#মৎস্যমঙ্গল

খোকা যাবে শ্বশুরবাড়ি

কী দিয়ে ভাত খেয়ে

নাদন ঘাটের পাট ট্যাংরা 

নদের বেগুন দিয়ে।।

বা 
খুকুমণির বে দেব হট্টমালার দেশে,

তারা গাই বলদে চষে,

……রুই মাছ পালঙ শাক

ভারে ভারে আসে।


কি আকুতি ! খুকুমণির বিয়েতে মণিমানিক প্রয়োজন নেই।গাই বলদ জমি চষে সোনার ধান ফলাবে। রুই আর পালং এর অভাব না ঘটলেই মেয়ের মা খুশি। দুবেলা যেন মেয়ে পেটপুরে দুটো মাছ ভাত পায়।
বাঙ্গালী জীবনের অঙ্গ মৎস। সুপ্রাচীন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মঙ্গল কাব্য , বিখ্যাত লেখকদের রচনা থেকে বঙ্গের গাঁ ঘরের ঠাকুমা ,দিদিমাদের ছেলে ভুলানো ছড়া সর্বত্র মৎস এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। একটা সময় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর সুযোগ্য সহকারী পরবর্তী প্রজন্ম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সব প্রাচীন ছড়ার সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সেই সব ছড়া পড়লে মৎসের সঙ্গে বঙ্গের আত্মিক যোগের চমৎকার সব পরিচয় মেলে।

 
একটি সংস্কৃত শ্লোক পাওয়া যায় :
ইলিশো খালিশ্চৈব ভেটকি-র্মদগূর এবচ।

রহিতো মৎসরাজেন্দ্রঃ পঞ্চ মৎস্যা নিরামিষাঃ।।

ওগগরা ভত্তা রম্ভঅ পত্তা গাইক ঘিত্তা দুগ্ধ সজুক্তা

মৌইলি মচ্ছা নলিতা গচ্ছা দিজ্জই কান্তা খা(ই) পুনবন্তা।”

অর্থাৎ, যে রমণী কলাপাতায় গরম ভাত, ঘি, মৌরলা মাছ এবং এবং নলিতা অর্থাৎ পাট শাক পরিবেশন করে স্বামীকে খাওয়ায়, সেই স্বামী ভাগ্যবান। 

পাহাড়পুর এবং ময়নামতীর পোড়ামাটির ফলকগুলিতে প্রাচীন বাঙ্গালীর মৎসপ্রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। মাছ কোটা এবং ঝুড়িতে ভরে মাছ হাতে নিয়ে যাওয়ার অত্যন্ত দুটি বাস্তবচিত্র কয়েকটি ফলকে খোদাই করা আছে।  #নৈষধ্যকাব্য গ্রন্থে নলদময়ন্তীর বিবাহভোজে নানা প্রকারের মাছ ও মাংসের সুস্বাদু এবং সুগন্ধী এতদ পরিমান ছিল যে খেয়ে শেষ করা তো দূর , সেই সব পদের সংখ্যা গুনেও শেষ করা যায় নি।

বঙ্গে মানে বাঙ্গালীর জীবনে একটি প্রবাদ আছে “মাছের নামে গাছও হাঁ করে”। সাধারণ মানে খেটে খাওয়া বঙ্গবাসীর মা অন্নপূর্ণার নিকট একটিই চাহিদা যেন তাঁর সন্তান থাকে দুধে ভাতে … অথবা ডালে ভাতে আর থাকে মাছে ভাতে।

চিরকালের প্রাণের রাময়নকে  বাঙ্গালীর কবি কৃত্তিবাস ওঝা পঞ্চদশ শতকে বাঙ্গালীর হাতে তুলে দিয়ে হৃদয় জয় করেছেন। ভক্তপ্রাণ বাঙ্গালী পাঠকের নিকট আজ এই গ্রন্থটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে পূজিত হয়। তবে বাংলায় বহু কবি এই রামায়ন রচনায় আত্মোনিয়োগ করেন। তো বাঙ্গালী কবি কৃত্তিবাস ওঝা তাঁর রামায়নে বাঙ্গালীর অতি প্রিয় মৎসের কথা উল্লেখ করতে দ্বিধা বোধ করেন নি।

