ভোরের আলো ফুটতেই খুলে গেল ইসকনের চন্দ্রোদয় মন্দিরের দরজা। ভিতর থেকে ভেসে এল মিঠে কীর্তনের সুর।
কাঁসর-ঘণ্টা-শঙ্খধ্বনির সঙ্গে কীর্তনের মেলবন্ধনে মায়া ছড়াল মায়াপুরের আকাশে। ঢোল-করতাল-খঞ্জনিতে বিশাল শোভাযাত্রা চলল নবদ্বীপ, বেলপুকুর, রাজাপুর, হরিহরক্ষেত্রে। কারও যাত্রা উত্তর থেকে দক্ষিণে, কেউ চলেছেন পশ্চিম থেকে পুবে। ছোট-বড় মিছিল দেখতে ভিড় উপচে পড়ল নদী ঘেঁষা রাস্তার দু’ধারে। মিছিলে মিলেমিশে একাকার হলো বাংলা-মেক্সিকো-মায়ানমার-কুয়ালালামপুর-ব্রিটেন।
দোলপূর্ণিমার আগে নবদ্বীর জুড়ে উৎসবের আবহ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতে, নবদ্বীপের ন’টি দ্বীপ— শ্রীসীমন্তদ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ, শ্রীমধ্যদ্বীপ, কোলদ্বীপ, ঋতু দ্বীপ, জহ্নু দ্বীপ, মোদদ্রুপ দ্বীপ, রুদ্রদ্বীপ ও শ্রীঅন্ত দ্বীপ। এই ন’টি দ্বীপ জুড়ে পরিক্রমা শুরু হয় দোলের ঠিক আগে। ছোট-বড় নানা মিছিলে সেই পরিক্রমায় সামিল হন দেশ-বিদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। বিদেশের অন্তত ১০০টি দেশ থেকে ইসকন-ভক্তরা ভিড় জমান মায়াপুরে। এই পরিক্রমার পোশাকি নাম ‘নবদ্বীপ মণ্ডল পরিক্রমা।’
নবদ্বীপের দোল যতটা শ্রীকৃষ্ণের উৎসব, তার থেকে অনেক বেশি চৈতন্যের জন্মতিথি উদযাপন। নবদ্বীপে এর নাম গৌরপূর্ণিমা। মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের ৫৩৩ তম আবির্ভাব তিথি উপলক্ষ্যে শুরু হয়ে গেছে এই মণ্ডল পরিক্রমা। চলবে ১৬ মার্চ পর্যন্ত। সন্ন্যাস গ্রহণের আগে নবদ্বীপে থাকাকালীন বিশ্বম্ভর মিশ্রের যাতায়াত ছিল যে সব জায়গায়, সেই সব এলাকায় সংকীর্তন সহযোগে পরিক্রমার মধ্যে দিয়েই দোলের সূচনা হবে নবদ্বীপে।
গঙ্গার দু’পাড়ের ছোট বড় সব মঠ-মন্দিরই পৃথক ভাবে আয়োজন করে পরিক্রমার। আর এই পরিক্রমায় সামিল হতেই ছুটে আসেন ভক্তেরা। মায়াপুর ইসকনের চন্দ্রোদয় মন্দির থেকে ছ’টি দলে ভাগ হয়ে শুরু হয় পরিক্রমা। মৃদঙ্গ-সংকীর্তনের তালে তালে খালি পায়ে হাঁটেন ভক্তেরা। চৈতন্যধামের পোড়ামা তলা, মঠ-মন্দির ছুঁয়ে, নদীর পাড় ধরে কখনও পায়ে হেঁটে, আবার কখনও ভাগীরথী ও জলঙ্গী নদীপথে চলে পরিক্রমা।
সাত দিন ধরে নবদ্বীপের ন’টি দ্বীপে রাত্রিবাস করবেন ভক্তেরা। আমেরিকা, রাশিয়া, চিন, মায়ানমার, বাংলাদেশ-সহ অন্তত ১০০টি দেশের মানুষজন জড়ো হয়েছেন নবদ্বীপে। নানা ভাষাভাষির দেশের মানুষের সংকীর্তনের সুরেও তাই আলাদা ছন্দ। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা হোক বা কুয়ালালামপুর— বাংলাতেই গাইছেন নামকীর্তন। তবে উচ্চারণের তারতম্যে বাংলার কীর্তনে লেগেছে ভিন্ দেশের ছোঁয়া। খোল করতালের পাশাপাশি বিদেশি ভক্তদের হাত ধরে জায়গা করে নিয়েছে সিন্থেসাইজার, অ্যাকোর্ডিয়ান কিংবা থুম্বা।
নবদ্বীপে সব থেকে বড় পরিক্রমা বের হয় দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠ এবং কেশবজি গৌড়ীয় মঠ থেকে। নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করতে পুলিশি ব্যবস্থাও তাই জোরদার। পরিক্রমা ঘিরে যোগপীঠ, শ্রীধামেশ্বর মহাপ্রভু, শ্রীবাস অঙ্গন, শ্রীঅদ্বৈত ভবন ও শ্রীগদাধর ভবন, মুরারী গুপ্তের শ্রীপাঠ, চাঁপাহাটী, বেলপুকুর শ্রীমদনগোপাল মন্দির, শ্রীধর অঙ্গন-সহ নবদ্বীপ ও সংলগ্ন এলাকার প্রায় দেড়শো মঠ-মন্দিরে সপ্তাহজুড়ে চলবে উৎসবের মেজাজ।