মানব সমাজের বিকাশ কখনো সরলরেখায় চলে না। তার পথ আঁকাবাঁকা। পথ ঠিক থাকলে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, অনেক পাকদণ্ডি অতিক্রম করতে হলেও সে তার কাঙ্খিত লক্ষ্যে ঠিক এসে পৌঁছবেই , আর পথ ভুল হলে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাবে । নকশালবাড়ি আন্দোলনের ইতিহাসও এর ব্যাতিক্রম নয়।
বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চারঃ
১৯৬৫/৬৬ সাল নাগাদ সদ্য গঠিত CPIM–এর “শিলিগুড়ি গ্রুপ” ৫/৬টা সাইক্লোস্টাইল করা লিফলেট পায় যেখানে আগামী ছয় মাসের মধ্যে তরাই অঞ্চলে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া ছিল। সমগ্র ১৯৬৬ সাল জুড়ে ক্ষেত মজুর/কৃষকরা তীর-ধনুক, রাইফেল প্রভৃতি সংগ্রহ করতে থাকেন। পাশাপাশি পাশের দেশ নেপালের মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সাথে চলতে থাকে যোগাযোগ। ১৯৬৬-র শেষের দিকে কৃষকরা নিজেদের মধ্যে একটি মিটিং করেন।
প্রথম বজ্রপাতঃ
বিগুল কিসান নামের এক ভাগ চাষি কে একদিন একা পেয়ে জোতদারের লোকেরা বেধড়ক মারধর করলো। কিসান কমিটির সভায় বদলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। প্রবল সশস্ত্র প্রতিরোধের মুখে পড়ল জোতদার ও তার ভাড়াটে গুন্ডা বাহিনী। কিসান কমিটির সশস্ত্র বাহিনী জোতদারের জমি দখল নিল এবং তার গোলা লুঠ করলো। সশস্ত্র প্রতিরোধ ছড়াতে শুরু করলো। জোতদাররা প্রতিরোধ করলে কিসান কমিটির সশস্ত্র সেনা সেই প্রতিরোধকে চূর্ণ করতে লাগল। কয়েকজন জোতদার এই লড়াইয়ে খতমও হল। ক্ষেতের পর ক্ষেত লাল পতাকা পুঁতে দখল নিতে থাকল কৃষকেরা।
এই ঘটনার সময় পশ্চিমবঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সরকার এর শাসন চলছে। যুক্তফ্রন্টের অন্যতম শরিক CPIM সশস্ত্র কৃষক উত্থানকে ঠেকাতে বিপ্লবী কৃষক নেতৃত্বকে নিষ্ক্রিয় করার দিকে হাঁটতে শুরু করল তারা। তৎকালীন পুলিশ মন্ত্রী জ্যোতি বসু পুলিশকে দায়িত্ব দিলেন বিদ্রোহকে নিষ্ক্রিয় করবার।
বসন্তের বজ্রপাতঃ
২৩শে মার্চ তারিখে নকশালবাড়ির ঝারুগ্রামে কৃষকরা এক পুলিশ ইন্সপেক্টরকে গুলি করে খুন করে পুলিশের আক্রমণের পাল্টা হিসাবে। ২৫শে মার্চ পুলিশ পাল্টা আক্রমণ করে। বেপরোয়া গুলি চালনায় মহিলা ও শিশু সমেত ৯ জন শহীদ হন। এতে করে কৃষকদের লড়াই আরও ঘনীভূত হয়। জুন মাসে গিয়ে কৃষকরা আরও বেশ কিছু জোতদারদের আক্রমণ করে ও তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু অস্ত্র লুঠ করে। গণআদালত তৈরি করা হয় ও সেখানে জোতদারদের বিচার করা হয় ও শাস্তি বিধান করা হয়। জুলাই মাস অবধি এই কৃষকদের এই লড়াই প্রবাল ভাবে ছড়িয়ে পড়তে থাকে পাশের অঞ্চলগুলিতে বিশেষত খড়িবাড়ি ও ফাঁসিদেওয়াতে। চা বাগানের শ্রমিকেরাও একাধিক ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে কৃষকদের এই লড়াইকে সমর্থন জানায়। ১৯শে জুলাই একটি বিশাল প্যারামিলিটারির দলকে এইসব অঞ্চলে পাঠানো হয় আন্দোলনকে কব্জা করবার জন্য। ব্যাপক ধরপাকড় ও অত্যাচার শুরু হয়। কয়েকশো মানুষ আহত হন এবং হাজারের ওপর গ্রেপ্তার হন। জঙ্গল সাঁওতাল গ্রেপ্তার হন, চারু মজুমদার আত্মগোপন করেন। ত্রিবেণী কানু, শোভন আলি, গোর্খা মাঝি, তিরকা মাঝি প্রভৃতি শহীদ হন।
নকশালবাড়ি চীনের থেকে স্বীকৃতি পেলঃ
