গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে একটা অরাজকতা চলছে। হানাহানি রক্তারক্তি, খুনখারাপি, গণ্ডগোল, গৃহদাহ, দলীয় অফিস ধ্বংস ইত্যাদি চলছে অবাধে।
এই নিয়ে রাজ্যবাসী অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। রাজ্যের প্রধান শাসক রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠী তিতিবিরক্ত হয়ে ক্ষোভ ও উত্মা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এই ব্যপারে কেন্দ্রের কাছে তার রিপোর্টও পাঠিয়েছিলেন।
এতে অবশ্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও শাসক দলের নেতাদের অনেকেই ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। তাঁদের মতে, এভাবে রাজ্যপাল তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারেন না, এতে যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিও নাকি লজ্জিত হয়েছে।
অবশ্যই অজ্ঞতা থেকে ভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। এবং ভ্রান্তি এনে দেয় প্রতারণার রাজনীতি। সংবিধানের মলাট উল্টে একটু দেখলেই জানা যাবে যে, রাজ্যপালের কাজ শুধু রাজভবনে থাকা-খাওয়া-শোওয়া নয়।
আসলে, রাজ্যপাল রাজ্যের প্রধান। সংবিধানের ১৫৪ (১) নং অনুচ্ছেদে আছে—“The exceutive power of the state shall be vested in the Governor। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী নন— রাজ্যপালই হলেন রাজ্যের শাসনকর্তা। তিনি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজ্যশাসন করতে পারেন।
তাছাড়া ১৫৯ নং অনুচ্ছেদ জানিয়েছে যে, শপথ গ্রহণের সময় তিনি ঈশ্বরের নামে বা বিবেকের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন তিনি সংবিধান ও আইনকে রক্ষা করবেন (‘preserve, protect and defend’) 478 রাজ্যবাসীর কল্যাণের (‘wellbeing’) জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবেন। সুতরাং তার দায় রাজ্য-মন্ত্রীসভার কাছে নয়— তিনি সংবিধান, আইন ও জনকল্যাণকেই গুরুত্ব দিতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে যদি তার মনে হয়। মন্ত্রীসভার কোনো নীতি বা কাজ সংবিধান, আইন বা জনকল্যাণের পরিপন্থী, তাহলে তিনি সেই বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন, বাধাও দিতে পারেন চরম অবস্থায়।
এই ব্যাপারে আরও একটা কথা মনে রাখতেই হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে। সংবিধানের ৭ (১) নং অনুচ্ছেদ জানিয়েছে। তাঁকে পরামর্শ দেওয়া ও সাহায্যকারী (to aid and advise) মন্ত্রীসভা থাকবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে। কিন্তু তিনি এই পরামর্শ ও সাহায্য নিতে বাধ্য কিনা, সংবিধান সেই বিষয়ে ছিল নীরব। তবে সংসদীয় ব্যবস্থায় সাধারণত রাষ্ট্রপ্রধান তার ক্যাবিনেটের পরামর্শেই চলেন। তাছাড়া ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধন উক্ত অনুচ্ছেদকে ভিন্ন রূপ দিয়েছে—রাষ্ট্রপতির ওপর চাপানো হয়েছে বাধ্যবাধকতা।
কিন্তু রাজ্যপালের ক্ষেত্রে এই ধরনের সংশোধন আনা হয়নি। আরও বড়ো কথা— ১৬৩ (১) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেরাজ্যপাল যেসব বিষয়ে তার স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা প্রয়োগ করবেননা, সেইসব ক্ষেত্রেই মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা ক্যাবিনেট থাকবে তাকে সাহায্য করা ও পরামর্শ দেওয়ার জন্য। সুতরাং বলা যায়— রাজ্যপালকে কিছু স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে—সেক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের কোনও ভূমিকাই নেই। বিশেষ করে এগুলো নির্দিষ্ট বা লিপিবদ্ধ করে দেওয়া হয়নি, বরং ১৬৩ (২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে— কোনগুলো তার স্বেচ্ছাধীন। ক্ষমতা, এই প্রশ্ন উঠলে তাঁর কথাই হবে চূড়ান্ত।
সুতরাং বলা যায়— রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা না থাকলেও রাজ্যপালের আছে। এই কারণে ড. বি. সি. রাউত মনে করেন, তাঁরা ওই ক্ষমতা বুঝিয়ে দিতে পারে 67, “The Governor is not a mere figurehead।কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি একটা প্রথম ভূমিকা নিতেই পারেন— ‘he is expected to exercise this discretionary powers’— (ডেমোক্র্যাটিক কস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২২২)। ড. পাইলির ধারণা প্রায় সব রাজ্যপালই নিম্নলিখিত ক্ষমতা এভাবে চাইবেন—
(১) জটিল অবস্থায় মুখ্যমন্ত্রীর নিয়োগ।
(২) মন্ত্রীসভার পদচ্যুতি।
(৩) বিধানসভা ভেঙে দেওয়া।
(৪) মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তথ্য জানা।
