সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র যেন আজকের কথা ভেবেই তাঁর ‘বাবু’ প্রবন্ধে এমন কথা বলেছিলেন। ক্রান্তদর্শী বঙ্কিম বলেছিলেন, যাঁরা ‘বাবু’ শব্দের ভুল অর্থ করবেন তাঁরা গোজন্ম লাভ করে বাবুদের ভক্ষ হবেন। উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের ভাবনায় সম্পৃক্ত বাবুশ্রেণী ভারতবর্ষের সংস্কার ও জীবনযাপনকে সর্বপ্রকারে হেয় প্রতিপন্ন করেই আত্মপ্রসাদ লাভ করত। তার মধ্যে অন্যতম ছিল গোমাংস ভক্ষণ। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

আজ কলকাতার রাস্তায় ‘সভা কবি’ অবতারে, ‘ব্রাহ্মণ মেয়র’ অবতারে, কেরলে ‘যুব কংগ্রেস’ অবতারে বাবুরা প্রকাশ্যে গো মাংস ভক্ষণ করে ধন্য হচ্ছেন। দেশের সংবিধান, রাজ্যের আইন, সামান্য মানবিকতা কোনও কিছুরই তোয়াক্কা না করে। সংবাদমাধ্যমও মহাউৎসাহে বাবুদের বাহবা দিচ্ছে। কেরালায় ক্ষমতাসীন সিপিএম আর বিরোধী কংগ্রেস ‘বিফ পার্টির’ প্রতিযোগিতা করছে। পৈশাচিক উৎসাহে যুবকংগ্রেস কর্মীরা কেরালার কুন্নুর জেলায় প্রকাশ্য রাজপথে একটি বাছুর কেটে উৎসব করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪২৮ ধারা ও ১৯৬০ সালের পশুক্লেশ নিবারণী আইনে তাঁদের মাথায় শাস্তির খাঁড়া ঝুলছে। গত ২৮ মে তারিখে রাহুল গান্ধিও টুইটারে তাঁর কর্মীদের কৃতকর্মে লজ্জা প্রকাশ করেছেন।

প্রশ্ন হল বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার নতুন কি ব্যবস্থা নিয়েছেন? আর কেনই-বা ভারতের বর্তমান বাবুকুল যুব সমাজকে বা বিশেষ সম্প্রদায়কে উত্তেজিত করছেন? আসলে আজকের সভ্য সমাজে সারা পৃথিবীতেই পশুদের ওপর কতগুলি নিষ্ঠুরতা আর চলে না। পশ্চিমবঙ্গ এই নির্মমতায় একেবারে ওপরের দিকে আছে। এ রাজ্যে গো-বাণিজ্যের (পড়ুন গো তস্করির) সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সীমান্তে ইদানীং প্রহরা কঠোর হওয়ায় গো পাচারের নিষ্ঠুরতা বহুগুণ বেড়ে গেছে। ছোট ছোট গাড়িতে গরুর শরীর দুমড়েমুচড়ে মুখে টেপ লাগিয়ে বাংলাদেশে পাচার হচ্ছে। বড় বাঁশের গুলতির মতো যন্ত্র বানিয়ে এপার থেকে গরু ছুড়ে কাঁটাতারের ওদিকে পাঠানো হচ্ছে। একাধিকবার কলকাতার উচ্চ ন্যায়ালয় এ বিষয়ে রাজ্য সরকারকে সতর্ক করেছেন। ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর মহামান্য বিচারপতি জে এন প্যাটেল ও অসীমকুমার রায়ের বেঞ্চ পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে ‘বকরি ঈদের’ জন্য তৈরি অস্থায়ী গরুর হাট সম্পূর্ণ বেআইনি। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫০ সালে ‘দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যানিম্যাল স্লটার কন্ট্রোল অ্যাক্ট’ চালু হয়। ১৯৭৯ সালে তার সংশোধনও হয়। কিন্তু রাজ্য সরকার এসবের তোয়াক্কা করে না। এ রাজ্যের আইন অনুসারে কেবল মাত্র ১৪ বছরের থেকে বেশি বয়সের গরুকেই কাটে যাবে। কাটার আগে লাগবে ‘ফিট-ফর-স্লটার’ সার্টিফিকেট, দেবেন একজন পাশ করা পশু চিকিৎসক। কলকাতার বিফ ফেস্টের আয়োজক বাবুদের অবশ্য কেউ প্রশ্ন করেনি যে তাদের প্লেটের গরুগুলির ‘ফিট-ফর-স্লটার’ সার্টিফিকেট কলকাতা পুরনিগমের কোন অফিস দিয়েছিল? এ রাজ্যে ওই আইন ভঙ্গ করলে ছ’মাসের জেল হওয়ায় কথা! পশ্চিমবঙ্গের মতো বহুরাজ্যেই রাজ্য সরকার পশুক্লেশ ও পশুহত্যার বিষয়ে নিজ রাজ্যের আইনকেই বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাচ্ছেন। এ বিষয়ে সারা দেশে আন্তর্জাতিক মান অনুসারে এক মানবিক ব্যবস্থা চালু করার কথা বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

