বাংলার বারো ভুঁইয়ার এক বীর ভুঁইয়া কেদার রায় এবং তাই অগ্রজ চাঁদ রায়ের নাম বীরত্বের জন্য খ্যাতকৃত্য। যদিও বাংলার ইতিহাসে বারো ভুঁইয়াদের কাজের পুরোপুরি মূল্যায়ণ আজও হয়নি, তবুও বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শক্তিশালী মোগল বাহিনীকে মৃত্যুর শেষদিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন অসম লড়াই। অখণ্ড বাংলার মাটিতে আজও টিকে রয়েছে তাঁদের কিছু স্মৃতিচিহ্ন, যা একই সঙ্গে আমাদের গৌরবান্বিত করে, মাথা উঁচু করে বীর বাঙালির আত্মপরিচয় দেয়। এমনই এক বীর ভুঁইয়া কেদার রায়। খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে সেন আমলে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরের আড়া-ফুলিয়ায় নিজের বসতবাড়ি তৈরি করেছিলেন পেশায় রাজকর্মচারি নিম রায়। এই নিম রায়ের ষষ্ঠ পুরুষ ছিলেন যাদব রায় এবং এই যাদব রায়ের দুই পুত্র কেদার ও চাঁদ ।
বিক্রমপুর, ইদ্রাকপুর, ইদিলপুর, কেদারপুর, চাঁদপুর প্রভৃতি পদ্মানদীর দুই পাড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়েছিল এই দুই ভাইয়ের জমাদারি। তাঁদের দুই ভাইয়ের নামেই কেদারপুর ও চাঁদপুর হয়েছে। রাজধানী ছিল শ্রীপুর।
তাঁদের পারিবারিক পদবি ছিল “দে” এবং জাতিতে ছিলেন কায়স্থ।
খ্রিস্টিয় ষোলো শতকের শেষদিকে মোগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ বারো ভুঁইয়া দমনে বাংলায় আসেন।
বাংলায় সে সময় চলছিল একদিকে পাঠান-মোগল দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে মগ-ফিরিঙ্গিদের অত্যাচার। জেমস রেনেলের নকশায় (১৭৬১) দেখা যাচ্ছে, বাখরগঞ্জ জেলার গোটা দক্ষিণ অঞ্চল জুড়েই লেখা “মগদের অত্যাচারে পরিত্যক্ত জনমানবশূন্য” (” Country depopulated by the Maghs.”) এলাকা।
বিখ্যাত লবন খনি “সন্দ্বীপ” নিয়ে মগ-ফিরিঙ্গিরা কেদার রায়ের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। স্বর্ণদ্বীপ থেকে সোণাদ্বীপ এবং তা থেকে অপভ্রংশে হয়েছে “সন্দ্বীপ।”
কেদার রায় অত্যন্ত সুকৌশলে ফিরিঙ্গিদের হারিয়ে তাঁদের নেতা কার্ভালোকে নিজের দলে টেনে নেন এবং করের বিনিময়ে তাঁকে লবণ খনি ছেড়ে দেন আর তাঁকে নৌবাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব দেন।
মোগলরা লবণ খনি “সন্দ্বীপ” ঘিরে ফেলে। কেদার রায় সেখানে সেনা পাঠিয়ে মোগল সেনাকে হঠিয়ে দেন।
ওদিকে আরাকানরাজ সেলিম শা সন্দ্বীপ দখলের জন্য ১৫০ টি যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন। কিন্তু কেদার রায়ের হাতে মগবাহিনী পরাজিত হলো। যুদ্ধজাহাজগুলি কেদার রায়ের দখলে চলে এলো।
তীব্র রাগে পরের বছর ফের বিপুল সৈন্যসহ এক হাজার যুদ্ধজাহাজ পাঠালেন আরাকানরাজ।
দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হলো। সে সময়ের ইতিহাসে এটিই ছিল বড়ো নৌযুদ্ধ। যুদ্ধে দু”হাজার মগ সৈন্য নিহত হলো। হেরে গেল মগেরা।
