কাটমানি খাওয়ার কায়দা, তিন পথের কথা খোলসা করলেন যাঁরা ঘুষ দেন কিংবা খান

কাটমানি, কাটমানি, কাটমানি। রাজ্যে এখন কান পাতলে একটাই আওয়াজ। চায়ের দোকান থেকে কফি শপ, ভিড় ঠাসা ট্রেন থেকে ফেসবুক- সর্বত্র কাটমানি নিয়ে ক্ষোভ, টিপ্পনি, ঝড়। রাজনীতিকরা কেউ নিন্দা করছেন, কেউ হাততালি দিচ্ছেন। কিন্তু এই কাটমানি ঠিক কীভাবে খাওয়া হয়? সাধারণ মানুষের থেকে ঠিক কোন পদ্ধতিতে শাসকদলের বড়-মেজো-ছোট নেতারা কাটমানি নিলেন? কমিশন আর কাটমানি কি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ? এমনই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল কাটমানির তিন নিন্দনীয় পথ।

না, এই নিয়ে যাঁরা কথা বলেছেন তাঁদের নামধাম বলে দেওয়া যাবে না। বিপদের আশঙ্কায় সকলেই কথা বলেছেন গোপনীয়তা রক্ষার বিশ্বাসে ভরসা রেখে। রাজ্যের এক পুর কাউন্সিলার স্পষ্টই স্বীকার করলেন কাটমানির কথা। সঙ্গে বললেন এটা সিস্টেমের মধ্যেই ঢুকে রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে ঠিকাদারি সংস্থার থেকে কমিশনকে যদি কাটমানি বলা হয় তবে সেটা ওপর থেকে নীচ সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। আর এতে শুধু জনপ্রতিনিধিরাই নন, জড়িয়ে আছেন একটা বড় অংশের প্রশাসনিক কর্তারাও।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য কমিশনের কথা বলেননি। তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন জনপ্রতিনিধিদের কথা আর কাটমানির কথা। যেটা অনৈতিক ভাবে নেওয়া হয়ে থাকে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের সুবিধাভোগীর থেকে। আর সেটা বাংলার শহরাঞ্চলে সব থেকে বেশি হয়েছে ‘হাউজিং ফর অল’ প্রকল্প থেকে।

শহরের গরিব মানুষের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ‘হাউজিং ফর অল’ প্রকল্প চালু হয়। ২০২২ সালের মধ্যে দেশে সব পরিবারের নিজস্ব বাড়ির লক্ষ্য নিয়েই এই প্রকল্প। এই প্রকল্পে অর্ধেকের বেশি টাকা রাজ্য সরকারকে দিতে হওয়ার যুক্তিতে রাজ্য এর নাম বদলে দেয় ‘বাংলার বাড়ি’৷

শহরাঞ্চলে এই প্রকল্পে উপভোক্তা প্রতি ৩ লক্ষ ৬৮ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে কেন্দ্র দেয় ১ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা এবং রাজ্যের তরফে দেওয়া হয় ১ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকা। এই প্রকল্পে ২৫ হাজার টাকা দিতে হয় উপভোক্তাকে। ৩৪০ বর্গফুটের বাড়ি তৈরির জন্য টাকা দেওয়া হয়। নিজস্ব বা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমি থাকা বাধ্যতামূলক। এই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার জন্য আর কোনও আয়ের সার্টিফিকেট লাগে না। টাকা দেওয়া হয় মোট চার পর্বে। ভিত তৈরি, লিন্টন ঢালাই, ছাদ ঢালাই এবং বাড়ি সম্পূর্ণ হওয়ার পরে টাকা দেওয়া হয় অ্যাকাউন্টে।

