অন্যান্য শহরের তুলনায় কলকাতার বয়েস কিছুই না— এমনকি হাওড়া বা বরাহনগরের জন্ম হয়েছে কলকাতার আগে। কিন্তু কলকাতা এগিয়ে আছে গল্পে, তার অন্দরে-কন্দরে লুকিয়ে থাকা গল্প। এমনকি কলকাতার প্রায় প্রত্যেক বাজারের নামের পেছনে একটা করে গল্প আছে।
যেমন লালবাজার। যার নাম এসেছে লালদিঘি থেকে। আর লালদিঘির নাম? সেখানেও লুকিয়ে আছে গল্প— যার শুরু কলকাতা পত্তনেরও আগে।
আকবর বাদশার আমলে জমিদার লক্ষ্মীকান্ত রায় মজুমদার চৌধুরীর কাছারিবাড়ি ছিল এখানে। সেই আমলে এই তল্লাটে যে দু-একটা পাকা বাড়ি ছিল, তার মধ্যে এই বাড়ি ছিল অন্যতম। এই বাড়িতে লক্ষ্মীকান্ত শ্যামরাইয়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন আর সেই মন্দিরের মূল উৎসব ছিল দোলযাত্রা। সেই সময়ে আজকের কলকাতা অঞ্চলের কিছু কালীমন্দিরের নাম আমরা খুঁজে পাই, কিন্তু নিত্যানন্দের খড়দহ’র দক্ষিণে বৈষ্ণব মন্দিরের উল্লেখ প্রায় পাওয়াই যায় না। হয়তো সেই কারণেই দোলের দিন বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকে এই শ্যামরাইয়ের মন্দিরে উপস্থিত হত, আর উৎসবে মেতে উঠত। রীতিমতো মেলা বসে যেত সেখানে। দূরদূরান্ত থেকে আসা সেই সব মানুষের জন্যে দিঘির পূর্ব পাড়ে পসারিরা বসে যেত ব্যবসা করতে। দোলের আবিরের রঙে দিঘির জল লাল হয়ে উঠত। লোকের কাছে তাই সেই দিঘি হয়ে উঠল লালদিঘি। আর সেই দিঘির পাশের বাজার লালবাজার।
পরে এই কাছারিবাড়ি জোব চার্নক কিনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিস বানিয়েছিলেন। বাড়ির নকশার আমূল পরিবর্তন করলেও শ্যামরাইয়ের মন্দির কিন্তু অক্ষত রেখে দিয়েছিলেন। দোল উৎসব আগের মতোই সমারোহের সঙ্গে পালন করা হত। জোব চার্নকের মৃত্যুর তিন বছর পরে বর্তমান ফেয়ারলি প্লেস আর কয়লাঘাট অঞ্চলে, লালদিঘির পশ্চিম পাড়ে ব্রিটিশরা কলকাতায় তাদের দুর্গ বানাতে শ্যামরাইয়ের মন্দির ভেঙে ফেলল। মন্দির ভাঙলেও সাহেবসুবোদের প্রয়োজনের যোগান দিতে পূর্ব পাড়ের বাজারটা কিন্তু থেকে গেল, আর আজও রয়েছে। সময় বদলেছে। লালবাজার তেমনই থেকে গিয়েছে।
জোব চার্নকের সঙ্গে কলকাতার আরেকটা বাজারের নাম জড়িয়ে আছে। আজকে যেখানে শিয়ালদহ স্টেশন, আজ থেকে সোয়া তিনশো বছর আগে সেখানে এক মস্ত বটগাছ ছিল। সোয়া তিনশোই বা বলি কী করে— একশো ষাট বছর আগে স্টেশন যখন তৈরি হয়, সেই বটগাছ তখনও ছিল। সেইসময়ে আজকের কলকাতার মানচিত্র ছিল একেবারে অন্যরকম— পশ্চিমে হুগলী নদী আর পূর্বে বিস্তীর্ণ জলা-জমি, যা দিয়ে সুন্দরবন আর দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য