পাটঃ তিতাপাটের প্রধান ফসল বপন পর্ব চলবে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত যা শুরু হয়েছিল চৈত্র মাস থেকে। মিঠাপাটের জলদি ফসল বৈশাখের মাঝামাঝি অবধি বোনা যাবে, যা শুরু হয়েছিল চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ থেকে। মিঠাপাটের প্রধান ফসল বৈশাখ থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বোনা সম্ভব। বোনার সময় মাটিতে রস না থাকলে হালকা সেচে মাটি ভিজিয়ে নিতে হবে। তিতা ও মিঠা পাটের জন্য বীজের হারে সামান্য পার্থক্য রয়েছে। বিঘা প্রতি জমিতে তিতাপাটে ১ কেজি এবং মিঠাপাটে ৮০০ গ্রাম বীজ লাগবে। বোনার আগে বীজ শোধন করে নিতে হবে। প্রতি কেজি বীজে ২ গ্রাম পরিমাণ কার্বেন্ডাজিম অথবা ২ গ্রাম থাইরাম মেশানো উচিত। জমির অবস্থান অনুযায়ী তিতা ও মিঠাপাটের বিভিন্ন জাত নির্বাচন করা হয়। তিতাপাটের উন্নত ও জলদি জাত হল সোনালি। তিতাপাটের মধ্যে শ্যামলী, সবুজসোনা ইত্যাদি জাত উল্লেখযোগ্য। মিঠাপাটের প্রধান ফসলরূপে সুবর্ণ জয়ন্তী তোষা, বাসুদেব, নবীন ইত্যাদি বোনা যায়। পাটের জমি তৈরি করতে শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি ১০-১২ কুইন্টাল জৈবসার মেশাতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে মোট নাইট্রোজেনের এক তৃতীয়াংশ। ফসফেট ও পটাশ সারের পুরো ভাগটাই সেই সঙ্গে জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে। তিতা পাটে বিঘা প্রতি ৮, ৪ এবং ৪ কেজি নাইট্রোজেন, ফসফেট আর পটাশ লাগবে। মিঠাপাটে লাগবে যথাক্রমে ৭, ৩ এবং ৩ কেজি পরিমাণ নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ। এই নাইট্রোজেনের এক তৃতীয়াংশ শেষ চাষে দেওয়ার কথা।মিঠা পাটে সারি থেকে সারির দুরত্ব রাখা হয় ২০ সেন্টিমিটার; আর গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৫ থেকে ৭ সেন্টিমিটার। তিতা পাটের ক্ষেত্রে এই দূরত্ব যথাক্রমে ২৫ সেমি এবং ৫-৭ সেমি।
যারা আগে পাট বোনার সুযোগ পেয়েছেন, তারা পাটের চারা বের হবার দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে নির্ধারিত দূরত্বে এক একটি গাছ রেখে বাকিগুলি তুলে ফেলুন, তাতে গাছের বৃদ্ধি ভালো হবে। এই কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে মাঝের ঘাসগুলিও নিড়ান দিয়ে তুলে ফেলুন। নতুন করে যারা বীজ বোনার কথা ভাবছেন তারা বীজ বোনার একদিন পর আগাছা নাশক ফ্লুক্লোরোলিন ৪৫ শতাংশ (ব্যাসোলিন) প্রতি লিটার জলে ৬ মিলি পরিমাণ মিশিয়ে প্রতি বিঘার জন্য ২৭ লিটার ওষুধগোলা জল স্প্রে করলে আগাছার উৎপাত ঠেকাতে পারবেন। ৫-৬ সপ্তাহে পুনরায় নিড়ানি দিয়ে কিংবা চক্রবিদার সাহায্যে