সরাসরি সুবিধাভোগীর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকলেও এর মধ্যেই কাটমানি দেওয়া নেওয়ার অভিযোগ উঠছে। কিন্তু কী ভাবে সেই টাকা দেওয়া-নেওয়া হয়? খোঁজ নিতে গিয়ে তিন পথের সন্ধান মিলল। শাসকদলের একাধিক নেতাই বুঝিয়ে দিলেন কী ভাবে সুবিধাভোগী সুবিধা মেলার মুল্য চোকান। একই সুর ও স্বর সোনা গেল কাটমানি দাতাদের গলাতেও।

পথ– ১

কাটমানি নেওয়ার জন্য সব থেকে সফট টার্গেট অসচেতন গ্রাহক। সাধারণত সেই সব গরীব মানুষ, যাঁরা বিশ্বাসই করতে পারেন না যে, কোনও কিছু না দিয়ে কোনও কিছু আদৌ পাওয়া যেতে পারে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন মানুষের থেকে পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে উল্টে টাকা নেওয়া যায় খুব সহজে। টাকার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও তাঁরা টাকা দেন। অল্প অল্প করে অনেকের থেকে পাওয়া টাকার অঙ্ক আর কম থাকে না।

পথ– ২

আর্থিক ভাবে খুব গরিব মানুষেরা সুবিধা পেতেই কাটমানি দেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সরাসরি টাকা দেওয়ার মতো ক্ষমতা থাকে না তাঁদের। প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী বাড়ির ভিত তৈরির পরে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা ঢোকে। পারিবারিক সূত্রে পৌনে এক কাঠা জমি থাকলেই মিলবে প্রকল্পের সুযোগ। কিন্তু ভিত গড়ার জন্য প্রায় ৭০ হাজার টাকা শুরুতেই খরচ করার ক্ষমতা সবার থাকে না। এই কাজটা প্রকল্পের সুবিধাভোগীরা বিনা বিনিয়োগে করতে চাইলে এগিয়ে আসেন রাজনৈতিক দাদারা। তাঁরা ঠিক করে দেন নিজস্ব ঠিকাদার। সেই ঠিকাদারের বিনিয়োগে উঠতে থাকে বাড়ি। দফায় দফায় টাকা আসে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে। সেই টাকা ঠিকাদার পেয়ে ভাগ দেন মধ্যস্থতাকারী রাজনৈতিক দাদাকে। যিনি গোটাটাই দেখাশোনা করেন যত্ন ও দায়িত্ব নিয়ে। এখানে সুবিধাভোগী সরাসরি টাকা না দিলেও ঠিকাদার বাড়ি তৈরিতে নিম্নমানের ইঁট, বালি, সিমেন্ট ব্যবহার করে লাভ বাড়ায় ও কাটমানি দেয়। পরোক্ষে যেটা সুবিধাভোগীরাই দিতে বাধ্য হয়।

পথ– ৩

এই পর্যায়ের কাটমানি আসে সুবিধাভোগীর পক্ষ থেকে সরাসরি এবং অর্থের পরিমাণও বেশি। এটা দিয়ে থাকেন তাঁরাই, যাঁদের নিজস্ব বাড়ি ছাড়াও জমি রয়েছে। ‘বাংলার বাড়ি’ বা ‘হাউস ফর অল’ কোনও প্রকল্পেই তাঁদের বাড়ি তৈরির টাকা পাওয়ার কথা নয়, আবার পেতে বাধাও নেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা রাজনৈতিক দাদা চাইলেই তিনি পেয়ে যেতে পারেন সরকারি ভর্তুকি। আর সেটা পেতে কিছু খরচ করতে পিছপা হন না এই ধরনের সুবিধাভোগীরা। গৃহহীনদের বাড়ি বানাতে যে টাকা প্রাপ্য সেটা কিছু কাটমানি দিয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বাড়ি বানিয়ে নেন অনেকেই। সেই বাড়ি এমন ভাবে প্ল্যান করা হয় যাতে সরকারি টাকা আসা পর্যন্ত সেটা ৩৪০ বর্গফুটের। পরে সেটাই অট্টালিকা হয়ে গেলে নিয়ম অনুযায়ী কিছুই বলার থাকে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.