জায়গায় অনায়াসে যাওয়া যেত। জোব চার্নকের আমলে শিয়ালদা কলকাতার অংশ না হলেও সাহেব এই জায়গাটা বেছে নেন দেশি সওদাগরদের সাথে দেখা করা আর বাণিজ্য করার জন্যে। সাহেবদের এত পছন্দ হয়েছিল জায়গাটা যে সেখানে ‘ব্রেড অ্যান্ড চিজ্’ নামে একটা সরাইখানা অবধি খুলে ফেলে নিজেদের জন্যে। আর দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে এই বটগাছ হয়ে উঠেছিল রথ দেখা আর কলা বেচার জায়গা— গাছের তলায় বিশ্রাম নিত, আর সাহেবদের সঙ্গে ব্যবসার লেনদেন হত। সারাদিন এখানে থেকে ব্যবসা করে বিকেলে সবাই নিজের নিজের গন্তব্যে ফিরে যেত— সাহেব তার কুঠিতে, আর ব্যবসায়ীরা তাদের নৌকোয়। স্বাভাবিকভাবেই এই বটগাছ-সংলগ্ন জায়গার নামকরণ হয়েছিল বৈঠকখানা। আর ব্যবসায়ীদের কেনাকাটার জন্যে যে বাজার গড়ে উঠেছিল, তার নাম ‘বৈঠকখানা বাজার’।
এই বৈঠকখানা বাজার থেকে আধা মাইল দূরে বিশ্বনাথ মতিলাল যখন ১৮৪৪ সালে মারা যাচ্ছেন, সতীদাহ প্রথা নিয়ে আইন পাশ হয়ে গেলেও বাড়ির বাইরে কি ভেতরে তাদের অস্তিত্ব দহন করা হত সবসময়েই। মেয়েরা ছিল নামহীন প্রাণী— ‘অমুকের মা’, ‘তমুকের বউ’ হিসেবেই ছিল তাদের পরিচয়। তাই বিশ্বনাথ মতিলাল যখন একটা বাজার তাঁর এক পুত্রবধূকে যৌতুক দিলেন মৃত্যুর আগে, বাজারটার মালকিনের নাম কেউ জানতে পারল না— বাজারটার নাম শুধু ‘বউবাজার’ হয়ে রয়ে গেল।
বাগবাজার অঞ্চল পুরনো কলকাতার প্রাচীন অঞ্চলদের মধ্যে অন্যতম। বর্তমানের বাগবাজারের পশ্চিমে ডাকাত নন্দরাম প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির, এই শহর পত্তনের অনেক আগে সুতানুটি গ্রামের মন্দির ছিল। কিন্তু ‘বাগবাজার’ নামটা এসেছে অনেক পরে। বর্তমান বাগবাজার অঞ্চলে ব্রিটিশ ধনকুবের ক্যাপ্টেন চার্লস পেরিনের বাগানবাড়ি ছিল। ১৭৫২ সালে তাঁর মৃত্যুর পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সেই জায়গা কিনে নিয়ে এক ওয়াচ-টাওয়ার বসায়, সেইসময়ের ৩৩৮ টাকা খরচা করে। কারণ? নবাব সিরাজদৌল্লা কলকাতা আক্রমণ করবেন, এই খবর তাদের কাছে আগেই পৌঁছেছিল। তাই পশ্চিমে হুগলী নদী আর উত্তরের জলা-জঙ্গলের দিকে নজর রাখতে এই ওয়াচ-টাওয়ার, যাতে নবাবের সৈন্য দেখলে তৎক্ষণাৎ কেল্লায় খবর দেওয়া যায়।