যদিও বাবুরা ধর্মের জিগির তুলছেন, কিন্তু বিষয়টি আদতে ধর্মীয় নয়। ইসলাম ধর্মে গো হত্যা ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মের অংশ নয়, অবশ্যকর্তব্য তো কখনওই নয়। ইসলাম ধর্মের শুরু মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানে গো মাংস স্বাভাবিক খাদ্য তালিকায় ছিল না। আজও সারা পৃথিবীর ধর্মপ্রাণ মুসলমান মক্কায় কাবা শরীফে হজ্ব করতে যান, পবিত্র ঈদে কুরবানি করেন। গতবছর প্রায় ২৭ লক্ষ পশু কুরবানি হয়েছিল, তারমধ্যে কতগুলি গরু ছিল? ২০১৪ সালে দুবাইয়ের বিজ্ঞানিদের সুপারিশ মেনে হজ্বের সময় উট কুরবানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। হাদীসের কোথাও পাক নবী গোহত্যা করেছিলেন বলে উল্লেখ নেই। সম্রাট আকবর, জাহাঙ্গির বা আহমদ শাহের মতো মুসলমান শাসকরা নিজেদের রাজত্বে গো হত্যা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

এখনও আরব আমির শাহি, ইরাক বা ইরানের এমন অনেক ধর্মপ্রাণ মুসলমান পাওয়া যাবে যাঁরা সারা জীবনে কখনও গো মাংস খাননি। ভারতবর্ষের একমাত্র মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু কাশ্মীরে গো হত্যা প্রায় হয় না বললেই চলে। সত্য কথাটা হল গো হত্যার সঙ্গে ইসলামের ধর্মপালন কোনও সম্পর্ক নেই।

হিন্দুরা গো মাংস খেত— কলকাতার নামকরা সংবাদমাধ্যমের সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত বলে দিলেন। সে কথা তো প্রায় বেদবাক্য! কিন্তু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের (পূর্বতন প্রধান) সংস্কৃত বিভাগের অসাধারণ পণ্ডিত অধ্যাপক সীতানাথ গোস্বামী একেবারে অন্য কথাই বলেন। তাঁর মতে গো মাংস ভক্ষণ কখনওই শাস্ত্রসম্মত ছিল না। হয়তো সীতানাথবাবু মহাভারতের বিদুরের মতো সংবাদ মাফিয়াদের রাজঅন্ন কখনও ভোগ করেননি বলেই সত্য কথা অকপটে বলতে পারেন। তবে শাস্ত্রের গভীরে না গিয়েও সাধারণ বিচার বুদ্ধি দিয়ে কতগুলি কথা পরিষ্কার বলা যায়। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে জগৎগুরু আদি শঙ্করাচার্য সারা ভারতে হিন্দুধর্ম প্রচার করতে ঘুরেছিলেন। তাঁর লেখায় বা সেই সময়ের বর্ণনায় কোথাও গো হত্যার কথা আছে কি? কিংবা আরও আগে গৌতমবুদ্ধের সময়? ভগবান বুদ্ধ সারা জীবন ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের সংস্কারের কাজ করেছেন। তিনি কোথাও গো মাংস ভক্ষণের কথা বলেছেন কি? তার সমসাময়িক লেখাতে গো হত্যার উল্লেখ আছে কি? ভগবান মহাবীর, শিখগুরুদের কেউ কোথাও গো হত্যার কথা বলেছেন? সবকটি ধর্ম সম্প্রদায় সমানভাবে গোমাতা বন্দনার কথা বলেছে। সম্প্রতি এ রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন যে, হিন্দু দলিতরা গো মাংস ভক্ষণ করেন। তাঁর কাছে সবিনয়ে অনুরোধ যে তাঁর রাজ্যের সেইসব তপশিলি জাতিগুলির (সাবকাস্টের) নাম বলুন যারা গো মাংস ভক্ষণ করে।  আসলে ভারতবর্ষে যে-হিন্দুসংস্কৃতি টিকে আছে সেটা মূলত দলিতদেরই অবদান। কিন্তু অন্ত্যজদের হেয় করার ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক মানসিকতা আজও সবর্ণ হিন্দু সমাজের মধ্যে থেকে যায়নি।

