বছর দুই আগে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গে একটি আলাপচারিতার কথা এখন খুব মনে পড়ছে।
মুকুল রায় তখনও বিজেপিতে যোগ দেননি। তবে যোগ যে দেবেন তা তখনই এক প্রকার স্থির হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে সেদিন অমিত যে আত্মবিশ্বাস দেখিয়েছিলেন তা সেদিন ওই আলাপচারিতায় উপস্থিত অনেকেরই অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। একজন অতি বিশিষ্ট, অত্যন্ত অভিজ্ঞ সাংবাদিক তো অমিত শাহের মুখের ওপর বলেই দিলেন, যে অমিত কিচ্ছু জানেন না। তিনি পশ্চিমবঙ্গের কিছু বোঝেন না।
আসলে অমিত যেভাবে তৃণমূল তথা মমতা সম্পর্কে নিজের মূল্যায়ন ব্যক্ত করছিলেন, তাতে হাত, কাস্তে ও জোড়াফুলের রাজনীতি দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বাংলার ওই প্রবীণ সাংবাদিকের কাছে বিজেপি সভাপতির বচন অমিতপ্রগলভতা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না।
অমিত হিন্দিতে বলছিলেন, টিএমসি কো উখাড়কে ফেক দুঙ্গা। তাঁর কথার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় তিনি তৃণমূলের মূলোৎপাটন করবেন। আমি, এই অধম প্রতিবেদক সেদিন অমিত শাহের দেড় হাত দুরত্বে বসেছিলাম। জিজ্ঞাসা না করে থাকতে পারলাম না যে অমিত তৃণমূল নিধনের অন্য কোনও উপায়ের কথা ভাবছেন কি না? অন্য কোনও উপায় বলতে ৩৫৬ বা তেমন কিছু কি অমিতের মাথায় রয়েছে? সবটা না বলে ফর্সা, মোটাসোটা, এমনিতে কঠিন তবু দৃষ্টিতে বন্ধুত্বের প্রশ্রয় মাখানো মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, ডু ইউ হ্যাভ এনি আদার প্ল্যান টু… ‘, কথা শেষ করতে না দিয়ে, মনের কথা বুঝে নিয়েই অমিত বললেন, কোয়ি প্ল্যান নেহি হ্যায় ইয়ার, যো হোগা ইলেকসন সে হি হোগা।’
উত্তরটা হজম না হলেও সেদিন আর কথা বাড়াইনি।
এই ঘটনার অনেকদিন পরে মুকুল এলেন বিজেপিতে। নতুন দলে কিছুটা সড়গড় হবার পর একদিন মুকুল রায়কে জিজ্ঞেস করলাম, এই দল নিয়ে তুমি কি করে ঘাসফুল কাটবে? সংগঠন নেই, দলে ভোট বোঝে এমন লোকের সংখ্যা নামমাত্র, ওপর থেকে নিচ অবধি দলটা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত। তার ওপর তৃণমূল থেকে যারা আসছে তারা দলের মধ্যে একঘরে হয়ে রয়েছে। কি করে তৈরি হবে ইলেকসন মেশিনারি?
সুচারু রাজনীতিক, সদা পলিটিকালি কারেক্ট থাকা মুকুল বললেন, ‘সব বাজে কথা। দলে সব ঠিক আছে।’ তারপর একটু থেমে বললেন, ‘এবারের ভোটে সংগঠন, মেশিনারি এসব কিচ্ছু লাগবে না। মানুষকে শুধু নির্বিঘ্নে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সে কাজ নির্বাচন কমিশনের। মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্য ঠিক করে নেবে।’
এই বাক্যালাপও এক বছর আগের। পোড় খাওয়া পলিটিসিয়ান মুকুল হয়তো তখনই মানুষের মন পড়ে নিতে পেরেছিলেন। মুকুল মন পড়তে পেরেছিলেন না পারেননি তা ২৩ তারিখেই স্পষ্ট হবে, তবে চ্যানেলে চ্যানেলে দমাদম করে যে এক্সিট পোল বাজছে তাতে মুকুলের দূরদৃষ্টির সমর্থনই পরিলক্ষিত হচ্ছে।
এক্সিট পোলের বিজ্ঞানে আমার বিশ্বাস থাকলেও তার প্রয়োগে আমার তেমন ভরসা নেই। আজকের উপসংহারে নিজের পর্যবেক্ষণটুকু পাঠকদের কাছে নিবেদন করা ছাড়া আমার আর তেমন কিছু করার নেই।
