বাংলার গর্বের কথা বলতে গিয়ে প্রথমেই হিন্দি কহাবৎ মনে আসছে। “আন্ধের নগরী চৌপট রাজা/ টাকে সের ভাজি টাকে সের খাজা”। আজ বাংলাতে সত্যি যেন মুড়ি মিছরি এক হয়ে গেছে। এ রাজ্যের মানুষ কোনটা নিয়ে গর্ব করবে আর কী নিয়েই বা লজ্জা পাবে সব যেন একাকার হয়ে গেছে।
উচ্চ শিক্ষিত একটি প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে লন্ডনে পড়াশুনা করে। তার মা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চপদে আসীন। নবান্নের উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন আধিকারিক তাঁর কথা শোনেন, সেইমতো হাসপাতালকে নির্দেশ দেন। ছেলেটির বাবা পেশায় একজন ডাক্তার। তবু এই পরিবার থেকেই সবথেকে বেশি সংক্রমণ ছড়াল। করোনার প্রকোপ শুরু হওয়ার পরে ভারতের কোনও রাজ্যে এমন বিপর্যয় হয়নি। রামমোহন, বিদ্যাসাগরের শহর কলকাতায় এতটাই অসচেতন শিক্ষিত সমাজ। কোথায় যেন মানুষ ভাবতেও শুরু করেছে, ক্ষমতাবলের পদলেহন আর ক্ষমতার অপপ্রয়োগই এই রাজ্যে শেষ কথা। বিদ্যা বুদ্ধি, বিজ্ঞানমনস্কতা, সমাজ সচেতনতার এ রাজ্যে বিশেষ মূল্য নেই।
সারা ভারতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউ.জি.সি. (UGC) নির্দেশিত বিধি মেনে লেকচারার/ প্রফেসর থেকে উপাচার্য নিয়োগ হয়। এ রাজ্যে এমন উপাচার্যও আছেন যাঁরা জীবনে কখনও কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেননি বা স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানোর অভিজ্ঞতাও নেই। কোনও পরীক্ষা পদ্ধতি, সার্চ কমিটি, স্ক্রিনিং ব্যবস্থার ধার না ধরে অস্থায়ী ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি নিয়োগ হচ্ছে। তারপর এই সিভিক অধ্যাপকদের ৬০ বছর পর্যন্ত পড়ানোর নিদান দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মাস্টার ডিগ্রি করা, পি এইচ ডি করা, পোস্ট ডক্টরেট করা যুবক-যুবতীরা যোগ্যতার ভিত্তিতে কাজ পাচ্ছেন না। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বহু যত্নে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে সমগ্র এশিয়ার মধ্যে স্বনামে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ঋষি অরবিন্দের মতো মনীষীরা ইংরেজকে চ্যালেঞ্জ করে প্রযুক্তি বিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা বিজ্ঞানের কলেজ স্থাপন করেছিলেন। সেই যুগটা যদি বাংলার গর্ব হয় তাহলে আজকের পশ্চিমবঙ্গে উচ্চশিক্ষা অবশ্যই বাংলার লজ্জা।
খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের সময় দেখা গেল পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে তৈরি হয়েছে শত শত স্লিপার সেল। তার মূল নায়কেরা শাকিল আহমেদের মতো বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী। তারা সিমুলিয়ার মতো খারিজি মাদ্রাসা থেকে কৌসরের মতো ভারতীয় মেয়েদের সংগ্রহ করে জেহাদের কাজে লাগিয়েছে। ২০১৯ সালে মুশির্দাবাদ, মালদাসহ বহু জেলায় স্টেশনের পর স্টেশন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে সিএএ (CAA) বিরোধিতার নামে। অন্তত ৭০ টি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে। জাতীয় সড়কে বাস জ্বলছে সারি বেঁধে সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে পুলিশ প্রশাসন। এই অবস্থা একদিনে হয়নি। কালিয়াচক থেকে ধুলাগড় সর্বত্র রাজনৈতিক স্বার্থে মৌলবাদকে প্রশয় দেওয়া হয়েছে। মৌলবাদী মুখদের বেছে বেছে সামনে আনা হয়েছে। গত ১০ বছরে পশ্চিমবঙ্গ জেহাদি মৌলবাদের অবাধ বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। ইম্প্রোভাইসড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (Improved Explosive Device) (আই এস ডি) থেকে শুরু করে শক্তিশালী বোমা তৈরি এরাজ্যে এখন কুটির শিল্প। কাজী নজরুল ইসলামের (Kazi Nazrul Islam) মতো দেশপ্রেমিক যদি বাংলার গর্ব হন, তবে আজকের সাম্প্রদায়িক পশ্চিমবঙ্গ তো বাংলার লজ্জা!
ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী (Dr. Shyamaprasad Mukherjee) কাশ্মীরকে ভারতবর্ষের অখণ্ড অভিন্ন অংশ হিসাবে রাখার জন্য শ্রীনগরে প্রাণ বলিদান করেন। ড: বিধানচন্দ্র রায় (Dr. Vidhan Chandra Roy) সারাটা জীবন পশ্চিমবঙ্গের রূপায়ণের জন্য দিয়ে সবশেষে নিজের বাড়িটাও মানুষের কল্যাণে দান করে গিয়েছিলেন। স্বাধীন ভারতেও বাংলার মানুষ এমন রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দেখেছেন। হীরেন মুখার্জী বা প্রমোদ দাশগুপ্তের মত নির্মোহ, সৎ, আদর্শবাদী বামপন্থী নেতা নেত্রীকেও দেখেছেন। রাজনৈতিক বিশ্বাস যাই হোক না কেন যেকোনও বাঙালি এঁদের জন্য গর্ব করতে পারেন।
কিন্তু বাঙালি কি তাদের জন্য গর্ব করবে যাঁরা দশ বছরে প্রায় হাওয়ার মধ্যে থেকে মাথা তুলে শহর কলকাতার বুকে একের পর এক প্রাসাদের মতো বাড়ির মালিক হয়ে যাচ্ছেন কেবল মাত্র রাজনীতি করে? সারদা কাণ্ডে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দরিদ্র মানুষ। সব রাজনীতি ভুলে সারদা কাণ্ডের প্রত্যেক অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে বাংলার মানুষকে। তা না হলে বারুইপুরে ঐ সবজি বিক্রেতা মহিলার, সদপুরের জগদীশ রায়ে কিংবা হুগলীর জয়ন্ত সরকারের আত্মা শান্তি পাবে না। যে জাতি সারদার (Sarda) অপরাধীদের এত সহজে ভুলে যায়, তাদের গর্ব করার কিছু থাকে না, সবটাই লজ্জা!
সারা ভারতবর্ষ করোনা ভাইরাসের (Corona virus) আতঙ্কে ভুগছে। কোনরকম ঝুঁকি না নিয়ে নিজেদের সংযম বজায় রাখছে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের থেকে অনেক বড় সারা দেশের স্বার্থ। “ব্রেক দ্য চেন”, সংক্রমণ যেন না ছড়ায়। “কিপ সোশ্যাল ডিস্ট্যান্স“, কোনও রকমেই যেন বেশি মানুষ একত্রিত না থাকে। এইসব নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পার্ক সার্কাসে তথাকথিত সিএএ (CAA) -বিরোধী অবস্থান চলেছে যথারীতি। আজকের পশ্চিমবঙ্গে সকলের জন্য এক আইন নয়। মাথায় বিশেষ “ফেজ টুপি“, “স্কাল ক্যাপ” পরিধান করলে মোটর বাইক চালানোর সময় হেলমেট না ব্যবহার করলেও চলে। কলকাতা পুলিশের এটি অলিখিত ছাড়পত্র। আজ করোনা ভাইরাসের ভয়াবহ দাপটেও সবকিছু অমান্য করে পার্ক সার্কাসের অবস্থান চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে আইন ভাঙার ট্র্যাডিশন ভাঙ্গা হয়নি। যে বাংলা আজ যা ভাবে ভারতবর্ষ তা ভাববে কাল। সেই যুগটা ছিল বাংলার গর্ব। আজকের রাজ্যে পঙ্গু প্রশাসন বাংলার লজ্জা।
বাংলার গর্ব ছিল বাংলার সমাজ। বাংলার গর্ব ছিল তার স্বাভিমান, সাধারণ মানুষের আত্মমর্যাদা বোধ। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সমাজের এই জীবন্ত জাগ্রত দেবতাকে উপলব্ধি করে ‘স্বদেশী সমাজ’ লিখেছিলেন।
বিগত দিনের বাম শাসনে সমাজ ভেঙ্গে গেছে। সমাজের স্থান দখল করল পার্টি অফিস। ঘরের মধ্যে ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের, জায়ের সঙ্গে জায়ের, কাকার সঙ্গে ভাইপোর সম্পর্কে ঢুকে গেল পার্টি। পার্টি ছাড়া আর কিছু নেই। গত ১০ বছরে বাংলার গ্রাম থেকে শহরে ধীরে ধীরে লুপ্ত হচ্ছে আত্মসম্মান বোধ। কিছুদিন আগেও আমার গ্রামের সইফুল চাচাকে পঞ্চাশটা টাকা দিলে, দিনে তিনবার এসে জিজ্ঞাসা করতেন, “কী করতে হবে বললে না তো?”, মানে যত গরীব মানুষই হোন বাংলার আত্মসম্মান বোধ ছিল। মাগনা পয়সা নিতে মানুষ ঘৃণা করত। কিন্তু চিট ফান্ড কাণ্ড, নারদা ইত্যাদি ঘটনা এবং সেই অর্থ গ্রাম থেকে শহরে, ক্লাব থেকে মদের ঠেকে প্রবাহিত হওয়ার সুবাদে মানুষের এই আত্মসম্মানবোধ নষ্ট হয়ে গেছে। নারদার টাকা লেনদেনের দৃশ্য দেখে এক কাজের মাসির উপলব্ধি শুনে গায়ের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা অকপটে বললেন, ”এখন এমনিতেই টাকা পাওয়া যায়, বড়রা কোটি টাকা নিলে আমাদের একশ টাকা দেবে”। এই প্রাপ্তি আজ বাংলার গর্ব।