কালীঘাটের তীর্থযাত্রীদের নৌকো পার্শ্ববর্তী ঘাটেই আসত এক সময়। দূরদেশ থেকে নৌকোপথে পৌঁছে দুই-একদিন বিশ্রাম নেওয়া সেই তীর্থযাত্রীদের জন্যে এইখানে একটা বাজার গজিয়ে ওঠে পেরিন সাহেবের বাগানের পাশে। আর সেই বাগান থেকে বাগবাজার। এই বাগবাজারের পাশের শ্যামবাজারের নাম আবার কলকাতার ধনী জমিদার শোভারাম বসাকের গৃহদেবতা শ্যামসুন্দর জিউ’র নাম থেকে এসেছে— এই কথাটাই চালু ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু গত শতাব্দীর শুরুর দিকে প্রকাশিত কলকাতার প্রথম প্রামাণ্য ইতিহাস-লেখক প্রাণকৃষ্ণ দত্ত তাঁর বইতে এই গল্প নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, বর্তমানের শ্যামবাজার অঞ্চলটা শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় নামে এক ব্রাহ্মণের জমি। তিনি সপরিবারে থাকতেন সেখানে। আর তাঁর নাম থেকেই শ্যামবাজার নামটা এসেছে। পুরনো দলিল-দস্তাবেজও প্রাণকৃষ্ণ দত্তের দাবির সপক্ষে। হালের মতামত— শোভাবাজার নামটাও শোভারাম বসাকের নাম থেকে আসেনি। ওই অঞ্চলের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী জমিদার দেব পরিবার কখনোই সেটা মেনে নিতেন না, এমনই মনে করা হচ্ছে। শোভাবাজার নাম নাকি এসেছে সুবাহ্ বাজার, অর্থাৎ সকালের বাজার থেকে। ওই অঞ্চলে হিন্দিভাষীর সংখ্যা দুশো বছর আগেও কম ছিল না।
মানিকতলা বাজারের নাম পাশের মানিক পীরের নাম থেকে এসেছে, এটাই চিরকাল শহরবাসী জানে। কিন্তু কিছু গবেষণাতে এখানেও নবাব সিরাজদৌল্লার নাম চলে এসেছে। নবাব সিরাজদৌল্লা কলকাতা জয় করে শহরের নাম আলীনগরে বদলে মুর্শিদাবাদ ফেরত গিয়েছিলেন— আর শহরের দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত মানিকচাঁদ বসুর হাতে। মানিকচাঁদ বসু যেখানে থাকতেন, পরবর্তীকালে সেই জায়গার নাকি নাম হয় মানিকতলা। এই মতামতটা উড়িয়ে দেওয়া মুশকিল করে দিয়েছেন তারাপদ সাঁতরা তাঁর ‘কলকাতার মন্দির ও মসজিদ’ বইতে, কারণ মানিকতলার প্রথম মসজিদ তৈরি হয়েছে নবাব সিরাজদৌল্লার কলকাতা আক্রমণের অনেক পরে।
কলকাতার বাজারের নামের গল্পের শেষ নেই। হেঁতাল গাছের বন ছিল এক সময়, সেখান থেকে ইণ্টালি। সুন্দরবন একসময় কলকাতার উপকণ্ঠ অবধি ছিল— সেখানকার গুড়িয়া গাছ থেকে গড়িয়া আর সেই উপকারী গাছের কাঠ যেখানে বিক্রি হত, সেই গুড়িয়াহাট আজকের গড়িয়াহাট। এমনকি ডাকাতের নামেও বাজার আছে শহরে। ‘রামলাল’ কসবা-হালতু অঞ্চলের কুখ্যাত ডাকাত ছিল— তার নামে আজকের রামলাল বাজার।
শেষে এক মজার নামবদলের গপ্পো। ভবানীপুরে ‘জগুবাজার’ বা ‘জগুবাবুর বাজার’ নামে কোনও বাজার নেই, যেটা আছে, সেটা যদুবাবুর বাজার। জানবাজারের রানি রাসমণি সাহেবদের কাছ থেকে এক বাগানবাড়ি কিনে তাঁর নাতি যদুনাথ চৌধুরীকে উপহার দিয়েছিলেন। তাঁর বসানো তাঁর নামবাহী বাজার সময়ের সাথে ‘যদুবাবু’ থেকে কী করে যে ‘জগুবাবু’ হয়ে গেল, সেটা সময়ই জানে!
তথ্যসূত্র: Google