 ‘ভাল মত্স্য আন সবে রোহিত চিতল।

শিরে বোঝা কান্ধে ভার বহরে সকল।’

অরণ্য কাণ্ডে কবন্ধ দৈত্য লক্ষ্মণকে পম্পা সরোবরে বড় কাঁটাওলা মাছের সঙ্গে মাছের রাজা রুই পাওয়া যাবে এবং সেই মাছ কেমন করে  ধরতে হবে , রন্ধন করতে হবে সেই পরামর্শ দিচ্ছেন। 

পঞ্চদশ শতকের শেষভাগে #বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল এবং ষোড়শ শতকের সূচনার সময় রচিত #দ্বিজবংশীদাসের মনসামঙ্গল কাব্যের পাতায় আছে মৎসের উল্লেখ। বঙ্গের নদ ,নদী ,নালা, খাল, বিল, পুকুর, দীঘি পরিপূর্ণ রূপালী শস্যতে। তাই বঙ্গবাসীর শ্ৰী বৃদ্ধির অন্যতম কারণও ছিল অন্ন এবং মৎস্য। নানা জাত, নানা প্রজাতি , নানা স্বাদের অজস্র মৎস্য রন্ধনে বাঙ্গালী ছিলেন সিদ্ধ হস্ত । তাই বোধয় জাতবর্মাকে বিবাহ করে বীরশ্ৰী মৎস্য রন্ধনে পটীয়সী হয়ে উঠেছিলেন।

মনসামঙ্গল কাব্যে কবি বিজয়গুপ্ত লিখেছেন –

মৎস্য মাংস কাটিয়া থুইল ভাগ ভাগ। 

রোহিত মৎস্য দিয়া রান্ধে কলতার আগ। ।

মাগুর মৎস্য দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ।

ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুল মাছ।।

 ভিতরে মরিচ গুঁড়ো বাহিরে জুড়ায় সুতা।

তৈলে পাক করিয়া রান্ধে চিংড়ির মাথা।।

 ভাজিল রোহিত আর চিতলের কোল। 

কৈ মৎস্য দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।।

ডুম ডুম করিয়া ছেঁচিয়া দিল টই।

ছাইল খসাইয়া রান্ধে বাইন মৎস্য টক।।

কত রকমের মাছ রান্নার কথা তাই না ? দ্বিজবংশীদাসও তাঁর মনসা মঙ্গলকাব্যে বলেছেন :

নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া।

মেস্যর ব্যঞ্জন রান্ধে তৈল পাক দিয়া

বড় বড় কই মৎস্য, ঘন ঘন আঞ্জি

জিরা লঙ্গ মাখিয়া তুলিল তৈলে ভাজি।

কাতলের কোল ভাজে, মাগুরের চাকি।

চিতলের কোল ভাজে রসবাস মাখি

ইলিশ তলিত করে, বাচা ও ভাঙ্গনা।

শউলের খণ্ড ভাজে আর শউল পোনা

বড় বড় ইচা মৎস্য করিল তলিত।

রিঠা পুঠা ভাজিলেক তৈলের সহিত

বেত আগ পলিয়া চুঁচরা মৎস্য দিয়া।

শক্ত ব্যঞ্জন রান্ধে আদা বাটিয়া

পাবদা মৎস্য দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল।

পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল…

১৬৩৮ থেকে ৩৯ ক্ষেমানন্দ লিখলেন মনসামঙ্গল। সেখানে তিনি লিখলেন :

