ব্রিটেনে করোনার যে নতুন স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে ঠিক সে রকমই মিউট্যান্ট (জিনগতভাবে পরিবর্তিত) স্ট্রেন ভারতেও চিহ্নিত করা গিয়েছিল মার্চ মাসে। এমনটাই দাবি সিএসআইআরের ইনস্টিটিউট অব জিনোমিক্স অ্যান্ড ইন্টিগ্রেটিভ বায়োলজি (আইজিআইবি)-র ডিরেক্টর ও শীর্ষ বিজ্ঞানী অনুরাগ আগরওয়ালের।
গবেষক বলছেন, ভারতে যে সময় করোনা মহামারী লাগামছাড়া হয়ে গিয়েছিল, তখনই এমন ধরনের সুপার স্প্রেডার স্ট্রেন চিহ্নিত করা গিয়েছিল। বস্তুত, মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে এমন স্ট্রেন ছড়িয়েছিল ভারতেও। তবে করোনার সেই নতুন স্ট্রেন বেশিদূর যেতে পারেনি। গবেষক বলছেন, জুন মাসের মধ্যেই সেই স্ট্রেন নির্মূল হয়ে গিয়েছিল।
সার্স-কভ-২ ভাইরাস বহুবার তার জিনের গঠন বিন্যাস বদলেছে। একাধিক নতুন স্ট্রেন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে। ভারতেও করোনার একাধিক মিউট্যান্ট স্ট্রেনের খোঁজ মিলেছে। আবার দুর্বল স্ট্রেনও খুঁজে পাওয়া গেছে। আইজিআইবি-র ডিরেক্টর অনুরাগ বলছেন, হতে পারে করোনার ওই নতুন স্ট্রেন বেশি মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারেনি সে সময়ে। কোনওভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তাই মাস দুয়েকের মধ্যেই সেই স্ট্রেন পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যায়।
ব্রিটেনে যে নতুন ভাইরাল স্ট্রেন ছড়িয়েছে তার নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.১.৭ ( B.1.1.7) বা VUI–202012/01। গবেষক বলছেন, ১৭টা মিউটেশন হয়েছে এই ভাইরাল জিনে। যার মধ্যে দুটে মিউটেশন বা জিনের বিন্যাসের বদল খুব গুরুত্বপূর্ণ। সার্স-কভ-২ ভাইরাস তার স্পাইক (s) গ্লাইকোপ্রোটিনের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢোকে। ভাইরাসের লিপিড মেমব্রেনের বাইরে ওই খোঁচা খোঁচা স্পাইকগুলিতে দুই ধরনের প্রোটিন থাকে স্পাইক-১ (এস-১) ও স্পাইক-২ (এস-২)। স্পাইক-১ তথা এস-২ প্রোটিনের কাজ হল মানুষের গলা থেকে ফুসফুস অবধি পথে দেহকোষের রিসেপটর প্রোটিন ACE-2 (অ্যাঞ্জিওটেনসিন কনভার্টিং এনজাইম-২)খুঁজে নেওয়া। এই এস-১ প্রোটিনেই আছে রিসেপটর বাইন্ডিং ডোমেন যা মানুষের দেহকোষের রক্ষী প্রোটিনের সঙ্গে যু্ক্ত হতে পারে। আর দ্বিতীয়টি অর্থাৎ এস-২ প্রোটিনের কাজ হল রিসেপটরের সঙ্গে মিলে গিয়ে কোষের ভেতরে ঢুকে পড়া। এই স্পাইক প্রোটিন অ্যামাইনো অ্যাসিড নিয়ে তৈরি। মিউটেশন হচ্ছে এখানেই। স্পাইকে ৬৯ ও ৭০ নম্বর অ্যামাইনো অ্যাসিডের কোডই মুছে দিচ্ছে ভাইরাস। ফলে উড়ে যাচ্ছে জিনের ৬টি বেস পেয়ার। এই ধরনের মিউটেশনকে বলা হচ্ছে N501Y।