আগাছা দমনের কাজ শেষ করবেন। চৈত্র-বৈশাখের কালবৈশাখী ঝড়বৃষ্টির জল ঠিকমতো পেলে পাটচাষে সেচের প্রয়োজন হয় না। এই বৃষ্টি না হলে বর্ষা শুরুর আগে আড়াই সপ্তাহের ব্যবধানে হালকা সেচ দিতে হবে। চৈত্র মাসে লাগানো পাটে এ সময় আঙ্কা পোকা, ঘোড়া পোকা, শুয়োপোকা, মাকড়, কাথরি পোকা, বলয় কীট বা নাপসারা, শিকড় কৃমি প্রভৃতি কীটশত্রু ও কৃমিশত্রু আর উঁটা পটা, ঢলে পড়া প্রভৃতি রোগের জন্য সতর্ক থাকতে হবে।
মুগ ও কলাই (ডাল শস্য) ঃ প্রাক-খরিফ ফসল রূপে যারা চৈত্রের মাঝামাঝি মুগ ও কলাই বুনেছেন তারা বৈশাখের প্রথম সপ্তাহে অর্থাৎ বীজ বোনার তিন সপ্তাহ পর আগাছা পরিষ্কার করুন, তুলে ফেলুন অতিরিক্ত ও দুর্বল চারা। ফাল্গুনের শেষে যারা মুগ বা কলাই বুনেছেন তারা বৈশাখের একদম প্রথমে ফুল আসার আগে একটা হাল্কা সেচ দিন। মুগে ভাইরাসঘটিত কুটে রোগ, চোষীপোকা ও বিছাপোকার প্রতিকারের জন্য ব্যবস্থা নিন। কলাই-এর ক্ষেত্রে হলুদ কুটে রোগ ও শুটি ছিদ্রকারী পোকার জন্য বৈশাখ মাস থেকেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
তৈলবীজ – সূর্যমুখী ও প্রাক-খরিফ মরশুমে যারা সূর্যমুখী লাগিয়েছেন (মাঘ থেকে ফাল্গুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত) তারা বৈশাখমাসে ফসলের বৃদ্ধিদশা অনুযায়ী সুযোগ বুঝে তৃতীয় (বীজ বোনার ৬০-৬৫দিন পর) ও শেষ সেচ(৭৫-৮০ দিন পর) প্রয়োগ করুন। সূর্যমুখীতে দানা ঠিকমতো পেতে হলে কৃত্রিমভাবে পরাগ সংযোগ করিয়ে দিতে হয়। এজন্য সকালে দুজনকে মাঠে এসে জমির একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দড়ি ধরে ফুলের উপর আলতো ছুঁয়ে দড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এই মাসে টিয়াপাখির আক্রমণ হলে মাঠে বেঁধে দিতে হবে সোনালী বা লাল পলিথিনের ফিতে। আর দমন ব্যবস্থা নিতে হবে শুয়োেপাকার বিরুদ্ধে।
তিল : ফাল্গুনে যারা তিল বুনেছেন তারা ফসলের বৃদ্ধিদশা অনুযায়ী দ্বিতীয় ও তৃতীয় বারের জন্য সেচ প্রয়োগ করুন। দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে সম্পূর্ণ ফুল আসার সময় আর তৃতীয় সেচ লাগবে ফল তৈরির সময়। তিলের বিছাপোকার জন্য ব্যবস্থা নেওয়াও জরুরী।
চীনাবাদাম : প্রাক-খরিফ ফসল হিসাবে যারা চীনাবাদাম বুনেছেন (ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি) তারা ফসলের দশা অনুযায়ী ফুল আসার সময় জিপসাম প্রয়োগ করুন (বোনার প্রায় এক মাস বাদে বিঘা প্রতি তিরিশ কেজি)। সেই সঙ্গে বাদামের গোড়ায় মাটি ধরিয়ে দিন। এই মাসে ফসল-দশা অনুযায়ী প্রথম (২৫-৩০ দিন বাদে), দ্বিতীয় (৪০-৪৫ দিন বাদে), তৃতীয় (৬০-৬৫ দিন বাদে) এবং চতুর্থ (৮০-৮৫ দিন বাদে) দফার সেচ দরকার হবে।বাদামেফল ফোটা থেকে দানা পরিপষ্ট অবস্থা প্রাপ্তির মাঝে রসের ঘাটতি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।নজর থাকুক।