এদিকে কেদার রায়কে দমন করতে মোগল সেনাপতি মানসিংহ মন্দা রায়কে পাঠালেন। দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হলো কালিন্দী নদীতে। কেদার রায়ের হয়ে যুদ্ধ করলেন ফিরিঙ্গি সেনাপতি কার্ভালোসহ রঘুনন্দন রায়, রামরাজা সর্দার, পোর্তুগীজ ফ্রান্সিস, কালীদাস ঢালী ও সেখ কালু। এই ভীষণ যুদ্ধে নিহত হলেন মন্দা রায়। যুদ্ধে হেরে সেবারেও মোগল সেনা পালিয়ে গেল। রক্তে লাল হয়ে উঠলো কালিন্দীর জল।
তৃতীয়বার মানসিংহ পাঠালেন কিলমক খানকে। তিনিও পরাজিত হয়ে বন্দি হলেন কেদার রায়ের হাতে।
চতুর্থবার মানসিংহ নিজে বিরাট মোগলবাহিনী নিয়ে বিক্রমপুরে এলেন।
স্থানীয় সুসঙ্গ রাজবংশের রাজা রঘুনাথ সিংহের সঙ্গে আকবরের সন্ধি ছিল। এই সন্ধির চুক্তি অনুসারে রঘুনাথ সিংহকে কেদার রায়ের বিরুদ্ধে পাঠালেন মানসিংহ।
নয়দিন ধরে যুদ্ধ চললো।
এই যুদ্ধেই রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটে কেদার রায়ের। কেউ কেউ বলেন, নবম দিনের যুদ্ধে হঠাৎ এক কামানের গোলায় মূর্ছিত হয়ে মারা যান কেদার রায়।
আবার কেউ কেউ বলেন, নবম দিনের যুদ্ধ শেষে দশম দিনের যুদ্ধ শুরু করতে যাবার আগে কেদার রায় তাঁর ইষ্টদেবী ছিন্নমস্তার মন্দিরে ধ্যানে বসেছিলেন। সেই সময় মানসিংহ গুপ্তঘাতক দিয়ে তাঁকে হত্যা করিয়েছিলেন।
দাদা চাঁদ রায় আগেই মারা গিয়েছিলেন।এরপর মানসিংহ কেদার রায়ের এক কন্যাকে বিয়ে করেন এবং তাঁর রাজ্য কেদারের সেনাপতিদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে দিল্লি ফিরে যান।
প্রজাবৎসল কেদার রায় তাঁর জমিদারী এলাকায় বহু টোল, পাঠশালা, মন্দির, সেনানিবাস ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন। সুদক্ষ সংগঠক এবং অসম সাহসী যোদ্ধা হিসেবে বাংলার ইতিহাসের পাতায় সোণার অক্ষরে লেখা থাকবে এই স্বাধীনচেতা বীর কেদার রায়ের নাম ।
কেদার রায়ের বহু কীর্তি পদ্মা নদীর গ্রাসে চলে গেছে বলে জনসাধারণের কাছে শ্রীপুর এলাকার গঙ্গার নাম হয়ে গেছে “কীর্তিনাশা।” দোষ পদ্মার নয়। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনার বিপুল জলধারা ছাড়াও বৃষ্টিপ্রবাহ এবং খাল-বিলের অগাধ জলরাশি পদ্মাকেই বহন করতে হয়। তাই তার দুরন্ত বেগ আছড়ে পড়ে নরম মাটির ওপর। তখন স্বভাবতই সামনের সবকিছু তার তোড়ে ভেসে যায়। তখন পদ্মা হয়ে যায় সত্যিই “কীর্তিনাশা।”
কেদার রায়ের নামের গ্রাম “রায়পুর” এখন হয়েছে “পুটিজুড়ি।” এর পাশেই রয়েছে দেবী দিগম্বরীর নামে দিগম্বরী দীঘি। এখানে এখনো দেবী দিগম্বরী পুজিতা হচ্ছেন। আর দীঘির কিছুটা দূরে রয়েছে পোড়া ইঁটের একটি পোড়ো বাড়ি, নাম—“ভিয়া বাড়ি।” ভু়ঁইয়া বাড়ি থেকেই নাম হয়েছে এই “ভিয়া বাড়ি।”
সব মিলিয়ে বাংলায় এক বীরত্বের নাম—বীর ভুঁইয়া কেদার রায় ।