মস্করার যোগান দিচ্ছেন মমতা। রাম নামে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে ও ভঙ্গিমায় প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে চায়ের ঠেক, লোকাল ট্রেন বাস মেট্রোতে যা শুরু হয়েছে তা এক কথায় খিল্লি।
মমতা যা করছেন তাতে হাসির উপাদান আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু বিষয়টি এখানেই শেষ নয়।
পাড়ায় পাড়ায় যেমন একজন করে ‘ফোফটলাল’ কিংবা ‘কাকা দা’ থাকে, ছেলেরা তাকে ক্ষ্যাপায়, সে ক্ষেপে তেড়ে আসে, ছেলেরা পালায়, আবার যেই সে চলে যায় অমনি আবার ছেলেরা নেমে পড়ে রাস্তায়।
ছাতামাথায় হনহনিয়ে হেঁটে যাওয়া বৃদ্ধের কাছে গিয়ে ডাকে ‘ও কাকা দা’। ব্যস আর দেখে কে! বৃদ্ধ ছাতা উঁচিয়ে তেড়ে গিয়ে বলবেন, কাকা আবার কখনও দাদা হয় নাকি রে…! বলেই চার অক্ষর পাঁচ অক্ষরের বন্যা শুরু করে দেবেন!
এমনিতে শান্ত। হাঁটু অবধি ধুতি আর ফতুয়া পরে বিকেল বেলা পাড়া বেড়াতে বেরোনো মেজদা। চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালে কেউ না কেউ সম্মান দেখিয়ে বলবেই মেজদা একটু চা চলবে তো? মেজদাও সরল হাসি হেসে দাতার দান নিজের বয়সোজনিত প্রাপ্তি ধরে নিয়েই গ্রহণ করবেন। তারপর মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল, পিকে-অমল, কংগ্রেস-সিপিএম, বিধান রায়-জ্যোতিবাবু,ঘটি-বাঙাল এমনকি আমেরিকা-রাশিয়া-চিন সব এক ভাঁড় চায়ে একটি বিস্কুট সহযোগে চুমুক দিয়ে মেজদা যখন উঠবেন, তখনই চায়ের দোকানের পিছন দিক থেকে কেউ না কেউ বিকৃত গলা করে বলবেই, ‘ফোফটলাল’। ব্যস আর যায় কোথায়? মেজদার খিস্তির তোড়ে তখন বিধান রায় আর জ্যোতিবাবু হাত ধরাধরি করে আতঙ্কিত মুখে অলক্ষে দাঁড়িয়ে!
মমতার ‘রামাতঙ্ক’ দেখে এইসব গপ্পোই এখন রসিয়ে আওড়ানো হচ্ছে সিসিডি থেকে শুরু করে বাপি টি স্টল পর্যন্ত।
সাংবাদিক, লেখক, যিনি বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন হাওড়া কেন্দ্রে, সেই রন্তিদেব সেনগুপ্তও শুনিয়েছেন জনৈক লক্ষ্মণদার কথা। নতুন নতুন রিপোর্টারি করতে এসে রন্তিদেব আর তাঁর সতীর্থরা একটি ফোন নম্বর পেয়েছিলেন। নাইট ডিউটি থাকলেই দুষ্টুমি বুদ্ধি জাগত আর তাঁরা ফোন করতেন ওই নম্বরে। বিনি পয়সায় খিস্তি খাওয়ার নম্বর। ফোন করে শুধু বলতে হবে, লক্ষনদা জেনারেটর ভাড়া পাওয়া যাবে? বলা মাত্রই ওপার থেকে লক্ষনের ‘শেল’!
তবে দিনের শেষে বিষয়টা এতটা সহজ বলে আমার অন্তত মনে হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে ওঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতীতে যে বা যারা তাঁকে ছোট করে দেখেছে তাদেরই পস্তাতে হয়েছে।
একথা ঠিক মোদি-অমিতের মজবুত জুটি। তার সঙ্গে কৈলাস-মুকুল মিলে যে চতুঃশক্তি তাঁর বিরুদ্ধে তৈরি হয়েছে তাতে মমতা বিস্তর চাপে, তিনি খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন, সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তবে ভুললে চলবে না প্রতিকূল পরিস্থিতিকে নিজের অনুকুলে নিয়ে আসার সহজাত প্রতিভা মমতার আছে। এর প্রমাণ তিনি আগেও দিয়েছেন। পাশা উল্টে দিতে মমতা যেকোনও রকম উপায় অবলম্বন করতে পিছপা হবেন না। তা সে উপায় যেমনই হোক না কেন। এ কথা আর কেউ অনুধাবন করুন বা না করুন মুকুল রায় ভালভাবেই জানেন। যে কোনও রকম উপায় অবলম্বনের যে সম্ভাবনা আছে সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই দিয়েছেন মমতা। বলেছেন, আর বদল নয় এবার বদলা। যদিও এতদিন বদল কি হয়েছে তেমন বোঝা যায়নি। তবে এবার মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত অবস্থান—বদলা। সেই বদলা কেমন ভাবে, কোন দিক থেকে আসবে তা স্পষ্ট আন্দাজ হয়তো এখনই সম্ভব নয়, তবে ১৮ সাংসদ খুইয়েছেন ব’লে মমতা ব্যাট বল গুটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যাবেন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
আর একটা কথাও মনে রাখা জরুরি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একমাত্র ট্রেড-মিল ছাড়া আর যখনই হাঁটেন রাজনীতির পথেই হাঁটেন। তিনি যে বারংবার জয় শ্রীরাম ধ্বনিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, এমনকি মৃদু অশালীন শব্দও তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে, তিনি তেড়ে যাচ্ছেন, রামনামকে গালিগালাজ বলে অভিহিত করছেন, এমনকি শ্রীরামের জয়ধ্বনি দেওয়ার ‘অপরাধে’ তাঁর পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতারও করেছে, এসবই তাঁর হঠকারিতা বা পরাজয়ের ভয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বলে যাঁরা ভাবছেন, তাঁদের আরও একবার ভেবে দেখার অনুরোধ করব।
এই বাজারেও মমতার ভোট শতাংশে বেড়েছে। সেই শতাংশে খানিকটা প্রক্সির জল আছে বলে অনেকে মনে করলেও সেখানে কংগ্রেস ও সিপিএমের মুসলিম ভোটও আছে। সেই ভোটের ওপর মমতা অবশ্যই ভরসা করছেন। করারই কথা। কিন্তু প্রশ্ন হল রামনামের প্রতি খড়গহস্ত হয়ে তিনি কোন শ্রেণির সংখ্যালঘুকে খুশি করতে চাইছেন? নিশ্চয়ই ধর্মপ্রাণ আটপৌরে মুসলিম সমাজকে নয়। তাহলে কাদের? রামনামের উগ্র বিরোধিতা করায় কারা খুশি হন? এই প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে আশঙ্কা।
সুতরাং খিল্লি নয়। সব সচেতন মানুষের সাবধান হবার সময় এসেছে। যদি কারও ইচ্ছে হয় জয় শ্রীরামের পাশাপাশি বলুন না, নারা এ তকদির, বলুন ওয়া গুরু কি ফতে ,বলুন আলেলুইয়া।
দোহাই রাজনীতির শিকার হবেন না।