ভারতে যে স্ট্রেন খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল তার নাম দেওয়া হয় এ৪ (A4)। অনুরাগ আগরওয়াল বলছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে এই নতুন স্ট্রেন ছড়িয়েছিল। ভারতের দিল্লি, হায়দরাবাদ, কর্নাটকে কোভিড রোগীদের নমুনায় খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সেই স্ট্রেনেরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা ছিল। ব্রিটেনের স্ট্রেনের মতোই ছিল সুপার স্প্রেডার। দেশে করোনাভাইরাসের প্রায় প্রায় সাড়ে চার হাজার জিনোম সিকুয়েন্স করা হয়, যার মধ্যে দেড় হাজারের কাছাকাছি জিনের বিন্যাস বের করা হয় আইজিআইবিতেই। তখনই খুঁজে পাওয়া যায় ওই সুপার স্প্রেডার জিন।
তবে করোনার দুর্বল জিনেরও খোঁজ মেলে ভারতেই। কাউন্সিল অব সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (সিএসআইআর)-এর বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, করোনাভাইরাস এত বার জিনের গঠন বদলেছে এবং এখনও বদলে চলেছে যে তার প্রতিটা স্ট্রেনই একে অপরের থেকে আলাদা। করোনার প্রাণঘাতী ভাইরাল স্ট্রেন সার্স-কভ-২ এখন বিশ্বে অতিমহামারী। এই আরএনএ ভাইরাল স্ট্রেনও বদলে চলেছে ক্রমাগত। দেখা গেছে, এক রোগীর শরীরে যে ভাইরাল স্ট্রেন রয়েছে, তা অন্যের থেকে আলাদা। যার অর্থই হল, এক মানুষের শরীর থেকে অন্য মানুষের শরীরে সংক্রামিত হওয়ার আগেই জিনের গঠন, বিন্যাস বদলে ফেলছে ভাইরাস। কারণ তাকে বেশিদিন টিকে থাকতে হবে। ইনকিউবেশন পিরিয়ড বা বেঁচে থাকার সময়কাল বাড়াতে হবে। তার জন্য দরকার এই পরিবর্তন।
গবেষকরা বলছেন, জিনের গঠন বিন্যাস কতটা বদলাচ্ছে, কী কী পরিবর্তন হচ্ছে সেটা দেখতে গিয়েই বিশেষ একরকমের ক্লাস্টার সিকুয়েন্স খুঁজে পেয়েছেন তাঁরা। ৬৪টি ভাইরাল স্ট্রেনের পূর্ণাঙ্গ গঠন বিন্যাস সাজিয়ে এমন ক্লাস্টার পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ফাইলোজেনেটিক ক্লাস্টারের নাম Clade I / A3i। ভারতীয়দের থেকে নেওয়া ৪১% ভাইরাল স্ট্রেনের জিনোম সিকুয়েন্সে এই ক্লাস্টার পাওয়া গেছে। এর বৈশিষ্ট্য কী? নিশ্চিত প্রমাণ দিতে না পারলেও বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রাথমিক পরীক্ষায় বোঝা গেছে এই ফাইলোজেনেটিক ক্লাস্টার সিকুয়েন্স Clade I / A3i তুলনামূলকভাবে দুর্বল। এই ক্লাস্টারের আবার চারটে ধরন আছে, C6312A (T2016K), C13730T (A88V/A97V), C23929T এবং C28311T (P13L) । এরা প্রত্যেকেই অপেক্ষাকৃত কমজোরি ভাইরাল স্ট্রেন সেখানে মিউটেশন বা জিনের গঠনগত বদল খুব বেশি হয়নি। বিশ্বে যত জিনোম সিকুয়েন্স বার করা হয়েছে এই ভাইরাসের, এখনও অবধি কোথাও এমন ক্লাস্টার পাওয়া যায়নি।