#প্রথম_ভাগ
নমো নমস্তে ত্রিপুরারিচক্ষুষে, মখেশ্বরাণাং মখতামুপেয়ুষে।।
চরাচরাণাং জঠরেষে স্থীয়তে ত্রিধাবিভক্তায় নমোহস্তু বহ্নয়ে।।
তিনিই রুদ্র , তিনিই হলেন নিরাকার ব্রহ্ম , তিনিই মহেশ্বর , তিনিই সকল দেবগণের নিকট পৌঁছনোর আধার। তিনিই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈদিক দেবতা। #অগ্নির পবিত্রতায় Iদেবতাএবং যজ্ঞের গ্রহীতা। অগ্নি চিরতরুণ, কারণ আগুন প্রতিদিন নতুন করে জ্বালা হয় এবং তিনি অমর।অগ্নি স্বর্গ ও মর্ত্যের যোগাযোগরক্ষাকারী দেবতা। বৈদিক যজ্ঞের সঙ্গে অগ্নির নাম সংযুক্ত। তিনি যজ্ঞের আহুতি লোকান্তরে নিয়ে যান।
তাই পৃথিবীর নব সৃষ্ট ধর্ম গুলিতে অগ্নি ঈশ্বর প্রদত্ত, অগ্নিকে দেবতার নিকট হতে চুরি করে আনতে হলেও সুপ্রাচীন সনাতন ধর্মে অগ্নি অবিনশ্বর হয়ে থেকে গেছেন। তাঁকে মানবজাতি পেয়েছেন প্রকৃতির মাধ্যমে, পরে নিজে থেকে তাকে নিয়েM আপন করেছে। বিদ্যুৎ ও বজ্রের মধ্যে মানবজাতি একসময় অগ্নির করাল রূপ দর্শন করেছে। মানুষ দাবানল দেখেছে জঙ্গলে জঙ্গলে । কিন্তু সে এও দেখেছে যা সেই নিরাকার অগ্নির ভয় বিপদ অনেক দূরে থাকে। সেই নিরাকার অগ্নি অশুভ কে দূর করে , অন্ধকার কে দূর করে ,শীতলতা কে দূর করে এক পবিত্রতা প্রদান করেছে।
মানুষ আগুনকে সংগ্রহ করতে শিখেছে। পাথরে পাথরে ঘষে অগ্নির আবাহন করতে সক্ষম হয়েছে। কালক্রমে সেই অগ্নি কে নিজের ইচ্ছায় নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেল। অগ্নি কেবল মানবজাতিকে সভ্যতার প্রথম পদক্ষেপ দেখায় নি , মানবজাতিকে জীব জগতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছে।
বেদে অগ্নি পৃথিবীর দেবতা। তিনি বায়ুর দেবতা বায়ু ও আকাশের দেবতা ইন্দ্রের সঙ্গে ঋগ্বেদে অন্যতম প্রধান দেবতা হিসেবে পরিগণিত হন। তাঁর বাহন মেষ।
কিন্তু সেই সুপ্রাচীন প্রাগৈতিহাসিক কালে মানুষ নানা পন্থায় অগ্নির ব্যবহার করলে, পরে সহজ ভাবে আগুনকে কাছে পাওয়ার একমাত্র পন্থা ছিল গাছে র শুকনো ডালে ডালে ঘষা বা চকমকি পাথরে পাথরে ঘষা। এছাড়া সব ঘর গেরস্থালিতে আগুন জ্বালিয়েই রাখা মানে সঞ্চয় করে রাখা হত। যান্ত্রিক পদ্ধতিতে আগুনকে সহজ ভাবে পাওয়ার উপায় আবিষ্কার হয় এই ৫০০ খ্রিস্টাব্দ সময় কালে। সেই যন্ত্র টি হল #দেশলাই। যদিও অনেক পরে লাইটার নামক আরো একটি সহজ যন্ত্রের আবিষ্কার হয়। তবুও দেশলাই ছিল মধ্যবিত্ত মানুষের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে।
মধ্যবিত্ত , নিম্নমধ্যবিত্ত অথবা গরিব মানুষের ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রিত আগুন জ্বালাবার হাতিয়ার উপকরণ , যা কিনা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরা যায় , নিজের পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়, সেই দেশলাই বা Friction Match আবিষ্কার হয় ৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে। ওমা অবাক হলেন ? না না ১৮২৬ সালে দেশলাই আবিষ্কার হয় নি। জন ওয়াকারের নাম আবিষ্কর্তা হিসাবে যদিও উচ্চারণ করে হয় তবুও আধুনিককালের দেশলাইএর পূর্ব-পুরুষ হিসেবে ৫৭৭ খ্রীষ্টাব্দে পাইন গাছের কাঠ দিয়ে ছোট ছোট টুকরোয় সালফারের প্রয়োগ ঘটানো হয়েছিল। উত্তরাঞ্চলীয় ঝু এবং চেন, নর্দান কি এলাকায় মোতায়েনকৃত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের আহারের জন্যে শুষ্ক, দাহ্য পদার্থ প্রজ্জ্বলন, রান্না ও উত্তাপের জন্যে আগুনের দরকার পড়েছিল।