ফডার বা গো-খাদ্য – গ্রাম বাংলার একটি প্রচল কথা হল ‘গাই গরুর মুখে দুধ। তার মানে হল গরুকে ভাল খাওয়ালেই কেবল ভালো দুধ দেবে। ভালো খাবারের মধ্যে সবুজ গো-খাদ্য বিশেষ উপযোগী। প্রচলিত ফডার বা গো-খাদ্য জোয়ার ও ভুট্টা ছাড়া বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বরবটি, প্যারাঘাস এবং গড়গড়া বা কোয়েক্সের বীজ বোনার কাজ শুরু করা যাবে। বরবটি বোনা চলবে জ্যৈষ্ঠের শেষ অবধি, গড়গড়া আষাঢ় পর্যন্ত এবং প্যারাঘাস শ্রাবণের শেষ অবধি বোনা যাবে। কোয়েক্স বা গড়গড়া এবং বরবটির ক্ষেত্রে ৩০x১৫ সেমি দূরত্বে বীজ বুনতে হয়। বীজের হার বিঘা প্রতি যথাক্রমে ৫.৫ – ৬.৫ এবং ৪.৫ – ৫.৫ কেজি। প্যারাঘাসের কাটিং বসাতে হয়। ৬০x৬০ সেমি দূরত্বে কাটিং লাগাতে হবে, এই হিসাবে বিঘায় প্রায় চার হাজারের মত কাটিং লাগবে। গড়গড়া, বরবটি এবং প্যারাঘাসে বিঘা প্রতি নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ সার লাগবেযথাক্রমে ১৩ঃ৬.৫ঃ৪, ৩৬ঃ৩ এবং ১৬৪৬.৫ঃ৪ কেজি। ৫০ থেকে ৭০ দিনের মাথায় গড়গড়া, ৬০ থেকে ৭৫ দিনের মাথায় বরবটি এবং ৬৫ থেকে ৭৫ দিনের মাথায় প্যারাঘাসের ফসল নেওয়া যাবে। বেশ কয়েকবার ফসল নেওয়া যায়। বিঘা প্রতি সবুজ গো-খাদ্যের ফলন গড়গড়ার ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ কুইন্টাল, বরবটিতে ৪০ কুইন্টাল এবং প্যারাঘাসে ২০০ কুইন্টাল পর্যন্ত।
নারকেল : বৈশাখ মাসে নারকেল বাগিচার তলদেশ বা বেসিন উপযুক্তভাবে খুঁড়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোদাল ধরতে হবে গাছকে বামে বা ডাইনে রেখে, সামনে বা পিছনে রেখে নয়। এইভাবে কোদাল ধরলে মাটির উপরিভাগে রক্ষিত শিকড়ের ক্ষতি হবে কম। এই খুঁড়ে দেবার কারণ হচ্ছে প্রাক-মৌসমি পর্বে বৃষ্টির জল মাটিতে ভালোভাবে প্রবেশ করানো। মাটি খুঁড়বার সময় গাছ প্রতি এক কেজি হারে চুন দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এর এক সপ্তাহ পরে দিতে হবে ২৫ কেজির মত জৈব সার। যে সব গাছে বোরন বা সোহাগার অভাবজনিত লক্ষণ দেখা যায়, তাতে গাছ প্রতি দেড়শ’ গ্রাম সোহাগা দেওয়া উচিত এইসময়। মাটিতে সোহাগা বা বোরনের অভাবে নারকেলপাতা ঠিকমতো মেলে না, কুঁকড়ে থাকে। গাছের হলদেটে ভাব বা ম্যাগ্নেসিয়ামের অভাবজনিত লক্ষণ বলে প্রমাণিত, তার সমস্যা হলে গাছ প্রতি পাঁচশ গ্রাম ম্যাগ্নেসিয়াম সালফেট প্রয়োগ করতে হবে। বৈশাখ মাসে নারকেলের পত্ৰল-মাথা অংশের পরিচ্ছন্নতা জরুরী। গন্ডারে-পোকা হানা দিতে পারে। মাথায় ছিদ্র দেখা গেলে তাতে হুঁক ঢুকিয়ে পোকা বার করতে হবে। গাছের প্রথম তিন পত্রল অংশের খাঁজে দিতে হবে বালির সঙ্গে মিশিয়ে ২৫০ গ্রামের মত নিমখোল।
