শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালার রীতি শুরু হল কীভাবে? কেন? জানতে হলে, অবশ্যই পড়ুন

শ্রাবণ মাসে শিবের মাথায় জল ঢালার অনেক গল্প ও অনেক কাহিনী। সেসব হয় জনশ্রুতি, নয় পৌরাণিক গোঁজামিল। কেউ বলেন, শ্রাবণ মাসেই নাকি দেবতা ও অসুরদের সম্মিলিত প্রয়াসে সমুদ্রমন্থন হয়েছিল। সমুদ্র থেকে অমৃতের কলস ওঠার আগে উঠেছিল তীব্র হলাহল অর্থাৎ বিষ। সেই বিষ এতটাই তীব্র ছিল যে, তা সমস্ত সৃষ্টিকে নষ্ট করে ফেলার ক্ষমতা রাখত। সৃষ্টিকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসছিলেন শিব, সেই বিষ কণ্ঠে ধারণ করে তিনি ‘নীলকণ্ঠ’ হয়েছিলেন।  তাই বিঘ্ননাশা শিবকে এই সময় বিশেষভাবে অর্চনা করা হয়।

শিব যেমন নিজে বিষ ধারনের কষ্ট সয়ে জীব ও।জগতকে রক্ষা করেছেন, তাই শিবের ভক্তরাও পায়ে হেঁটে কাঁধে বাঁক নিয়ে কৃচ্ছসাধনার মধ্য দিয়ে পুণ্যসলিলে তাঁকে বিশেষভাবে অবগাহন করিয়ে পুজো করেন।

আবার কেউ বা বলেন, পার্বতীর সঙ্গে শিবের বিয়ে হয়েছিল নাকি শ্রাবণ মাসে। ফলে, এই যে নদী থেকে কলসি ভরে জল আনেন ভক্তেরা, বাঁকে-মাথায় বা কাঁখালে—এ আসলে বিবাহের আগে জল সইতে যাওয়ার অনুষ্ঠান। সেই বয়ে আনা জল দিয়ে বর-কনেকে ভক্তেরা মনের মতো করে স্নান করিয়ে দেন। বর তো শিব, কিন্তু কনে কোথায়? কনে পার্বতী বা উমা  হপ্তায় একদিন শিবের সঙ্গে অবস্থান করেন, সোমবার। ‘সোম’ কথার মানেই হল, ‘উমার সঙ্গে শিবের অবস্থান’। তাই সোমবারেই শিবের মাথায় জল ঢালা অর্থাৎ শিবকে স্নান করানোর দিন। এদিন ভক্তেরা শিব-পার্বতীকে একইসঙ্গে স্নান করিয়ে যেমন পুণ্য অর্জনের চেষ্টা করেন, তেমনি পৌরাণিককালে সংঘটিত শিব-পার্বতীর বিয়ের বার্ষিকী পালন করেন, স্নাপন অনুষ্ঠানটি পুণ:চিত্রিত করেন।

এবার আসি বেদ প্রসঙ্গে। বেদে শিবের নাম ‘রুদ্র’। তিনি তখন বজ্রের দেবতা। ফলে, তাঁর অধীনে মেঘ ও বৃষ্টি। বেদের যুগে বেদ-শিক্ষিত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সমাজের বাইরে যে বৃহৎ জনগোষ্ঠী, তাঁদের কাছেও মেঘ ও বৃষ্টির দেবতা হিসেবে ওই দুই শ্রেণির হাত ধরে মহাদেব পৌঁছে গেলেন। বেদের প্রকৃতি ও নিরাকার সাধনা লোকসাধারণের কল্পনা থেকে সাকার রূপ পেল। তাঁরা চোখের সামনে দেখেছিলেন পাহাড় আর পর্বতের শৃঙ্গ।

দেখেছেন শৃঙ্গের দিকে মেঘমণ্ডলকে ধেয়ে আসতে, শৃঙ্গের গা ছুঁয়ে ঝরে পড়তে। তাঁদের মনে হয়েছিল, পাহাড় বা পর্বত আসলে সেই বৃষ্টির দেবতা, যিনি মেঘেদের টেনে এনে বৃষ্টিপাত ঘটান। ফলে শুরু হল রুদ্র হিসেবে সেই পাহাড় বা পর্বতের পুজো।  তারপর একসময় প্রাণের এই দেবতাকে আপনজনের মতো ঘরে ঠাঁই দিতে চাইলেন, যখনই মন চাইবে পুজো করতে চাইলেন। কিন্তু পাহাড়-পর্বত তুলে তো আর ঘরে আনা যায় না। তাই পাহাড় আকৃতির পাথর দিয়ে তৈরি হল ‘রুদ্র’ দেবতার ক্ষুদ্র সংস্করণ, যাঁকে ঘরে অধিষ্ঠিত করা যায়। শিবের এই আদিমস্বরূপটি এখনো বজায় আছে বলেই, তাঁকে ‘আদি দেবতা’ বলা হয়।

পৌরাণিক যুগে ‘আদি দেবতা’ শব্দবন্ধটিকে গুরুত্ব দিয়ে তৈরি হয়ে গেল সৃষ্টির আদিতে অনন্ত শিবের উপস্থিতির উপাখ্যান। যাই হোক, প্রকৃতি নির্ভরতার যুগে প্রকৃতির খামখেয়ালে সময়ে বৃষ্টি না হলে, মানুষের মনে হয়েছিল, যদি শিবরুদ্রের হয়তো ভুল হয়েছে বৃষ্টি আনার কথা, তাঁর মাথায় বারিপাতের মধ্য দিয়ে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত তাঁর অবশ্য কর্তব্যের কথা। এভাবেই হয়তো ধীরে ধীরে শিবের স্নান উপাসনার রীতিটি গড়ে উঠল। এবং তা বর্ষার মরশুমে। আজও বৃষ্টি না হলে, শিবের মাথায় জল ঢালার রীতি এই ভাবনারই সম্প্রসারণ।

শিবের আদি পাহাড়রূপটিকে লিঙ্গরূপ হিসেবে তুলে ধরা কিন্তু পৌরাণিক যুগের কারসাজি। এবং সেখানেও বৃষ্টি ও সৃষ্টিকে প্রজননের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি হয়ে গেল তত্ত্ব। শিবের থানে ভিড় বাড়ল বিবাহউন্মুখ কুমারী আর সন্তানকামী নারীদের।

পার্থসারথি পাণ্ডা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.