আরণ্যকের সত্যচরণের মধ্যে বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-জীবনের সন্ধান

বিভূতিভূষণের জীবন জুড়ে প্রকৃতি ধরা দিয়েছে নানা রূপে। যখন তিনি নৈহাটির অপর পাড়ে প্রসন্ন গুরুমশায়ের পাঠশালায় পড়তে যেতেন, তখন বালক বিভূতিভূষণ প্রকৃতির রূপ সম্ভোগ করেছেন, পথের পাঁচালীর অপুর মধ্যে সেই প্রমাণ রয়েছে। জন্ম হয়েছিল বনগ্রামে। বাবা মহানন্দ ছিলেন স্বভাব গায়ক। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার সময় মহানন্দ তাঁর উদাত্ত কণ্ঠে গান ধরতেন, প্রকৃতি-মানুষে মোহিত হয়ে সেই রস উপভোগ করত। বিভূতিভূষণের শৈশবে সেই প্রকৃতির রস অসামান্যভাবে তার মধ্যে প্রকাশ করেছিল। প্রকৃতির পাশাপাশি তিনি মানুষ দেখেছিলেন। শৈশব-বাল্যের স্মৃতিতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষকে মিলিয়ে দেখার অবকাশ তার কাছে অবশ্যই ছিল। তবে উপাদানের প্রাচুর্য ছিল না। তার সুযোগ হলো কর্মজীবনে পরিপূর্ণ প্রবেশের মধ্যে দিয়ে, ভাগলপুরে। বিভূতিভূষণ পাথুরেঘাটা ঘোষদের জমিদারি ভাগলপুরের এস্টেটের ম্যানেজারি করেছেন ছ’বছর, ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত। এই সময়কাল লেখক বিভূতিভূষণকে পাবার সময়।
এই পর্বেই তিনি গড়ে তোলেন তার আরণ্যক উপন্যাসের পটভূমি। পথের পাঁচালীর অপুর মধ্যে যেমন বিভূতিভূষণের ছায়া পাওয়া যায়, তেমনি আরণ্যকের সত্যচরণ যে আসলে বিভূতিভূষণ তাতে সন্দেহের তিলমাত্র নেই। সেই অর্থে আরণ্যক-কে বিভূতিভূষণের আত্মজৈবনিক পর্ব বলা চলে। ১৯২৪ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত। তার ভাগলপুর বাসকালীন অভিজ্ঞতা। যদিও আরণ্যকের রচনা কাল আরও কিছু পরে, ১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় আরণ্যক। ভাগলপুরের আজমাবাদ, লবটুলিয়া, ইসমাইলপুর, মােহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের প্রান্তসীমা প্রভৃতি স্থানের বর্ণনা এসেছে। সেই বর্ণনা কেবল প্রকৃতিরই নয়, এলাকার অধিবাসীদেরও।‘আত্মজীবন’-এর দর্পণে আমরা দেখি বিভূতিভূষণ লিখেছেন :‘কলিকাতা শহরের হৈচৈ কর্মকোলাহলের মধ্যে অহরহ ডুবিয়া থাকিয়া এখন যখন লবটুলিয়া বইহার কি আজমাবাদের সে অরণ্য-ভূভাগ, সে জ্যোৎস্না, সে তিমিরময়ী স্তব্ধ রাত্রি, ধূধূ ঝাউবন আর কাশবনের চর, দিগ্বলয়হীন ধূসর শৈলশ্রেণী, গভীর রাত্রে বন্য নীল-গাইয়ের দলের দ্রুত পদধ্বনি, খররৌদ্র মধ্যাহ্নে সরস্বতী কুণ্ডীর জলের ধারে পিপাসার্ত বন্য মহিষ, সে অপূর্ব মুক্ত শিলাস্তৃত প্রান্তরে রঙিন বনফুলের শােভা, ফুটন্ত রক্তপলাশের ঘন অরণ্যের কথা ভাবি, তখন মনে হয় বুঝি কোনাে অবসর দিনের শেষে সন্ধ্যায় ঘুমের দোরে এক সৌন্দর্যভরা জগতের স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম, পৃথিবীতে তেমন দেশ যেন কোথাও নাই।