কাজুবাদাম : কাজুর এলাগাছ (রুটস্টক) তৈরির জন্য বৈশাখ মাস উপযুক্ত সময়। কারণ এই সময় ফল পাকে। ফল ও বীজ দেখে কাজুর পরশাখী গাছ (সায়ন স্টিক) চিহ্নিত করে নেবারও এটা সময়। বীজের জন্য মা-গাছগুলিকে বেছে রাখা দরকার। তা থেকে মাঝারি ওজনের (৬-৭ গ্রাম) বীজ সংগ্রহ করতে হবে। সংগৃহীত বীজগুলি ২-৩ দিন রোদে শুকিয়ে নিতে হবে। বীজতলায় বীজগুলি তাড়াতাড়ি ফেলা দরকার, নইলে অঙ্কুরোদগম হ্রাস পায়। ১২ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে বীজগুলির বোঁটার অংশ উপর মুখী করে পলিথিন প্যাকেটে রক্ষিত মাটিতে আড়াই সেন্টিমিটার গভীরে ফেলা দরকার। তারপর চাপিয়ে দিতে হবে সামান্য খড় যা কল বেরোলে বিশ-ত্রিশ দিন পর তুলে নিতে হবে।
পুঁই ঃ বৈশাখ এবং জ্যৈষ্ঠমাস বর্ষার পুঁইয়ের বীজ ফেলার আদর্শ সময়। পুকুরের পাঁক তুলে শুকিয়ে জমিতে দিলে পুঁই-এর বৃদ্ধি ভাল হয়।তাই অনেক চাষীকে দেখা যায় ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখ মাসে শুকিয়ে যাওয়া পঙ্কিল পুকুরে মাদা করে পুঁই-এর বীজ বুনতে। বর্ষার জল পুকুরে জমার আগেই একপ্রস্ত ফসল নেওয়া হয়ে যায়। অনেকে জলভরা পুকুরের পাড়ে বা নয়ানজুলির ধারে পুঁই লাগিয়ে তার মাচা পুকুর বা জলাশয়ের উপর তুলে দেন, তাতে আলাদা করে জমিও দরকার হয় না, পুকুরের জল ঠান্ডা থাকে, মাছেদের আরাম হয়, বেশিদিন জল ধরে রাখা যায়। যাইহোক, পুঁই-এর মাটি বেশ কয়েকবার চাষ দিয়ে গুঁড়ো ও ঝুরঝুরো করে নিতে হবে। সেই জমিতে মিশিয়ে দিতে হবে বিঘা প্রতি ১০ গাড়ির মত খামার পচা সার, কেঁচোসার বা ভার্মি কম্পোষ্ট অথবা গোবর সার। শেষ চাষে মেশাতে হবে বিঘা প্রতি কুড়ি কেজির মত ইউরিয়া, চার কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং আট কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ।
এক বিঘা জমিতে দু’কেজি পুঁই বীজ লাগবে। বীজ শোধন করে নিতে হবে। বীজ শোধনের জন্য প্রতি কেজি বীজে ৪ গ্রাম থাইরাম অথবা ম্যাঙ্কজেব বা ক্যাপটান অথবা ৩ গ্রাম কার্বেণ্ডাজিম মেশানো দরকার। জৈব পদ্ধতিতে প্রতি কেজি বীজে পাঁচ গ্রাম হারে ট্রাইকোডারমা ভিরিডি এবং সিউডোমোনাস ফ্লুরোসেন্স নামক জীবাণু মিশিয়ে শোধন করা যায়। এদের দ্রবণে বীজ ভিজিয়ে ছায়ায় শুকিয়েও বীজ বপন করা যায়। এতে প্রাথমিক অবস্থায় পুঁইয়ে গোড়া পচা এবং পাতার বাদামি-দাগ রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। পুঁই লাগানো হয় সারিতে, ভেলিতে বা মাদায়। বীজ বোনা ছাড়াও অনেকে তৈরি চারা মূল জমিতে বসান। পনেরো থেকে ত্রিশ সেন্টিমিটার লম্বা চারা ৯০ x৬০ সেন্টিমিটার দূরত্বে বসাতে হবে। বীজ বোনার তিন ও ছয় সপ্তাহ বাদে বিঘা প্রতি দশ কেজি হারে ইউরিয়া চাপান সার দিলে পুঁইয়ে ডগমগে যৌবন লক্ষ্য করা যায়। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠমাসের ঝড়বৃষ্টিতে কিছুটা সেচের প্রয়োজন মেটে, তবে জমিতে আদ্রর্তার ঘাটতি হলে পাঁচ-ছয় দিন অন্তর হালকা সেচ দিতে হবে। মাঠের নিকাশী বন্দোবস্তু ঠিক হওয়া দরকার। জমিতে প্রাথমিক অবস্থায় নিড়ানি দেবার সময় ঘন গাছ তুলে পাতলা করতে হয়। এই গাছ বাজারে ভালো দরে বিকোয়। প্রতি বিঘায় যিনি ত্রিশ কুইন্টাল পুঁই তুলতে পারেন, তিনিই ভালচাষি।
কচু ঃ বৈশাখ মাস কচু লাগানোর সময়। ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠমাস পর্যন্ত কচু রোয়া যাবে। কালী, ধলী ভাল জাত। প্রতি বিঘায় বীজ-কচু লাগবে ৭০ থেকে ১৪০ কেজি। ৬০x৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে কচু লাগাতে হবে। বিঘা প্রতি ১৫, ২৫ এবং ৭ কেজি করে যথাক্রমে ইউরিয়া, সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং মিউরিয়েট অব পটাশ প্রাথমিক সার দিন। যারা চৈত্রমাসে কচু লাগিয়েছেন তারা বৈশাখ মাসে (রোয়ার একমাস পর) ১৫ কেজি ইউরিয়া চাপানসার হিসাবে দিন।
ওল ঃ বৈশাখ মাস ওল লাগানোর সময়, চৈত্রমাসেও লাগানো শুরু করা যায়। সাঁতরাগাছি, কাভুর প্রভৃতি ভাল জাত। বিঘায় ১২০ কেজি বীজ-ওল লাগবে ৭৫x৭৫ সেন্টিমিটার দুরে ওলের কন্দ লাগাতে হবে। প্রাথমিক সার হিসাবে বিঘায় যথাক্রমে ১৫, ৫০ এবং ২২কেজি হারে ইউরিয়া, সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং মিউরিয়েট অব পটাশ লাগবে। যারা চৈত্রমাসে ওল লাগিয়েছেন তারা বৈশাখ মাসে (এক মাস বাদে) বিঘা প্রতি ১২ কেজি চাপান সার দিন।
ভিণ্ডি ঃ বর্ষাকালীন ভিণ্ডি চাষের জন্য বৈশাখ মাস থেকে ভিণ্ডির বীজ বোনা শুরু হবে। আষাঢ় মাস পর্যন্ত তা বোনা যায়। বীজের হার হেক্টর (সাড়ে সাত বিঘা) প্রতি ১০কেজি; চারার দূরত্ব ৬০x৪৫ সেমি অথবা ৬০x৩০ অথবা ৪৫x৩০ সেমি। ০.২ শতাংশ ব্যভিষ্টিন দ্রবণে ভিজিয়ে বীজ শোধন করলে ঢলে পড়া রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। প্রতি হেক্টরে ৫০ থেকে ৭০ হাজার চারা থাকে। বীজ বোনার আগে হেক্টর প্রতি ২০ থেকে ২২ কেজি ফিউরাডান ৩ জি কীটনাশক দানা ছড়ালে নানান কীটশত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে।