অগাধ সলিলে ফেলিল জাল।

ধরিল মদগুর শকুল শাল।।

ইলশা ধরিল কাতলাগুটি।

ভেটকি ধরিল সরলপুঁটি।।

চিথল চীঙ্গর মারিল গদা।

কোদালি গানল ভান্ডীর ভেদা।।

যদিও এই সব উক্ত মৎস্যগুলি বাঙ্গালীর চেনা ,তবে এর কতগুলি বাঙ্গালীর পাতে আজকাল পড়ে তা বিতর্কিত বিষয়। 

১৭১১ -১২ খ্রিস্টাব্দে রামেশ্বর চক্রবর্তীর শিবায়ন গ্রন্থে উল্লেখ হল মাছের রকমারীর একবৃহৎতালিকা :

ধরেন পাবদা পুঁটি পাঙ্গাস পাধীন।

চিতল চিঙড়ি চেলা চাঁদকু্ড়ড়‍্যা মীন।।

কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী রচিত #চন্ডীমঙ্গল শ্রেষ্ঠ মঙ্গলকাব্য।অনেকেই এই চন্ডীমঙ্গলকে বাঙ্গালীর খাওয়াদাওয়ার ভাঁড়ারঘর বলে থাকেন। আমিষ থেকে নিরামিষ পদের রকমারিত্বে এবং রন্ধনকলায় ভরপুর এই মঙ্গলকাব্য।

মুকুন্দরামের ‘চন্ডীমঙ্গলে’- দেবীর আদেশে, লহনা নির্বাসিতা খুল্লনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে এনে স্নান করিয়ে ‘পঞ্চাশ ব্যঞ্জন’ রেঁধে আপ্যায়ন করলেন। মুকুন্দরাম লিখলেন- 

“ কটু তৈলে রান্ধে রামা চিতলের কোল।
রুহিতে কুমুড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।।
কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ।
মুঠো নিঙাড়িয়া তথি (তাহাতে) দিল আদারস।”

খুল্লনার বানানো কাঁটা বাদ দিয়ে শোল ও আম দিয়ে তৈরী পদ #আমশোল এখন তো বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে বন্দিত হয়। 

ভারতচন্দ্র তার অন্নদামঙ্গল-এ ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখীর ব্রাহ্মণ ভোজনের নিমিত্তে রান্নার বিবরণ দিয়েছেন এইভাবে—

নিরামিষ তেইশ রাঁধিলা অনায়াসে
আরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মৎস্য মাসে।
কাতলা ভেটুক কই কাল ভাজা কে
শিক-পোড়া ঝুরি কাঁঠালের বীজে ঝোল।
ঝাল ঝোল ভাজা রান্ধে চিতল ফলুই
কই মাগুরের ঝোল ভিন্ন ভাজে কই।
ময়া সোনা খড়কীর ঝোল ভাজা সার
চিঙ্গড়ির ঝোল ভাজা অমৃতের তার।
কণ্ঠা দিয়া রান্ধে কই কাতলার মুড়া
তিত দিয়া পচা মাছ রান্ধিলেক গুড়া।
আম দিয়া ষোল মাসে ঝোল চড়চড়ি
আড়ি রান্ধে আদারসে দিয়া ফুলবড়ি।
রুই কাতলার তৈলে রান্ধে তৈল শাক
মাছের ডিমের বড়া মৃতে দেয় ডাক।
বাচার করিল ঝোল খয়রার ভাজা
অমৃত অধিক বলে অমৃতের রাজা
সুমাছ বাছের বাছ আর মাস যত
ঝাল ঝোল চড়চড়ি ভাজা কৈল কত।
বড়া কিছু সিদ্ধ কিছু কাছিমের ডিম
গঙ্গাফল তার নাম অমৃত অসীম।

শুধু কি তাই ? #ডাকের বচনে রয়েছে কতশত মাছের কথা :