অমিতের প্রত্যয় ও মুকুলের দূরদৃষ্টি ছাড়াও আরও অনেক সুক্ষাতিসুক্ষ ইস্যু এই নির্বাচনের অন্তরালে কাজ করেছে।
মমতার সীমাহীন সংখ্যালঘু তোষণ, বলা ভাল তাঁর সংখ্যালঘু প্রেমের নাটুকে প্রদর্শনী ক্রমশ সংখ্যাগুরু অংশকে বিরক্ত করে তুলেছে। দুর্গা পুজো, সরস্বতী পুজোর মতো আবেগপ্রবণ ইস্যুতে মমতার পক্ষপাতিত্ব সংখ্যাগুরু অংশকে ভাবাতে বাধ্য করেছে এই সরকার তাদের নয়। এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো, মমতার তথাকথিত সংখ্যালঘু প্রেম নেহাতই ভোটমুখী তোষণ বলেই মনে করেছে সংখ্যালঘুদেরই একটা বড় অংশ। এই নাটক ধরা পড়ে গেছে যখন রামনবমীর বড় মিছিল দেখে তৃণমূলও ভোট বড় বালাই বলে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে রামনবমীর মিছিলে। সংগঠিত হিন্দু আবেগের চাপে পড়ে বাপ বলতে সময় নেয়নি তৃণমূল। তাছাড়া তোষণ দিয়ে যে উন্নয়ন হয় না সে কথাও অনুধাবন করেছেন সচেতন সংখ্যালঘু মানুষ। সিপিএম থেকে বিজেপিতে আসা মাফুজা বিবি কিংবা তৃণমূল থেকে আসা কাসেম আলির মতো নেতা নেত্রীরা নিরন্তর নিজের কম্যুনিটিকে এই কথাগুলো বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
তবে একথা ঠিক, সঙ্ঘ হিন্দু লাইনে ভোট করারই পক্ষপাতী ছিল। তবে হিন্দু লাইন বললেই আপাত ভাবে মানুষ যা বোঝেন, সঙ্ঘ তা বোঝে না। সঙ্ঘের বিচারে এদেশে জন্মানো, বংশ পরম্পরায় এদেশে থাকা মুসলিমরাও হিন্দু। দারিদ্র্য সীমার নীচের বসবাসকারীদের জন্যে কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পে যাঁরা উপকৃত হন বা হবেন তাঁদের বেশির ভাগই মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও মুসলিম সমাজকে ভোট ব্যাঙ্ক হিসেবে বারংবার কাজে লাগাবার পরেও, তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকারগুলির শাসনে তাঁদের এখনও দারিদ্র্য রেখার নীচেই রয়ে যেতে হয়েছে।
যাই হোক, তাদের মতো করে হিন্দু লাইনে ভোট করে পশ্চিমবঙ্গে এবার যে ভোট হয়েছে তা আগে কখনও হয়নি। হিন্দু ভোট বহুলাংশে সংগঠিত হয়েছে। এই সংগঠিত হওয়ার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা যাঁরা খুঁজতে যাবেন তাঁদের ভ্রান্তিবিলাসের প্রতি করুণা জানিয়ে বলি, পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের এ হেন প্রবণতায় আত্মমর্যাদায় আঘাত পাওয়ার ব্যথা আছে, নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষার তাগিদ আছে, সাম্প্রদায়িকতা নেই। এই মাটিতে পাশাপাশি বিসর্জন ও তাজিয়া যাওয়ার ইতিহাস আছে, স্কুলের সরস্বতী পুজোতে হিঁদুর ছেলে তার মোছলমান বন্ধুর সঙ্গে ভাগ করে খিচুড়ি ভোগ খায়, এমন ঐতিহ্য আছে। খুশির ঈদে আলমের বাড়ি পেট পুরে বিরিয়ানি সাঁটিয়ে আসে অমল, এটাই এই মাটি।