কলকাতায় ছাত্রজীবন আর তার পরবর্তী কর্মজীবনের ইট, কাঠ, পাথরের ঘেরাটোপের বাইরে প্রকৃতি সৌন্দর্যের অপরিমেয়তা তাকে মুগ্ধ করতেই পারে, আর যেমন বাকি পাঁচটা মানুষকে করে। সেই নির্জন, বিচ্ছিন্ন প্রকৃতি কখনও কখনও তার বুকে হাহাকার জাগিয়েছে, একঘেয়েমিতে তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, বারে বারে মনে হয়েছে ছেড়েছুড়ে পালাই। সবই সত্যচরণের জবানে আমরা পেয়েছি। নিজের মনকে তিনি সত্যচরণের নামের আশ্রয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই সত্যচরণ বলছেন :‘শুধু বনপ্রান্তর নয়, কত ধরনের মানুষ দেখিয়াছিলাম।
রাজু পাড়ে, ধাতুরিয়া, ঠাওতাল সাহু, মটুকনাথ পাঁড়ে, যুগলপ্রসাদ, বেঙ্কটেশ্বর প্রসাদ, মুসম্মত কুন্তা, মঞ্চী, রাজা দোবরু পান্না, রাজকুমারী ভানুমতী, মুখের সিও, রাসবিহারী সিংহ, নন্দলাল ওঝা প্রমুখ যে সব চরিত্রের জন্ম দিয়েছেন বিভূতিভূষণ, তাদের নামগুলির অদল-বদল হতে পারে, কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে এই চরিত্রগুলি নিশ্চয়ই সাযুজ্যপূর্ণ। তার আরণ্যকের গদ্যে সত্যচরণ কথোক্ত নায়ক সবাই, আর নায়িকা প্রকৃতিদেবী। খলনায়ক অবশ্য দু’জন আছে— রাসবিহারী ও নন্দলাল।
সত্যচরণের একটি চরম আক্ষেপের কথা বলতেই হয়। জমিদারি সামলাতে গিয়ে এমন অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়, পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয় যা হয়তো সর্বদা প্রকৃতিকে সংরক্ষণ করতে পারে না। বিভূতিভূষণের জীবনের এই আক্ষেপের ছায়া পড়েছিল, তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে তা ধরা দিয়েছে। সত্যচরণও কষ্ট পেয়েছিলেন তার নানাবিধ সিদ্ধান্ত প্রকৃতি-সত্তাকে লাঞ্ছিত করেছে, কিন্তু সেই অসহায়তা ব্যক্ত করে যেতে তিনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি। আসলে প্রকৃতির মাঝে মানুষের যাযাবরত্বকে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন। ঘর বাঁধার স্বপ্ন মানবের শাশ্বত চেতনা। কিন্তু শহুরে মানুষ আর জঙ্গুলে মানুষের প্রকৃতি ভেদে এই চেতনারও যে পরিবর্তন ঘটে সত্যচরণ তার জবানিতে এই বিস্ময় উপলব্ধি করেছেন।