প্রকৃত পক্ষে গো আধারিত কৃষি, গভীর দর্শন সমৃদ্ধ হিন্দুসংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই গোমাতা পূজিতা হয়েছেন। এবং গোমাতাকে পূজা করা হয়, তাকে হত্যা করলে হিন্দু ভাবাবেগে আঘাত লাগবে, সেইজন্যই বিদেশি আরব আক্রমণকারীরা গো হত্যা শুরু করে। যদিও গো মাংস তাদের খাদ্য তালিকাতে ছিল না। এই মানসিকতা থেকেই ১৬৪৫ সালে অওরঙ্গজেব চিন্তামনি পরশ নাথ জৈন মন্দির দখল করার সময় মন্দির চত্বরে গো হত্যা করেছিলেন। তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের পূর্বে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির দখল করে এবং ওই পবিত্র সরোবরে গো হত্যা করে গো রক্তে রঞ্জিত করেন আফগান সেনাপতি আহমেদ শাহ আবদালী। আজও পশ্চিমবঙ্গে জেলায় জেলায় হিন্দু গ্রামগুলি ঢোকার মুখে, গ্রামের মন্দিরের ঠিক পাশে যখন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত খোলা অবস্থায় একটি গরুর কাটা পা ঝোলানো থাকে তার পিছনে মাংস বিক্রির তাগিদ যত-না থাকে, থাকে হিন্দুর বিশ্বাসে আঘাত করার আনন্দ। হিন্দু গ্রামে ঢোকার মুখে একটি গো মাংসের দোকান মানে রাজনৈতিক ভাবে, সামাজিক শক্তির দিক থেকে হিন্দুরা পরাজিত সম্প্রদায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার বিগত কয়েকবছরের ঘটনাতে বিষয়টি বোঝা যাবে। বারুইপুর থানার সূর্যপুর হাটের কালীমন্দিরের ঠিক সামনে, রায়দীঘি থানায় নলগড়া গ্রামে ঢোকার মুখে মন্দিরের ঠিক পাশে, কুলতলি থানার মানিকপুর গ্রামে মন্দিরের সামনে (কেস নম্বর ১১২/২০০৬), জামতলা হাট নারায়ণী মন্দিরের সামনে, ঘটি হারানিয়া গ্রামে শীতলা মন্দিরের একেবারে পাশে এমনই গোমাংসের দোকান খোলা নিয়ে বিবাদ হয়। পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ জেলাগুলির সবর্ত্র একই ছবি। এর পিছনে খাদ্যাভ্যাসের প্রসঙ্গ নেই, আছে এক সম্প্রদায়ের দ্বারা অন্য সম্প্রদায়ের পরাজিত পদানত, হওয়ার প্রশ্ন। ওই সবক’টি স্থানে অত্যাচারিত দুর্বল হিন্দুরা থানাতে এফ আই আর করেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আইন অনুসারেও কোথাও কোনও বিচার পায়নি।