সেভাবে দেখলে দেশলাই আবিষ্কার করেন ইংরেজ বিজ্ঞানী রবার্ট বয়েল (১৬৮০ খ্রি.)। তিনিই প্রথম লক্ষ করেন, ফসফরাস প্রলেপ দেওয়া খসখসে কোনও কাগজে যদি গন্ধকের প্রলেপ দেওয়া একটি কাঠি ঘষা যায়, তবে তাতে আগুন ধরে। হামবুর্গের রসায়নবিদ হেনিগ ব্র্যান্ড ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে ফসফরাস আবিষ্কার করেন। তাঁর এই আবিষ্কার ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাঁর আবিষ্কারের ফলেই দেশলাই আবিষ্কারের পদার্থ এল।
১৬৮০ সালে রবার্ট বয়েল দেশলাই আবিষ্কারের পরও এক শতাব্দীর উপরে বিষয়টি নিয়ে কেউ গবেষণা করেননি। কারণ সে সময় ফসফরাস তৈরি করা সহজসাধ্য ছিল না। ১৮০৫ সালে ফরাসি বিজ্ঞানী জ্যাঁ সাঁসেল দেখান যে, কাঠির ডগায় পটাশিয়াম ক্লোরেট, চিনি ও আঠার মিশ্রণ লাগিয়ে কাঠিটিতে সালফিউরিক অ্যাসিড লাগালে আগুন ধরে যায়।
দেশলাই-এর ডগায় উৎপন্ন শিখা যাতে এর কাঠিতে সহজে ধরতে পারে সে জন্য ব্যবহৃত হত কাঠির ওপর গন্ধকের প্রলেপ। কিন্তু গন্ধকের ব্যবহার ব্যয়সাপেক্ষ। তাই এখন গন্ধকের বদলে প্যারাফিন ব্যবহার করা হচ্ছে।
দেশলাইয়ে সাদা ফসফরাস ব্যবহারেও দেখা গেল বিপত্তি। সাদা ফসফরাস মানব দেহের ওপর বিষের মতো ক্রিয়া করে, এ কথা জানার আগেই ফসফরাসের বিষক্রিয়ায় মারা যায় দিয়াশলাই কারখানার বহু শ্রমিক।
এ সমস্যার সমাধান পাওয়া যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাত্র কিছুকাল আগে। ১৯১১ সালে একটি আমেরিকান কোম্পানি সাদা ফসফরাস-এর বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের উপযুক্ত ফসফরাস ও গন্ধকের একটি নির্বিষ যৌগ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। বর্তমান ঘর্ষণ দিয়াশলাইয়ে প্রত্যক্ষ ভাবে রবার্ট বয়েল জড়িত না থাকলেও পরোক্ষ ভাবে এটা তাঁরই অবদান। তাই তাঁকেই দেশলাইয়ের আবিষ্কারক বলা হয়।যাক , তো আমাদের দেশে বা রাজ্যে কবে এবং কারা এই দেশলাই নির্মাণ শুরু করে দেখা যাক ?
আমি একটা ছোট্ট দেশলাইয়ের কাঠি
এত নগণ্য, হয়তো চোখেও পড়ি না:
তবু জেনো
মুখে আমার উসখুস করছে বারুদ—
বুকে আমার জ্বলে উঠবার দুরন্ত উচ্ছ্বাস;
আমি একটা দেশলাইয়ের কাঠি।
তো এহেন ছোট্ট দেশলাই কাঠি নিয়ে কবি সুকান্তের জ্বালাময়ী বৈপ্লবিক কবিতা একটা সময় নব্য বাঙ্গালীর রক্ত গরম করলেও ১৯১০ সালে দেশলাই কাঠিকে কুটির শিল্প হিসাবে নিয়ে আসে ভারতে তথা কলকাতায় কয়েকটি অভিবাসী জাপানি পরিবার। তাদের কাজের সূচনা হয় খালি হাত এবং বিদ্যুৎ চালিত সাধারণ যন্ত্রের মাধ্যমে। এসব জাপানিরা কলকাতায় স্বেচ্ছায় এসেছিল নাকি কেউ কোনো উদ্দেশ্য পুরনের জন্য আনিয়ে ছিল তা নিয়ে বেশ মতান্তর আছে।
সা রে গা মা পা ধা নি
বোম ফেলেছে জাপানি…
১৯৪২ সালের ২০শে ডিসেম্বর রাত্রে জাপানিরা কোলকাতার বুকে খিদিরপুর ও বজবজে বোমাবর্ষণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন এই জাপানি বোমাবর্ষণের লক্ষ্য ছিল হাওড়া ব্রিজ ও খিদিরপুর বন্দর ধ্বংস করা। যদিও জাপানি কলকাতা ধ্বংস করতে পারে নি।
তাই জন্য বলা হত , বোমের ভেতর কেউটে সাপ
জাপানি বলে বাপরে বাপ….
