এই তো আজ চৈত্র সংক্রান্তি। বাসন্তী পূজায় প্রকৃতি কেমন মুখরিত…চলুন কাঞ্চি ঘুরে আসি..সতী পিঠের ২৮ নম্বর পীঠস্থান। যাবেন নাকি?
ওমা অবাক কেন হন? আমি কি রূপকথার কোনো জায়গার নাম বললাম নাকি? কাঞ্চি তো এখানেই আছে। তন্ত্রচূড়ামনিতেও উল্লেখ আছে এই স্থানের। কি হল? আমি বীরদের ভূমি বীরভূমের বোলপুরের মা কংকালীতলা সতী পীঠের কথা বলছি।
বোলপুর মানে রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন কে যতটা বোঝায় ঠিক ততটাই বোঝায় কংকালীতলা বোলপুরকে।
পীঠস্থান বলতে যা বোঝায় তাহল বীরভূম। বীরভূম এর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা পীঠস্থান ।তার মধ্যে তারাপীঠ ,বক্রেশ্বর, নলহাটি ,ফুল্লোরা আবার তেমনি রয়েছে সাঁইথিয়ার নন্দিনী মন্দির আর বোলপুরে রয়েছে কংকালীতলা।
হাওড়া শিয়ালদা থেকে ট্রেনে চেপে বোলপুর স্টেশনে নেবে গাড়ি চেপে পৌঁছে যাওয়ার যায় কঙ্কালীতলায়, দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মতো ।
গ্রাম্য পরিবেশে বোলপুরে জনবসতির ছাড়িয়ে পাকা ধান মাঠ । সেখানে জনবসতি একদম নেই বললেই চলে। আঁকাবাঁকা গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ মন ভুলাতে ভুলাতে চলে গিয়েছে । তারপর একসময় এসে পড়বে লক্ষ্যস্থল ।সামনে রয়েছে শ্মশান, পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে কোপাই নদী । যদিও বর্ষাকাল ছাড়া কোপাই, খোয়াই ,অজয় এদের তেমন জল থাকে না ।
এখন সামনে ফাঁকা মাঠের মাঝখানে আছে কঙ্কালীতলা তীর্থস্থান। সেই মন্দিরের পাশে পাঁচিল ঘেরা একটি জলকুন্ড রয়েছে । দক্ষযজ্ঞে অনাহুত দক্ষকন্যা সতী যখন দেহ ত্যাগ করলেন, যখন সেই সংবাদে দেবাদিদেবের দেহ থেকে কালভৈরব উৎপন্ন হয়ে দক্ষের দাম্ভিক যজ্ঞ পন্ড করলেন , যখন সতীর দেহ নিয়ে মহাদেব তান্ডব নৃত্য করে সৃষ্টি স্থিতি লয় এক করলেন, তখন বিষ্ণু তাঁর ক্রোধ শান্ত করার নিমিত্ত সুদর্শন চক্রকে আদেশ করলেন। তখন চক্র সতীর দেহকে খন্ড করে দিল। প্রতি খন্ড যে যে স্থানে পড়েছিল সেই সেই স্থানে এক একটি সতীপীঠ গড়ে উঠেছিল। প্রতি সতীপীঠ কে রক্ষার নিমিত্ত একজন করে ভৈরবের সৃষ্টি হয়েছিল।
পীঠ নির্ণয়তন্ত্র অনুসারে কংকালীতলায় সতীর অস্থি পরেছিল, সেই কারণে এই পীঠের নাম হয় কঙ্কালীতলা। আবার ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থে লেখা রয়েছে, এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশটি পরেছিল।
জলকুণ্ডে নিমজ্জিত হয়ে আছেন দেবী। এখানে দেবীর নাম দেবগর্ভা এবং ভৈরব আছেন রুরু। মানুষেরা এখানে এসে পূজোর সামগ্রী জলকুণ্ডে উৎসর্গ করে থাকেন ।
এই জলকুণ্ডের সঙ্গে বহু মাহাত্ম্য লুকিয়ে আছে। কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি প্রস্থর খণ্ড আছে, যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই প্রস্থর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়, পরে পূজার পর সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কথিত আছে, কঙ্কালীতলার কুন্ডের সঙ্গে কাশীর মনিকরনিকা ঘাটের সরাসরি সংযোগ আছে। কঙ্কালীতলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানা রকম অলৌকিক ঘটনা।
উল্লেখ্য, কঙ্কালীতলা গুপ্ত তন্ত্রসাধনার জন্য খুবই বিখ্যাত। সাধকদের পাশাপাশি এখানে সারা বছর সাধারণ পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে মেলা বসে । এই তীর্থ ক্ষেত্রটিতে ট্রেনে বাসে গাড়িতে চেপে এমনকি পায়ে হেঁটে বহুদূর অঞ্চল থেকে বহু মানুষ এসে মিলিত হন ।অগণিত মানুষের সমাগম এই মেলায় প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তি তিথিতে হয় ।অজস্র দোকানপাট , গ্রাম্য মেলা তো বটেই … তা হলেও মাটির হাঁড়ি কলসি ,খেলনার দোকান, পূজার দ্রব্য ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় বীরভূমের বোলপুরের বিভিন্ন রকমের কুটির শিল্প জাতীয় জিনিস.. বিশাল জায়গাজুড়ে তাবু খাটিয়ে ভক্তগণ সারাদিন পূজোর কাজ করেন ,রান্নাবান্না করেন, খাওয়া-দাওয়া করেন ।এরপর সন্ধ্যের আগেই বাড়ির দিকে রওনা দেয় ।
পুজো উপলক্ষে বলি হয়। বলি দেবার সময় ঢাকের বাজনা বাজে ও নানা বাদ্যযন্ত্রের ঐকতানের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে । এখানে বসন্তকালেও বেলা বাড়লে করে অন্ধকার নামে ।সারাদিন কোলাহলমুখর মেলা প্রাঙ্গণ জনশূন্য হতে শুরু করে দেয় । সব কোলাহল এর অবসান হতে আর পাশে অবস্থিত মহাশ্মশান একেবারে সুনসান হয়ে পড়ে ।শুধু কোপাই নদী বয়ে চলে আপন গতিতে…
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার মেলা