পলতা শাক রুহি মাছ।
বলে ডাক বেঞ্জন সাছ॥
মদ্‌গুর মৎস্য দাএ কুটিয়া।
হিঙ্গ আদা লবণ দিয়া॥
তেল হলদি তাহাতে দিব।
বলে ডাক বেঞ্জন খাব॥
পোনা মাছ জামিরের রসে।
কাসন্দি দিআ যে জন পরশে॥
তাহা খাইলে অরুচ্য পালাএ।
আছুক মানবের কথা
দেবের লোভ যাএ॥
ইচিলা মাছ তৈলে ভাজিয়া।
পাতি লেবু তাতে দিয়া॥
যাহাতে দেই তাতে মেলে।
হিঙ্গ মরিচ দিহ ঝোলে॥

তেমনি বাংলায় রয়েছে কত মাছ নিয়ে প্রবাদ । তার সিংহভাগই নারীসমাজকে নিয়ে :

অরাধুনীর হাতে পড়ে রুই মাছ কাঁদে, না জানি রাধুনীমোর কে

ন করে রাঁধে। অরুচির অম্বলব শীতের কম্বল বর্ষার ছাতি ভট্‌চায্যির পাঁতি(পুথি)।

 মাছের মধ্যে কই 

শাকের মধ্যে পুঁই।।

সেই যে পদ্মানদীর মাঝিতে আমরা পড়েছিলাম :

” আর অদৃষ্টের ফাঁকি দিয়ে ধরা পুঁটির ( মাছের) তেলে ভাজা পুঁটি মাছ দিয়া দিনের পর দিন আধপেটা ভাত খাইয়া থাকে।”

বা বেড়া গল্পে পড়েছিলাম, চরম দুর্ভিক্ষের মধ্যেও একটি ছোট রুইমাছ এনেছিল , বেড়ালে সেই মাছে মুখ দিতে ,আঁশ বঁটি দিয়ে বেড়ালের গলায় এক কোপ।

বা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রফুল্ল , একদশীর দিন ডোবা,খানা, খাল যেখান হতে পারত মাছ ধরে খেত। মাছ একসময় ছিল সাধবা রমণীর প্রতীক স্বরূপ।  

মৎস্য প্রেমিক বাঙ্গালীর সকল শুভ কর্মেই মাছের একটি মুখ্য ভূমিকা আছে। কারন মাছ যে মঙ্গল চিহ্নও বটে।তাই পালাপার্বণ , ব্রত কথায়, বাঙ্গালী মেয়েদের সুচারু আল্পনায় মাছের ছবি তৈজস পত্র আর শীল নোড়ায় থাকে মাছের ছাপ। মাছ বাঙ্গালী জীবনের লক্ষ্মীশ্রীর প্রতীক। এছাড়া নারকোল পুলি,  সন্দেশের ছাঁচে অথবা চিনির তৈরী মঠেও মাছের নকশা অনেক না বলা কথা বলে যায়।

বাঙ্গালীর বিবাহ অনুষ্ঠানে মাছ অপরিহার্য। আইবুড়ো ভাত খেতে গিয়ে পাত্র পাত্রী রা মাছের মুড়ো সমেত মাছের নানা রকম পদের স্বাদ পান।  বিয়ের দিন সূর্য ওঠার আগে বর ও কনের বাড়িতে দধি – মঙ্গল অনুষ্ঠানের কথাই ধরুন না কেন …অনেক বাড়িতেই ভোরে বর বা কনের পাতে দই চিঁড়ে ইত্যাদির সঙ্গে থাকে একটি রুই মাছের ল্যাজা। নিয়মরক্ষা করতে একটু মাছ মুখে ছোঁয়াতেই হয়। 