লাউ-কুমড়ো বর্ষার লাউ পেতে হলে বৈশাখ মাসে বীজ বুনুন, তা জ্যৈষ্ঠমাসেও বোনা যাবে। দূরত্ব রাখুন ১ মিটার ৮০ সেন্টিমিটার ×১ মিটার ২০ সেন্টিমিটার। লাউ-এর উন্নত জাত হল পুসা সামার প্রলিফিক লং, পুসা সামার প্রলিফিক রাউণ্ড, পুসা মঞ্জরি, পুসা নবীন, অর্ক বাহার ও নানান হাইব্রিড বা সংকর জাত। পাহাড়ী এলাকায় যারা চৈত্রমাসে লাউ ও কুমড়ো বুনেছেন তারা বৈশাখ মাসে (বোনার এক মাসের মাথায়) প্রথমবার এবং জ্যৈষ্ঠমাসে (বোনার দুমাস পর) দ্বিতীয় বার চাপান সার হিসাবে নাইট্রোজেন দিন। চাপান সার হিসাবে প্রতিবার হেক্টর প্রতি (সাড়ে সাত বিঘা) সাড়ে বারো থেকে পনেরো কেজি করে নাইট্রোজেন দিতে হবে। নাইট্রোজেনকে ইউরিয়াতে হিসাব করতে হলে ২.২ দিনে গুণ করুন।
রজনীগন্ধা ফুল ঃ বৈশাখ মাস রজনীগন্ধার কন্দ বা গেঁড়ো লাগানোর সময়। এই কাজ চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। রজনীগন্ধায় সিঙ্গল এবং ডবল এই দুই ধরনের ফুল দেখা যায় দেশীয় বাজারে সিঙ্গল জাতগুলির চাহিদা বেশী। ক্যালকাটা সিঙ্গল জাত ছেড়ে ধীরে ধীরে প্রোজ্জল, ফুলে রজনী, অর্কা নিরন্তর, শৃঙ্গার, শুভাষিণী, রজতরেখা, স্বর্ণরেখা ইত্যাদি জাত চাষ করতে হবে। প্রতি বিঘায় তেত্রিশ হাজারের মত কন্দ লাগবে। কন্দগুলি ২০x২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লাগাতে হবে। প্রতি ৬টি সারির পর একটি ফাঁকা সারি থাকলে তা পরবর্তী পরিচর্যায় সুবিধা হবে। মূল সার হিসাবে জমিতে বিঘা প্রতি ২-৩টন জৈব সার, ২২ কেজি ইউরিয়া, ৬২ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ২৫ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ লাগবে। যারা চৈত্রের মাঝামাঝি কন্দ রোপণ করেছেন তারা বৈশাখের একেবারে শেষে বিঘা প্রতি ২৫ কেজি ইউরিয়া অথবা ৬০ কেজি খোল প্রয়োগ করুন। ফুলের গুণগত মান বাড়াতে ২ শতাংশ জিঙ্ক সালফেট স্প্রে করা দরকার।
বেল ও জুইফুলঃ বৈশাখ মাস বেল ও জুঁই-এর কাটিং বসানোর সময়। এই কাটিং বসানোর কাজ জ্যৈষ্ঠমাস অবধি চলবে। বেলফুলের ভালো জাত হচ্ছে রাই, মোতিয়া, ভরিয়া, চীনা, জাপানী প্রভৃতি। জুই ফুলের মধ্যে সিঙ্গল ও ডবল জুঁই উল্লেখযোগ্য। বেলফুলের কাটিং লাগবে বিঘাতে সাড়ে ছয় হাজার, জুঁই-এর ক্ষেত্রে প্রায় আড়াই হাজার। ৪৫x৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে বেল আর ৭৫২৭৫ সেন্টিমিটার দুরত্বে জুঁই লাগানো হয়। শেষ চাষের সময় বিঘা প্রতি ২ থেকে ৩টন জৈবসার, ৩৩ কেজি ইউরিয়া, ১২৫ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট এবং ৪২ কেজি মিউরিয়েট অব পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। আষাঢ় মাসে (চারা লাগানোর দুমাস পর) বিঘা প্রতি ৩৩ কেজি ইউরিয়া চাপান সার হিসাবে প্রয়োেগ করতে হবে।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.