যাক তো কি কারনে জাপানিরা হঠাৎ কুটির শিল্পের মতো দেশলাই বানানো শুরু করল সেসব বিতর্ক নিয়ে নাই বললাম।জাপানী বিষয়টি বিতর্কিত। কারন তার অনেক আগেই ভারত তথা কলকাতায় দেশলাই নির্মাণ শুরু হয়।
যা হোক ,স্থানীয় মানুষেরা প্রথমে গৃহশিল্প হিসাবে দেশলাই বানাতে শুরু করে এবং ক্রমে কলকতার ছোট বড় অনেক প্রতিষ্ঠান দেশলাই ব্যবসায় ব্যাপৃত হন। যেমন – দেশবন্ধু ম্যাচ ফ্যাক্টরি – ব্র্যান্ড নাম দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং বাসন্তী দেবী – ভারত কেমিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড বেলগাছিয়া।, চ্যাটার্জি সাউ এন্ড কোম্পানি – ব্র্যান্ড ভারতলক্ষ্মী , বঙ্গমাতা ম্যাচ ফ্যাক্টরি – ৭/১ মার্কুই স্ট্রিট কলকাতা , অল ইন্ডিয়া অর্ডার সাপ্লাই কোং – ব্র্যান্ড নাম ট্রাম গাড়ি , রামপুরিয়া ম্যাচ ওয়ার্কস কলকাতা – ব্র্যান্ড নাম স্বদেশী দিয়াশলাই, এস চ্যাটার্জি এন্ড কোম্পানি – ব্র্যান্ড নাম চরখা গৃহশিল্প, স্বদেশী দিয়াশলাই কার্যালয় ; বোস এন্ড কোম্পানি : বন্দেমাতরম ব্র্যান্ড ইত্যাদি।
তবে তার আগেই , ১৮৮৫ থেকে ১৮৯০ সালে বাংলায় প্রথম দেশিয় দেশলাই কারখানা গড়া হলেও তা চলেনি৷ ফলে চলতেই থাকে বিদেশি দেশলাইয়ের উপর নির্ভরতা৷ কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের ডাক দেশলাইয়ের বাজার তৈরির প্রচেষ্টা শুরু হয় নতুন করে৷ ১৯০৭ সালে ‘বন্দেমাতরম ম্যাচ ফ্যাক্টরী’ গড়ে তোলেন স্যার রাসবিহারী ঘোষ, স্যার পিসি ঘোষ এবং এপি ঘোষ৷
১৮৯৮ সালে স্বামীজিকে লেখা টাটার একটি চিঠি, যা থেকে জানা যায় যে, স্বামীজি টাটাকে প্রাচীন ভারতের আধ্যাত্মিকতার আদর্শের বিকাশ ও তাকে নষ্ট হতে না দিয়ে উপযোগী খাতে প্রবাহিত করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। এরপর উল্লেখযোগ্য বিবেকানন্দের ছোটভাই মহেন্দ্রনাথ দত্তের একটি বইয়ের [‘স্বামী বিবেকানন্দের জীবনের ঘটনাবলী’, তৃতীয় খন্ড] এমন এক দাবি যে, স্বামীজি নাকি তাঁর কোনো চিঠিতে দু’জনের এই আলোচনা সম্পর্কে লিখেছিলেন।
যদিও এখনও স্বামীজির তেমন কোনও চিঠির খোঁজ পাওয়া যায়নি, মহেন্দ্রনাথের বিবরণটি এখানে দেখা যেতে পারে। এই বিবরণ অনুযায়ী তিরিশ বছরের সন্ন্যাসী চুয়ান্ন বছর বয়স্ক শিল্পপতিকে সোজাসুজি প্রশ্ন করেছিলেন, “জাপান থেকে দেশলাই নিয়ে গিয়ে দেশে বিক্রয় করে জাপানকে টাকা দিচ্ছ কেন? তুমি তো সামান্য কিছু দস্তুরী পাও মাত্র। এর চেয়ে দেশলাইয়ের কারখানা করলে তোমারও লাভ হবে, দশটা লোকেরও প্রতিপালন হবে ও দেশের টাকা দেশে থাকবে।” (ভাষা মহেন্দ্রনাথের)। একসময় টাটা দেশলাই ব্যবসায় একচেটিয়া বাজার ধরতে সক্ষম হয়েছিল।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ কলকাতা ও বাংলার দেশলাই : গোপাল বিশ্বাস