(৫) বিলে ভেটো দেওয়া বা সেটা রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো।
(৬) অর্ডিনেন্সে স্বাক্ষর দেওয়ার আগে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরামর্শ করা।
(৭) জরুরি অবস্থা জারির জন্য রাষ্ট্রপতিকে রিপোর্ট দেওয়া।
(৮) অসমের ক্ষেত্রে বিশেষ অধিকার যোগ করা।
তাঁর মতে, রাজ্যপাল আদৌ নামমাত্র শাসক নন। এই ধরনের ব্যাপক ক্ষমতা আছে বলেই তিনি একটা ‘vital role’ পালন করতে পারেন (অ্যান্ ইট্রোডাকশন টু দ্য কস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২০৪-৫)।
তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞ দুর্গাদাস বসু মনে করেন, রাজ্যপাল কতকগুলো নির্দিষ্ট বিষয়ে স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা ভোগ করেন—তা নয়, সেটা নির্ভর করে according to circumstances– (ইন্ট্রোডাকশান টু দ্য কস্টিটিউশান অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২১০)।
একটা কথা মনে রাখতেই হবে। সংবিধানের মুখ্য রচয়িতা- ড. বি. আর. আম্বেদকর সংবিধানের শেষ দিকে একটা অধ্যায় রেখেছিলেন, তার শিরোনাম ছিল ‘Instrument of Instructurs’। সেটাতে ছিল রাষ্ট্রপতি ও রাজ্য পাল কোন পরিস্থিতিতে কী করবেন। সেটা থাকলে তাদের আচরণবিধি অনেকটাই নির্দিষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অধ্যায়টাকে বাদ দেওয়া হয়েছে আর তার ফলে অন্তত রাজ্যপালকে কলের পুতুল তৈরি করার কোনও প্রয়াস সফল হয়নি।
এই কারণে কোনো কোনো সময় রাজ্যপাল বেরিয়ে এসেছেন চেনা গণ্ডীর বাইরে। ১৯৫৯ সালে কেরলের রাজ্যপাল ‘কেরল এডুকেশন বিল’ স্বাক্ষর না দিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠিয়েছেন। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের কর্ণধার মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জিকে বরখাস্ত করেছেন। ১৯৮২ সালে হরিয়ানার রাজ্যপাল মুখ্যমন্ত্রীপদের দুই দাবিদার ভজনলাল ও দেবীলালকে তাদের সমর্থকদের নিয়ে রাজভবনে হাজির হতে বলেছিলেন— (জি. এস. পাণ্ডে — কনস্টিটিউশনাল ল’অবইন্ডিয়া, পৃ. ৩০০)। একবার মধ্যপ্রদেশের রাজ্যপাল বিধানসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় গণ্ডগোল সৃষ্টিকারী সদস্যদের বহিষ্কৃত করেছেন।
এই সব কারণে ড. হরিহর দাস মন্তব্য করেছেন, “The Governor is not a cipher’— (ইন্ডিয়া : ডেমোক্র্যাটিক গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৭২)। অবশ্য একটা দল বা গোষ্ঠীর একক গরিষ্ঠতায় ক্ষমতা দখল করলে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে তিনি সক্রিয় হয়ে উঠতেই পারেন। সেই সুযোগ সংবিধানই রেখেছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির -সহ কোনো কোনো নেতা বলেছেন, রাজ্যপাল যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙেছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভাঙা কাকে বলে তাঁদের সেই ধারণাই নেই। রাজ্যপালকে কেন্দ্র নিযুক্ত করে (১৫৫ নং অনুচ্ছেদ) এবং যে কোনও সময় পদচ্যুতও করতে পারে— ‘The Governor shall hold office during the pleasure of the president৷’যুক্তরাষ্ট্রীয় ঐক্যকে সুনিশ্চিত করার জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাই। তিনি কেন্দ্রের এজেন্টও। রাষ্ট্রপতির নির্দেশ ও মুখ্যমন্ত্রীর পরামর্শ পরস্পর বিরোধী হলে তিনি প্রথমটাই মেনে নেবেন– (মরিস জোন্স গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স অব ইন্ডিয়া, পৃ. ১০০)।
সুতরাং এল. এল. সিক্রির ভাষায় বলা 6607— The Governnor’s office is not a mere decorative emblem’— (ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স, পৃ. ২৩৬)। যদি রাজ্য সরকারের নীতি ও কাজ তার পছন্দ না হয়, তিনি তার জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারেন এই মর্মে কেন্দ্রকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পরামর্শও দিতে পারেন।তিনি essential part of the constitutional machinary’— (5. বিদ্যাধর মহাজন— দ্য কনস্টিটিউশন অব ইন্ডিয়া, পৃ. ২৮২)।
সংবিধান রচয়িতারা রাজ্যপালকে ঘুমিয়ে কাটাতে বলেননি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরং তারা তাকে সক্রিয় হওয়ার ব্যাপক ক্ষমতা দিয়েছেন। ড. এস. সি. কাশ্যপ লিখেছেন, “There are certain areas where the Governor may have to use his own wisdom’— (OTIC]127 কনস্টিটিউশান, পৃ. ২১৪)।
রাজনীতি করতে গেলে সংবিধান সম্পর্কে একটা আধটু জ্ঞান থাকা দরকার। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলের নেতাদের এই কথা কে বোঝাবে?
ড. নির্মলেন্দু বিকাশ রক্ষিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.