কোন স্বার্থে, কাদের প্ররোচনায় মমতা এই স্বাভাবিক সম্পর্কে জটিলতা এনেছেন তা তিনিই বলতে পারবেন। তবে এবারের ভোটে মানুষ উত্তর দিয়েছে। হিন্দু ভোট ব্যাপকভাবে সংগঠিত হয়েছে। এমন যে হচ্ছে বিচক্ষণ মমতা আগেই টের পেয়েছিলেন। জয় শ্রীরাম ধ্বনির বিরুদ্ধে তাঁর খড়গহস্ত হয়ে ওঠা অকারণে নয়। তিনি তখন হিন্দু ভোটের আশা ছেড়ে মুসলিম ভোট দিয়েই এ যাত্রা উতরে যেতে চাইছিলেন। ভোট পর্বের মাঝামাঝি তৃণমূলের প্রধান ভরসা হয়ে ওঠে মুসলিম ভোট আর গত লোকসভায় প্রাপ্ত সিপিএমের ভোট। সিপিএমের আগের ভোট অক্ষত থাকলে ভোট কাটাকাটিতে মমতার স্বস্তি। শেষ পর্যন্ত সে গুড়েও ঢুকেছে বালি। বিভিন্ন মুসলিম মহল, বিজেপি সম্পর্কে তাদের মনের দ্বিধা এখনও পুরোপুরি না কাটলেও তাঁরা বলছেন, ঘর পোড়ে পুড়ুক আগে তো ছারপোকা মারি। তৃণমূলের মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কও ভেঙেছে। কিছুটা গেছে বাম ও কংগ্রেসে আর কিছু গেছে বিজেপিতে। বাকিটা এখনও আছে তৃণমূলের ঘরে।
বামের ভোট বা কংগ্রেসের ভোটও গেছে বিজেপিতে। ২০১১-তে মমতা যে ভাবে বাম বিরোধী সব শক্তিকে একত্রিত করেছিলেন, এবার সেই কাজটি গোপনে করেছেন মুকুল। তৃণমূল, বলা ভাল মমতা বিরোধী সব শক্তিকে একটি সমাবেশ বিন্দুতে দাঁড় করিয়েছেন মুকুল। রাজ্যের প্রেক্ষিতে বিজেপি নয় বরং তৃণমূলই যে তাদের বড় শত্রু এই কথা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন মুকুল। স্বাভাবিক ভাবেই মুকুল রায় কিংবা সোমেন মিত্র অথবা বিমান বসু, কেউই এই কথা স্বীকার করবেন না। তবু আমার পর্যবেক্ষণটুকু পাঠকদের জানালাম।
মোদি-রাহুলের যতই বৈরিতা থাক, প্রাদেশিক দলগুলির অবলুপ্তির প্রয়োজনীয়তা তাঁদের দুজনেরই কাম্য। এবারের ভোটেই কংগ্রেসের প্রবীন নেতা ও সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরীকে আমরা বলতে শুনেছি, ‘যাদের আমার ওপর রাগ আছে তারা বিজেপিকে ভোট দিন।’ আবু হাসেম বা ডালুবাবুর কথা থেকেই পরিস্কার রাজ্য কংগ্রেসের অবস্থানটা ঠিক কি। সেদিক থেকে সিপিএম অনেক সজাগ ও সদা সচেতন। বিপক্ষকে বা দলের কর্মী সমর্থকদেরও তারা সুযোগ দেয়নি কৌশল বুঝে নেবার। দমদমে একটি ঘটনা নিয়ে হইচই হয়েছে ঠিকই কিন্তু ততক্ষণে বল মাঠের বাইরে।
অনেকদিন আগে লিখেছিলাম রাজ্যে বিজেপি ষোলো থেকে তেইশটা আসন পাবে। এখন সংখ্যাটা একটু হেরফের করে বলতে পারি বিজেপি উনিশ থেকে পঁচিশটা আসন পাবে। এর কিছু কম বা কিছু বেশি হতে পারে।
কংগ্রেস তিন থেকে ছ”টি আসন। বামেরা দুটি। তবে এক্ষেত্রে দুটি কথা আছে। কংগ্রেসের বহরমপুর, জঙ্গিপুর তো আছেই এবারে শোনা যাচ্ছে যোগ হতে পারে মুর্শিদাবাদও। না হলে মুর্শিদাবাদ জেলায় দুটি নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে সোমেন-অধীরকে। অন্যদিকে মালদায় দুটিতেই তৃণমূল হারলেও মৌসমের কেন্দ্রে কংগ্রেস না বিজেপি কে জিতবে তা নিয়ে কিছু সংশয় আছে। রায়গঞ্জে কংগ্রেসের আশা ক্ষীণ।
যাদবপুর আর ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রতে স্ট্র্যাটেজিকালি সিপিএমের সম্ভাবনা আছে (যে স্ট্র্যাটেজির কথা আগে বলছিলাম)। তবে ডায়মন্ডহারবারের একটি বিশেষ জায়গায় শেষ কয়েকদিন ধরে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের যে খবর এসেছে তাতে দু’রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে। হয় গোটা কেন্দ্রের হিন্দু ভোটারের একটি বড় অংশ ভয় পেয়ে যাবে নইলে তারা সংগঠিত হয়ে বিজেপিকেই ভোট দেবে।
ফলতঃ বামেদের আসন ঠিক একটি না দুটি, নাকি খাতা খুলবেই না বাম, এই মুহুর্তে বলা কঠিন।