বিয়ের দিন গায়ে হলুদের তত্ত্ব যায় বরের গৃহ হতে কনের গৃহে। তাতে তেল হলুদ সিঁদুর চর্চিত হয়ে জোড়ায় , নিদেন পক্ষে একা একটি বড় রুইমাছ থাকে। কোনো কোনো বাড়িতে নিয়ম আছে বরের বাড়িতে অধিবাসের তত্ত্ব পাঠানোর। সেই তত্ত্বে ঘটা করে পাঠানো হয় বরের জন্য মলমলের ধুতি, ভান্ড ভরে দই, মিষ্টি আর একটা পেল্লায় রুইমাছ। বিয়ে বাড়িতে মাছ হয়ই। আগেও হত। দুইয়ের অধিক মাছ বা ইলিশ ,চিংড়ির বন্যা বইয়ে দেওয়া অথবা রুই বা কাতলার সঙ্গে পার্শে , পাবদা ,চিতল বা তোপসে মাছ থাকা সবেকিয়ানা এবং বনেদিয়ানার পরিচয় আজও বহন করে। সঙ্গে আজকাল তো থাকেই ভেটকি বা বাসা মাছ। বরের পাতে পড়ে একটি বৃহৎ রুইমাছের মুড়ো।

আগেকার দিনে কন্যাপক্ষের দিক থেকে কুটুম বাড়িতে তত্ত্ব পাঠানো হত। এখনো হয়। তবে তখন সেই ফুলশয্যার তত্ত্বের শেষ হতে না। সে তত্ত্ব চলত চার পাঁচ বছর ধরে।বছরে নিদেন পক্ষে অন্তত তিনটে করে তত্ত্ব করতেই হত। অনেকে আবার বারো মাসে তেরো তত্ত্ব করত। 

গরমে জৈষ্ঠ্যমাসে হত আম কাঁঠালের তত্ত্ব। আর হাত জামাই শাস্তির তত্ত্ব। জামাই ষষ্ঠীতে কেবল শ্বশুর বাড়ি তত্ত্ব পাঠালেই হত না ,জামাই বাবাজীকে নেমন্তন্ন করে চব্য চোষ‍্য‍ লেহ্য পেয় আহার করিয়ে ,পাখার বাতাস করে তবে শাশুড়ি ঠাকরুনের ছুটি। সেই জামাই আদরে গলদা চিংড়ি থেকে মৌরলা মাছ এবং তৎসহ মাছের মুড়োর ভূমিকা থাকত অপরিসীম। আসত আষাঢ়। যেত দুইটি তত্ত্ব। একটি রথের ,অপরটি ইলিশ মাছের। 

তারপর বাঙ্গালী বিবাহের আরো অনুষ্ঠানে মাছের ভূমিকা মুখ্য থাকে। নতুন বউ প্রথম শ্বশুর বাড়িতে পা দিলে কুসুমদোলার সময় দুধে আলতায় পা রেখে , কাঁখে কলসী তোলে আর হাতে ধরে নেয় ল্যাটা মাছ। আগেকার দিনে নাকি মাছটি বউয়ের হাতে তুলে দিয়ে বলা হত , ” চেপে ধরো গো,  চেপে ধরো, সংসারের বাঁধন আটো হবে।” 

বৌভাতের দিন দুপুরে অতি যত্নে নব বধূ ঘি ভাত পরিবেশন করে করেন। সেই সময় শ্বশুর মশায়ের পাতে মাছের মুড়ো তুলে দিলে শঙ্খ বাদনের প্রথাটিও বড় সুন্দর। আবার ওই দিন যখন ভাত কাপড় হয়, বর যখন বউয়ের হাতে ভাতের থালা তুলে দেন, সেই থালায় পঞ্চ ব্যঞ্জনের সঙ্গে থাকে একটি পেল্লায় সাইজের রুই মাছের মুড়ো।

কল্যাণী দত্তের লেখা ” থোড় বড়ি খাড়া” গ্রন্থে পাওয়া যায়, আগেকার দিনে নাকি ফুলশয্যার রাতে পাঁচ এয়োর সঙ্গে ক্ষীর মুড়কি খেয়ে নতুন বউ মাছ আঁকা ছিলিমচেয় হাত ধুতেন আর তার ননদ ভাজেরা কানে কানে বলে দিতেন#মাছের_স্বপ্ন_দেখো। অর্থাৎ , মাছ এতই শুভ যে , তার স্বপ্ন দেখলে বধূ অচিরেই সন্তান সুখ লাভ করবেন। এমনই সব সংস্কার ছিল মাছকে ঘিরে সেসব দিনে।

