হীরকরাজের যে সর্দার পণ্ডিতের পাঠশালা বন্ধ করতে এসেছিল, সে ঠিক এই আপ্তবাক্যই উচ্চারণ করেছিল। বড় সত্যি কথা! পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার ক্ষেত্রে বারবার সত্যজিৎ রায়ের ছায়াছবির ওই দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অথচ একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটাই হল স্কুলের শিক্ষা। ড. এপিজে আব্দুল কালাম রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তাঁর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অঙ্কের শিক্ষককে নিমন্ত্রণ করে ডেকে এনেছিলেন। এমন গ্রামের কত অঙ্কবিদ স্যার কত শতসহস্র ছাত্রছাত্রীর মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন, সেই ছাত্র হয়তো কালামের মতো জগৎবিখ্যাত হয়নি, কিন্তু তাঁর শেখানো অঙ্ক দিয়েই নিজের পায়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে।

এই রাজ্যে স্কুল শিক্ষা আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। এবছর টানা দু’মাস গরমের ছুটি। সব সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের জন্য শিক্ষামন্ত্রী ছুটি ঘোষণা করলেন একেবারে ৩০ জুন পর্যন্ত। এবছর নাকি ভীষণ গরম পড়বে। মুখ্যসচিব যে নির্দেশে ছুটি দিয়েছেন তাতে ঘূর্ণিঝড় ফণী আর আসন্ন দাবদাহের কথা আছে। মজার ব্যাপার হল রাজস্থানের মরুপ্রান্তরে ২০১৬ সালের ২০ মে ৫১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা উঠেছিল। সেখানকার স্কুলগুলিতে সর্বাধিক ১৬ মে থেকে ২৪ জুন ছুটি দেওয়া যাবে বলে ঘোষণা হয়েছে। দিল্লিতেও গতবছর ৪৪ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল পারদ। দিল্লি সহ উত্তর ভারতের জন্য কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের ছুটি ১০ মে থেকে ১৮ জুন। ব্যতিক্রম কেবল পশ্চিমবঙ্গ।

ব্যতিক্রমের কারণ হিসেবে অনেকে ধর্মীয় পক্ষপাতের কথা বলছেন। এবছর ৫ মে থেকে রমজান মাস শুরু আর শেষ হবে ৪ জুন। এগিয়ে আনার তো একটা কারণ পাওয়া গেল। কিন্তু পিছিয়ে দেওয়াটার? গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় মিড–ডে মিল পরিকল্পনায় ১২,০৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। যে এক মাস গ্রীষ্মের ছুটি বৃদ্ধি হল এই এক মাসের জন্য প্রাপ্ত বিপুল অর্থ কোন খাতে ব্যয় হবে? এর উত্তর কে দেবেন? শিক্ষামন্ত্রী? জেলাশাসক? ডিআই সাহেবরা? নাকি কেউই দেবেন না!

এমনই বহু প্রশ্ন স্কুল শিক্ষাকে নিয়ে। কিন্তু স্কুলে প্রশ্ন করার কেউ নেই। গণতান্ত্রিক উপায়ে যে বিদ্যালয় পরিচালন সমিতি গঠিত হত, তা তুলে দেওয়া হয়েছে গত কয়েকবছর ধরে। এখন সরকারি ‘স্পনসর্ড স্কুল’, তাই রাজ্য সরকারের প্রতিনিধি, বিধায়কের পাঠানো অভিভাবক সদস্য, দলের পছন্দের ডাক্তারবাবু আর স্কুল শিক্ষকদের নিয়ে কমিটি। এই কমিটিরই ”রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান”–এর লক্ষ লক্ষ টাকা খরচের ভার। এই সমিতির হাতে প্রধান শিক্ষক/শিক্ষিকা প্রকারান্তরে দলদাস। এক এক করে থেঁতলে যাচ্ছে স্কুলকে ঘিরে সব অনুভুতি/ভালোবাসা। এরাজ্যের বহু শতবর্ষের পুরাতন, সার্ধশতবর্ষের বেশি ঐতিহ্যবাহী স্কুলের রঙ বদলে নীল–সাদা করতে হয়েছে। প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকার দলদাসত্ব ফুটে উঠছে স্কুলের সর্বত্র। তাই ঐতিহ্যমণ্ডিত স্কুলগুলোতে হেডস্যার বা বড়দি’র প্রতি যে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ভয় ছিল তা উবে গেছে।

এবছর মাধ্যমিক পরীক্ষাতে এমন একটা দিন যায়নি যেদিন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। টেট পরীক্ষা নিয়ে প্রহসন হয়েছে। স্কুল সার্ভিস দিয়ে সফল শিক্ষকদের শাসকদলকে নজরানা দিয়ে স্কুলে ঢুকতে হয়েছে। যেখানে বাংলা ভাষার শিক্ষক প্রয়োজন সেখানে উর্দু শিক্ষক পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় মানুষ প্রতিবাদ করাতে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় সফল ৪০০ জন যুবক যুবতী কলকাতায় দিনের পর দিন অনশন করেছেন। কারওর দূরারোগ্য অসুখ করেছে, কারওর নষ্ট হয়ে গেছে গর্ভের সন্তান। কিন্তু এদের নিয়ে কোনও এগিয়ে থাকা সংবাদ মাধ্যম ঘণ্টাখানেকের প্রোগ্রাম করে উঠতে পারেনি।

আজ সরকারি স্কুলের শিক্ষা নিয়ে কোনও সেলিব্রেটি বুদ্ধিজীবী, প্রতিবাদী কবি, বিশ্বমানের বাংলা সংবাদমাধ্যমের কোনও স্তম্ভ লেখকের মাথাব্যথা নেই। সরকারি স্কুল দু’মাস কেন চার মাস বন্ধ হলেও কিছু যায় আসে না। কারণ যারা ‘উন্নয়ন’–এর পক্ষ নিয়ে মুখে রুমাল বেঁধে রাস্তায় দাঁড়াবে বা সিন্ডিকেটের দায়িত্ব নেবে, তারা যত কম স্কুলে যাবে ততই সুবিধা। ওরা যত পড়বে তত জানবে আর যত জানবে তত কম মানবে।

জিষ্ণু বসু

মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

লেখকসাহা ইনস্টিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ কর্মরত। বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.