ভারতীয় সংবিধানের ৪৮ ধারাতে দেশে গো হত্যার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আছে। কেন বাবাসাহেব আম্বেদকরের মতো মুক্তমনা পণ্ডিত মানুষেরা এমন ধারা রাখলেন? কেনই-বা মহাত্মা গান্ধি বা বিনোবা ভাবের মতো কংগেস নেতারা ভারতে গো বংশ রক্ষার জন্য ও গো হত্যা রদের জন্য এত ব্যাকুল ছিলেন? আদ্যন্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন হিন্দু মুনি-ঋষিরা কেনই-বা একটি পশুকে পূজা করার নিদান দিয়েছেন। কেনই-বা সংস্কৃত সাহিত্যে ‘গো’ শব্দকে কখনও আলোর সঙ্গে (গবাক্ষ), কখনও জ্ঞানের সঙ্গে (গবেষণা), কখনও-বা পৃথিবীর প্রতিশব্দ রূপে ব্যবহৃত হয়েছে? কারণটা অনেক বেশি আর্থসামাজিক ও বিজ্ঞানভিত্তিক, খুব সামান্যই ধর্মীয়। অনুভূতির জায়গাটাও খুব সামান্য। ভারতীয় সংবিধানে বা বিভিন্ন রাজ্যের আইনে গরু অর্থে যে-প্রাণীটিকে বলা আছে সেটি হল ভারতীয় প্রজাতির পিঠে কুঁজওয়ালা গো বংশ। এই প্রজাতির প্রাণীটির প্রতিই হিন্দু ভাবাবেগ জড়িয়ে আছে। ‘জার্সি কাউ’ কাউ হলেও গৌ নয়। মোষ বা ‘ওয়াটার বাফেলো’ও সংরক্ষিত গরুর মধ্যে আসে না। তাই ভারতের বহু রাজ্যে এই প্রাণীগুলির বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা নেই।

এই পিঠে কুঁজওয়ালা ভারতীয় গরু দেশের জন্য এক অমূল্য সম্পদ এটা আমাদের পূর্বপুরুষেরা বুঝেছিলেন। ভারতীয় প্রজাতির গরুর দুধ এ—টু (A2) প্রকৃতির। এই দুধে প্রভূত পরিমাণ বিটা কেসিন থাকে, যা এ-ওয়ান দুধে থাকে না। সারা পৃথিবীতে তাই এই এ-টু দুধেরই কদর। আজ ইওরোপ আমেরিকার বাজারে সবথেকে দামি সবজি, খাদ্য শস্যের গায়ে ‘বায়ো’ তকমা থাকে। ‘বায়ো’ মানে যাতে রাসায়নিক সার বা কীটনাশক দেওয়া হয়নি। এই ‘বায়ো ফার্মিং’ আদতে গো-আধারিত কৃষি। জাপানি বিজ্ঞানী মাসানবু ফুকুওকা তাঁর বিশ্বখ্যাত বই ‘দ্য ওয়ান স্ট্র রেভোলিউশন’-এ দেখিয়েছেন যে এই গো-আধারিত কৃষির উৎপাদনই দীর্ঘমেয়াদী কালের নিরিখে অনেক লাভজনক। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের শস্য শ্যামলা কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মতো শত শত গবেষণা কেন্দ্রে আজ পঞ্চগব্য, গোমুত্র-নিমবীজ নির্ভর কীটনাশক নিয়ে গবেষণা চলেছে। দেশি গরুর বিষয়ে প্রাচীন ভারতের এইসব আবিষ্কার আজ আধুনিক বিজ্ঞান গ্রহণ করছে। তাই প্রকাশ্য রাস্তায় বাছুর কেটে সেই রক্তে নারকীয় উল্লাস বা হিন্দুর আবেগে আঘাত দিয়ে গোমাংস নিয়ে টানাটানি করে খাওয়ার মধ্যে কোনও বিজ্ঞান মনস্কতা বা অর্থনৈতিক বিচক্ষণতা নেই। আছে নিজের সংস্কৃতিকে হেয় করার সেই পুরাতন ‘বাবু জন্ম নির্বাহ বিলাস’ আর সাম্প্রদায়িক বিভেদকে উস্কে দেওয়ার এক বিকৃত মানসিকতা।

ড. জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.