মেয়েরা গর্ভবতী হবার পর সাত মাস বা নয় মাসে তাঁকে সাধ খাওয়ানোর প্রথাটিতেও একটি রুই মাছের ল্যাজা থাকে, যেমন নিয়ম করে থাকে পরমান্ন।

বাঙ্গালীর পূজা পার্বণে, ব্রতকথার উদযাপনে সবতেই মাছ থাকে। যেমন , সেই জয় মঙ্গলবারের মঙ্গলচন্ডীর ব্রতকথা। জয়াবতী বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রেঁধেছিল এক বিশাল বোয়াল মাছ । মনসা পূজায় মাছ উৎসর্গ না হলে মায়ের পুজো সম্পূর্ণ হয় না। তারপরে কোজাগরী লক্ষ্মী পূজায় বহু বাড়িতেই খিচুড়ি,লুচি, লাবড়া, সুজির পায়েসের সঙ্গে মাকে উৎসর্গ করা হয় জোড়া পুঁটি বা জোড়া কই মাছ। আর বাঙালদের সরস্বতী পূজায় তো জোড়া ইলিশ আবশ্যক বস্তু। এক জোড়া ইলিশ পানসুপুরী, সিঁদুর দিয়ে বরণ করে ঘরে তোলা হয় সেদিন। সেইটাই হল ইলিশের বিয়ে। সেই ইলিশে হয় লাউ দিয়ে ঝোল।

অনেক সাবেক বনেদীবাড়িতে দশমীর দিন জোড়া ইলিশ খেয়ে সে বছরের মতো ইলিশ খাওয়া বন্ধ করে দেয়।

শ্রাদ্ধের পর হয় মৎস্যমুখ করে নিয়মভঙ্গ হয়। এমনই নানা কারণে অকারণে বাঙ্গালীর সব অনুষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মাছ। যা কিছু শুভ, যা মঙ্গল, যা লক্ষ্মীশ্ৰী যুক্ত বাঙ্গালীর জীবনে তার সঙ্গেই জড়িত রয়েছে মৎস্য। 

আজকে এই এত মৎস্য আলোচনা একটি মঙ্গলকাব্যের মাছের পদ রন্ধন প্রনালীর মাধ্যমে শেষ করি । সেই রান্নার নাম হল খুল্লনার হাতে আমশোল।

উপকরণ : শোল মাছ, কাঁচা আম, হলুদ , পাঁচ ফোড়ন , শুকনো লঙ্কা, নুন, মিষ্টি, তেল।

প্রণালী : শোলমাছ সেদ্ধ করে কাঁটা বেছে নিতে হবে এবং কাঁচা আম সেদ্ধ করে চটকে নিতে হবে। এবার শুকনো খোলায় পাঁচ ফোড়ন ভেজে খানিকটা বেটে নিন।এবারে তেল গরম করে তাতে গোটা পাঁচ ফোড়ন ও শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিন। এতে বাটা পাঁচ ফোড়ন ও হলুদ দিয়ে কষাতে থাকুন। কষা হলে মাছ ও নুন দিয়ে ভালো করে নাড়ুন। এবার কাঁচা আম , সামান্য জল, নুন ও মিষ্টি দিন।নাড়াচাড়া করুন। জল মরে গেলে ঘন হলে নামিয়ে নিন। গরম গরম ভাতের সঙ্গে পরিবেশন করুন। কালবৈশাখীর দুপুর জমে যাবে।

#দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ 

  1.  কলকাতা কড়চা
  2. নুনেতে ভাতেতে ২: হারিেয় যাওয়া খাবারের গল্প
  3.  “বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে কত না ঘাটের জল”
  4. মছলিশ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.