২৮শে জুন, ১৯৬৭। পিকিং রেডিও ঘোষণা করে – “A phase of peasants’ armed struggle led by the revolutionaries of the Indian Communist Party has been set up in the countryside in Darjeeling district of West Bengal state of India. This is the front paw of the revolutionary armed struggle launched by the Indian people……” ৫-ই জুলাই ‘পিপলস ডেইলি’-র লিখল, “A peal of spring thunder has crashed over the land of India. Revolutionary peasants in Darjeeling area have risen in rebellion. Under the leadership of a revolutionary group of the Indian Communist Party, a red area of rural revolutionary armed struggle has been established in India….. The Chinese people joyfully applaud this revolutionary storm of the Indian peasants in the Darjeeling area as do all the Marxist-Leninists and revolutionary people of the world.
ইতিমধ্যে কলকাতার কিছু বিপ্লবী যারা CPIM সংশোধনবাদী পথের বিরধিতা করতেন তারা এই কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলতে লাগলেন। কলেজ-স্ট্রিটের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হল, “নকশালবাড়ি অমর রহে”, “খুনে অজয় মুখার্জী পদত্যাগ চাই”। CPIM-এর মধ্যেকার একটি বিপ্লবী অংশ রামমোহন লাইব্রেরী-তে একটি সভা করে “নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সহায়তা সমিতি” নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলে। ভবিষ্যতের CPI(ML)-এর এটিই ছিল নিউক্লিয়াস।
CPIM-এর ভুমিকাঃ
একদিকে পুলিশ ও প্যারামিলিটারি লেলিয়ে দিয়ে কৃষক আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করবার চেষ্টা; অন্যদিকে দলের বিপ্লবী অংশকে বহিষ্কার করা শুরু করল CPIM। বহিষ্কৃত হলেন অসীম চ্যাটার্জি, পরিমল দাসগুপ্ত, অসিত সেন, সুনীতি কুমার ঘোষ, সরোজ দত্ত এবং মহাদেব মুখার্জী। CPIM-এর দার্জিলিং ও শিলিগুড়ি কমিটি ভেঙ্গে দেওয়া হল।
আন্দোলন কিন্তু ছড়াতেই থাকলো। শ্রীকাকুলাম, বীরভূম, দেবরা-গোপীবল্লভপুর, মুশাহারি, লখিমপুর-খেড়ি প্রভৃতি অঞ্ছলে কৃষকদের সশস্ত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ল।
CPI(ML)-এর প্রতিষ্ঠাঃ
• নকশালবাড়ি কৃষক সংগ্রাম সহায়তা সমিতি-র সিদ্ধান্ত নিল একটি All India Coordination Committee of Revolutionaries of the CPI (M) গড়ে তুলবার;
• ১৯৬৭-র ১২ ও ১৩-ই নভেম্বর। সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের বিপ্লবীরা মিলে “All India Coordination Committee of Revolutionaries of the CPI (M)” গড়ে তুললেন;
• মে, ১৯৬৮। “All India Coordination Committee of Revolutionaries of the CPI (M)”-র দ্বিতীয় সভায় কমিটির নাম বদলে করা হল “All India Coordination Committee of Communist Revolutionaries’ (AICCCR)”। সুশীতল রায় চৌধুরী হলেন এর আহ্বায়ক।
• ৮-ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯। AICCCR একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের সিদ্ধান্ত নিল।
• ১৫ ও ১৬-ই মে, ১৯৭০। গার্ডেনরীচের একটি বাড়িতে, প্রবল গোপনীয়তার মধ্যে ৩৫ জন ডেলিগেটের উপস্থিতিতে গড়ে তোলা হল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মারক্সবাদি-লেনিনবাদি)CPI(ML)। এটি ছিল ৭-ম সম্মেলন।
দাবানলঃ
• কলকাতার প্রায় সমস্ত কলেজ-এ নকশালবাড়ির সমর্থনে ছাত্ররা Progressive Students Coordination Committee-র ব্যানারে ছাত্র ইউনিয়নগুলি দখল করে নিল। প্রেসিডেন্সী কলেজ, হিন্দু কলেজের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিদিন রাজপথের দখল নিতে শুরু করল;
• অন্ধ্রপ্রদেশের গুন্টুর মেডিক্যাল কলেজ নকশালবাড়ির আন্দোলনকে সমর্থন করল। গড়ে তোলা হল Naxalbari Solidarity Committee.