শহরের জীবনযাত্রার বাইরে জঙ্গলের রূপকল্পে জনজাতি জীবনের প্রাত্যহিকতা, সেখানে ঘর-বাঁধার স্বপ্ন আছে। তবে সেই বন্ধন প্রকৃতির রোরুদ্দ্যমানতাকে অতিক্রম করে নয়, ‘নীড় ছোটো ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়ো’র সীমায়িত সংজ্ঞাও সেখানে বদলে যায়, গোটা প্রকৃতি তখন সেই মানুষগুলির কাছে ‘গৃহ’ রূপে ধরা দেয়। কোনও সীমায়িত আবাসস্থল তাদের। ‘বাড়ি’কে সংজ্ঞায়িত করতে পারে না। এখানেই বিভূতিভূষণ আরণ্যক উপন্যাসে তার অনন্যতা দেখিয়েছেন। পথের পাঁচালী’তে অপু যেমন তার শৈশবের প্রকৃতিকে লক্ষ্য করেছিল অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতা নিয়ে, বিভূতিভূষণের আরণ্যক শুধু এতেই আটকে থাকেনি, জগৎ-মানবের সবচেয়ে দরকারি আঙ্গিক তার অর্থনৈতিক বিষয়টিকেও স্বতন্ত্র রপে প্রতিভাত করেছিল, বর্তমান প্রাসঙ্গিকতায় এর গুরুত্বও অনস্বীকার্য। অপুর প্রকৃতি-দর্শন আর সত্যচরণের প্রকৃতি -দর্শনে অবশ্যই ‘প্রকৃতিগত ফারাক আছে, বয়সগত পার্থক্য আছে, কালের সীমারেখা তো আছেই। বিভূতিভূষণের আরণ্যক অবশ্যই আরও একটা কারণে খুব গুরুত্বপূর্ণ, আজকের কালের জন্যও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিষয়টি হচ্ছে বন্যপ্রাণ। মানুষ আর প্রকৃতির যে মেলবন্ধন, নৈকট্য তাতে বন্যপ্রাণের অবদান খুব বেশি। অরণ্যের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়ে যে মানসিক নিবিড়তা বিভূতিভূষণ উপলব্ধি করেছেন, তার বাঙ্য়-ভাব তাকে প্রভাবিত করেছে সন্দেহ নেই কিন্তু যে আবাত্ময়তা নিয়েও তিনি প্রকৃতির সান্নিধ্য আরও গভীরতর ভাবে অনুভব করেছেন, তার মূলে আছে তার বন্য হরিণ-সহ অন্যান্য পশু -পক্ষীর আচমকা সাক্ষাৎ পাওয়া। প্রকৃতির এহেন অবাঙ্গয় সান্নিধ্য তার কাছে। কতটা বাঙ্গয় হয়ে উঠেছিল তার নমুনা পাওয়া যায় এই লেখাতে— ‘তার পর কতক্ষণ ঝোপের তলায় বসিয়া রহিলাম। গাছপালার ফাকে ফাকে চোখে পড়ে সরস্বতী। কুণ্ডীর নীল জল অর্ধচন্দ্রাকারে দুর শৈলমালার পাদদেশ পর্যন্ত প্রসারিত, আকাশ নীল, মেঘের লেশ নাই কোনো দিকে— কুণ্ডীর জলচর পাখির দল ঝগড়া, কলরব, তুমুল দাঙ্গা শুরু করিয়াছে—একটা গম্ভীর ও প্রবীণ মানিক-পাখি তীরবর্তী এক উঁচু বনস্পতির শীর্ষে বসিয়া থাকিয়া থাকিয়া তাহার বিরক্তি জ্ঞাপন করিতেছে। জলের ধারে ধারে বড় বড় গাছের মাথায় বকের দল এমন ঝাক বাঁধিয়া আছে, দুর হইতে মনে । হয় যেন সাদা সাদা থোকা থোকা ফুল ফুটিয়াছে।
প্রকৃতির নিবিড়তা, সান্নিধ্য এভাবেই মানুষ আর বন্য প্রাণের সমারোহ লক্ষ্য। করেছেন সত্যচরণ। বালক অপুর দৃষ্টি তাকে পরিপূর্ণতা শিখিয়েছিল কোনও সন্দেহ নেই, বালকত্বে উপলব্ধির বোধ অপরিণত থাকে, যৌবনের দ্বারপ্রান্তে অরণ্যের প্রকাশে সেই উপলব্ধির বোধকে পরিপূর্ণ করেছিলেন বিভূতিভূষণ, কথা বলা, বোঝা আর না বোঝার চেতনায় চরিত্ররা ভিড় করে এসেছিল স্বতন্ত্র, পূজার বাহনে পবিত্র। বিভূতিভূষণের আরণ্যক সেই উপলব্ধি, আদর্শ, চেতনাকেই পরিস্ফুটিত করে।
অভিমন্যু গুহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.