংশের জিওয়েড (Geoid)-এর আকার অনুমান করা যায়।
টাইটলার সাহেবের সুপারিশে তাই রাধানাথকে জর্জ এভারেস্ট লুফে নিলেন। ১৮৩২ সালের ১৫ অক্টোবর রাধানাথ কাজে নিযুক্ত হয়ে চলে গেলেন ভূপালের সেরোঞ্জ বেইজ লাইনে (Serunge Base Line)। সেখানে গিয়ে তিনি জিওডেটিক প্রসেস এর উপর বিশদ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি নিজের আগ্রহেই গণিতের বিভিন্ন বই অধ্যয়ন ও গণিত চর্চা করতে থাকেন।
রাধানাথ শিকদার শুধু জরিপ বিদ্যার অসামান্য পারদর্শিতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা নয় , এক উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্রিটিশ পদাধিকারীকে তিনি এমন ভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন যে তা নিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং বিচারবৈগুণ্যে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন ও তাঁকে জরিমানা করা হয়। । সেই ব্রিটিশ পদাধিকারীর নাম ভ্যানসিটর্ট তিনি ছিলেন দেরাদুনে সুপারিনটেনডেন্ট । জরিপ বিভাগে নিযুক্ত কুলিদের নিয়ে জোরপূর্বক নিজেদের মালপত্র বহন করতো এই সাহেবরা । ১৮৪৩ সালের ৫ ই মে প্রতিবাদী রাধানাথ শিকদার পাহাড়ি কুলিদের নিয়ে অন্যায় ভাবে বহন করানো সেই মালপত্র আটকে দেন। ম্যাজিস্ট্রেট বলেন তোমার কি অধিকার আছে আমার জিনিসপত্র আটকে রাখার। রাধানাথ বাবু বলেন , -‘ just as much as you had impressing and mal treating to convoy your baggage ।
অন্তঃপর রাধানাথ শিকদারকে নানাভাবে হেনস্থা করা হয় । সাহারানপুরের ব্রিটিশ বিচারক হার্ভে স্বজাতীয় ভ্যানসিটার্ট এর হয়ে বিচার সম্পন্ন করেন এবং রাধানাথ শিকদারকে এমন ভাবে দোষী সাব্যস্ত করেন যে পরিস্কার হয়ে যায় ‘ Black nantive ‘ এর অভিযোগ তাঁর কাছে তুচ্ছ । এই ঘটনার মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘ He lost the case but became a kind of her in the eyes of young bengal ।
সেই সময় ইয়ংবেঙ্গলদের নিজস্ব পত্রিকা বেঙ্গল স্পেক্টেটর – এ এই ঘটনার বিবরণ ছাপা হয়েছিল।
রাধানাথ শিকদার দীর্ঘদিন বাংলার বাইরে থাকায় ইংরেজি ভাষায় যেমন দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন, বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে তেমন হয় নি। ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’ ছিল তখনকার একটি নাম করা পত্রিকা। সম্পাদক ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। গভীর তত্ত্ব বিষয়ক রচনা এতে প্রকাশিত হত। কিন্তু এই সংস্কৃত-ঘেঁষা বাংলা ছিল রাধানাথের না-পসন্দ। তার মত ছিল, যে লেখা মেয়েরা বুঝতে পারে না সেটা বাংলাই নয়। তিনি ছিলেন কথ্য ভাষায় রচনা প্রকাশে আগ্রহী। এটার রূপ দিতে তিনি বন্ধু প্যারীচাঁদ মিত্রকে সঙ্গে নিয়ে ‘মাসিক পত্রিকা’ ( ‘অবসরে’ এটি পুরানো দিনের পত্রিকা প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে ) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পরে অবশ্য প্যারীচাঁদ ‘আলালের ঘরের দুলাল’ লিখে প্রসিদ্ধ হয়েছেন। মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে রাধানাথ ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। বাস্তবিকই ‘মাসিক পত্রিকা’য় প্রকাশিত লেখা পড়তে অল্পশিক্ষিত লোকের কোন অসুবিধাই হত না। রাধানাথও এতে লিখতেন। বহু পরে কথ্য ভাষায় গদ্য রচনার যে রীতি চালু হয়েছিল, এটিই হয় ত তার প্রথম পদক্ষেপ।
সৌমেন ভৌমিক