• শ্রীকাকুলাম, বীরভূম, দেবরা-গোপীবল্লভ
পুর, মুশাহারি, লখিমপুর-খেড়ি প্রভৃতি অঞ্ছলে কৃষকদের সশস্ত্র লড়াই ছড়িয়ে পড়ল ।
নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনকে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিল, তা সে ধরে রাখতে পারে নি। একাধিক কারন আছে তার। সংক্ষেপে সেগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে।
• তৎকালীন বিপ্লবের স্তর ও বিপ্লবী শক্তির ক্ষমতা সম্পর্কে বোঝাপড়ায় ভুল;
• জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অবস্থা সম্পর্কে ভুল বিশ্লেষণ,
• Subjective Factor সম্পর্কে ভুল বিশ্লেষণ;
• মূল্যায়নের নামে মনীষীদের অপমান ও তাদের মূর্তি ভাঙ্গার রাজনীতি,
• দেশের মনীষী ফেলে “চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান” জাতীয় ভুল শ্লোগানের ব্যবহার;
• ব্যক্তি হত্যার রাজনীতিও এই আন্দোলনের বড় ক্ষতি করেছিল। এ প্রসঙ্গে পরবর্তীতে করা একটি সমালোচনার উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। “All forms of struggle are subordinate to, and are guided by the concrete political line. If the concrete political line deviates from the mass line, the forms of struggle cannot but be otherwise….. So in order to negate the line of annihilation, we have to negate the wrong ideology which is alien to Marxism and its consequential political and organisational manifestations….. The problem is not whether the class enemy will be annihilated or not ….. Rather the problem is, whether the party should adopt the mass line or not …. Every Marxist-Leninist Party must propagate revolutionary violence which may express itself in various forms of struggle; one of which may be annihilation of class enemies.”
• গণআন্দোলন ইত্যাদিতে গুরুত্ব না দেওয়া;
• ছোট সাফল্যকে অতিরিক্ত বড় করে দেখানো;
• যুক্তফ্রন্ট গড়ার ক্ষেত্রে দুর্বলতা;
• ভুল পদ্ধতিতে শহরে গেরিলা আন্দোলন গড়ে তোলা;
• সংগঠনের ভিতর আমলাতান্ত্রিক ঝোঁক।
চারু মজুমদার বলেছিলেন, “”Hundreds of Naxalbaris are smoldering in India……. Naxalbari has not died and will never die.” কিন্তু বাস্তবে কি তাই হয়েছে — একেবারেই নয় । ভারত থেকে বামপন্থী রাজনীতি প্রায় মুছে যেতে বসেছে । CPI(ML) আজ শতধা বিভক্ত, সঠিক পথ আর চিন্তাধারা থাকলে যা কিছুতেই হতো না । আর ৩৪ বছরে বামপন্থার নামে CPIM যা চালিয়েছিল তা আর যাই হোক যে বামপন্থা নয় সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না সেই তারাও আজ মৃত্যুপথযাত্রী ।
আরএসএস আর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি একই সময়ে ১৯২৫ সালে প্রতিষ্টিত হয়েছিল । স্বদেশপ্রেম আর জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করে আজ RSS মহীরুহ হয়ে সারা ভারত ছেয়ে ফেলেছে অপরদিকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দিশাহীনতা , দেশদ্রোহিতা আর স্বদেশী মনীষীদের বদলে সোভিয়েত আর চীনের পদলেহন করতে গিয়ে আজ শতধা বিভক্ত, ধ্বংস হতে আর দেরি নেই ।
তবে নকশাল আন্দোলন যে মেকি বামপন্থী CPIM মুখোশ খুলে দিতে পেরেছিলো এটা অনস্বীকার্য । এটাই সবথেকে বড় প্রাপ্তি ।
সৌভিক বসু