সারা ভারতবর্ষে বেশিরভাগ রাজ্য সরকার তাদের কর্মীদের সপ্তম পে কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করেছেন। প্রদেয় মহার্ঘ্য ভাতা এবং বকেয়া ‘এরিয়ার’ সম্পূর্ণ মিটিয়ে দিয়েছেন ।এ রাজ্যে ন্যায্য দাবির কথা বললে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। রাজপুত্রদের রাজপ্রসাদ হয়েছে, দামি গাড়ির কনভয় হয়েছে, বিদেশ থেকে কেজি কেজি সোনা আনার ব্যাবস্থা হয়েছে, কিন্তু রাজ্য সরকারি কর্মচারীর ন্যায্য পাওনা দেওয়া হয়নি।
স্কুল শিক্ষক রাজকুমার রায়ের দুটো ফুটফুটে বাচ্চা ছিল। ইটাহারে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার হিসাবে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে রাজনৈতিক গুণ্ডাদের অবাধ স্বাধীনতা দেওয়া ছিল পঞ্চায়েত দখলের। খুন হলেন নিরপরাধ শিক্ষক রাজকুমার। এ তো অবশ্যই বাংলার লজ্জা।
কর্তব্যরত ডাক্তারদের বিনা কারণে মেরে থেঁতলে দেওয়া হল। কিন্তু যে গরু দুধ দেয় তার লাথি যে সহ্য করতেই হবে। তাই ডাক্তারবাবুদের ওপর অমানবিক আচরণের কোনও প্রতিকার হল না। এরাজ্যে তাই সরকারি হেলথ সার্ভিসে কোনও ডাক্তারবাবু চাকরি করতে চান না।
ঠিক ঠিক দলদাস না হতে পারলে প্রশাসনিক আধিকারিকদের বদলি অবধারিত। থানার মধ্যে ঢুকে মহিলা পুলিশ কনস্টেবলকে মেরে পার পেয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। সমাজবিরোধীদের দাপটে থানার ভেতর পুলিশ ফাইলে মুখ ঢেকে টেবিলের তলায় লুকিয়ে থাকেন। সত্যি বাংলার গর্ব করার মতো সরকারই বটে!
যতীন্দ্র নাথ দাস (Jitendra Nath Das) ১৯২৯ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৬৩ দিন অনশন করার পরে লাহোর জেলে মৃত্যুবরণ করেন। যতীন দাসের বয়স ছিল মাত্র ২৪ বছর। বাংলার এই বিপ্লবীর জন্য আজও বাংলার মানুষ গর্ববোধ করে।
২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সিঙ্গুর আন্দোলনের জন্য কলকাতায় অনশন চলছিল। বর্ণালী মুখার্জি (Barnali Mukherjee) নামে এক বামপন্থী নেত্রী ওই অনশন মঞ্চে ছিলেন। ১০ দিন পরে তাঁকে ধর্মতলা থেকে স্যালাইন দিয়ে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। বর্ণালীর রাজনৈতিক মতবাদ যিনি একবর্ণও বিশ্বাস করেন না, তিনিও তাঁর রাজনৈতিক সততা আর আদর্শ নিষ্ঠাকে কুর্নিশ করবেন।
কিন্তু একই মঞ্চে ২৫ দিন অনশনের পরে উঠে এলেন আর এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। পরিষ্কার রাজনৈতিক দীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। তারপরে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলেন। যে ধরনের অলৌকিক শারীরিক ক্ষমতা অভিনেতা রজনীকান্ত তাঁর দক্ষিণ ভারতীয় ফিল্মে দেখান, কোনও রক্তমাংসের মানুষকে সেটা দেখাতে গেলে অনেক স্বচ্ছতার প্রয়োজন। সরকারি ডাক্তার দিয়ে নিয়মিত পরীক্ষা ইত্যাদি না করলে প্রশ্নও থেকেই যায়। তিনি বাঙালির গর্ব হতেই পারেন না। বিদ্যাসাগরের বাংলা, স্বামী বিবেকানন্দের বাংলা, বীর সুভাষের বাংলার এতটা দুর্দিন এখনও আসেনি।
সত্যান্বেষী