শিল্পী বিশ্বকর্মা এবং তাঁর পূজা

বিশ্বকর্মা বৈদিক দেবতা, ঋগবেদের ১০ম মণ্ডলে ৮১ এবং ৮২ সূক্তদ্বয়ে বিশ্বকর্মার উল্লেখ আছে। ঋগবেদ অনুসারে তিনি  সর্বদর্শী এবং সর্বজ্ঞ।তাঁর  চক্ষু, মুখমণ্ডল, বাহু ও পদ সবদিকে পরিব্যাপ্ত। তিনি কল্যাণকর্মা ও বিধাতা অভিধায় ভূষিত। তিনি ধাতা ও বিশ্বদ্রষ্টা।বিশ্বকর্মা লঙ্কা নগরীর নির্মাতা। তিনি বিশ্বভুবন নির্মাণ করেন। বিষ্ণুর সুদর্শন চক্র, শিব এর ত্রিশূল, কুবের এর অস্ত্র, ইন্দ্রের বজ্র, কার্তিকেয়র শক্তি প্রভৃতি তিনি তৈরি করেছেন। শ্রীক্ষেত্রর প্রসিদ্ধ জগন্নাথ মূর্তিও তিনি নির্মাণ করেছেন।ঋগ্বেদ অনুযায়ী, তিনি পরম সত্যের প্রতিরূপ এবং সৃষ্টিশক্তির দেবতা।তাঁকে সময়ের সূত্রপাতের প্রাক্‌-অবস্থা থেকে অস্তিত্বমান স্থপতি তথা ব্রহ্মাণ্ডের দিব্য স্রষ্টা বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

           বিশ্বকর্মার পুত্র বিশ্বরূপকে ইন্দ্র বধ করেছিলেন। সমুদ্র বিশ্বকর্মার অপর পুত্র  নলকে সেতুবন্ধনের উদ্দেশ্যে রামের হাতে প্রদান করেছিলেন। নলেরই কৌশলে সমুদ্রে সেতুবন্ধন সম্পন্ন হয়েছিল। রামায়ণে উল্লিখিত বিশ্বকর্মার স্থাপত্যকীর্তিগুলি হল: কুঞ্জর পর্বতের ঋষি অগস্ত্যের ভবন, কৈলাস পর্বতে অবস্থিত কুবেরের অলকাপুরী  ও লঙ্কা নগরী। এছাড়া বিশ্বকর্মা ব্রহ্মার জন্য নানা অলংকারে সজ্জিত পুষ্পক বিমান নির্মাণ করেছিলেন। এই বিমান ব্রহ্মা কুবেরকে দান করেন এবং রাবণ তা কুবেরের থেকে অধিকার করেন।  সমুদ্রস্থিত চক্রবান পর্বতে সহস্রার চক্রও বিশ্বকর্মার সৃষ্টি। বিষ্ণু পঞ্চজন ও হয়গ্রীব নামে দুই অসুরকে বধ করে শঙ্খ ও চক্র দুটি গ্রহণ করেছিলেন। রামায়ণে একাধিক স্থলে বিশ্বকর্মার উল্লেখ পাওয়া যায়। আদিকাণ্ডে উল্লিখিত হয়েছে, বিশ্বকর্মা দুটি ধনুক নির্মাণ করেছিলেন। দেবতারা তার মধ্যে একটি ত্রিপুরাসুর বধের জন্য শিবকে এবং অপরটি বিষ্ণুকে প্রদান করেন। বিষ্ণু তার ধনুকটি প্রদান করেন পরশুরামকে। রাম শিবের ধনুকটি ভঙ্গ করে সীতাকে বিবাহ করেন এবং অপর ধনুটিতে জ্যা আরোপ করে পরশুরামের দর্প চূর্ণ করেন।ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির দিন বিশ্বকর্মার পূজা করা হয়। ভারতবর্ষে স্বর্ণকার,কর্মকার এবং দারুশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, মৃৎশিল্প প্রভৃতি শিল্পকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ নিজ নিজ কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মার পূজা করে থাকেন।

              সনাতনী সংস্কৃতিতে অন্যান্য পূজার সময় চাঁদের গতি-প্রকৃতির উপর নির্ধারিত হলেও বিশ্বকর্মার পূজার সময় সূর্যের গতি প্রকৃতির উপর নির্ভর করে নির্ধারিত হয়। এই নিয়ম অনুসারে সূর্য যখন সিংহ রাশি থেকে কন্যা রাশিতে প্রবেশ করে তখন উত্তরায়ন শুরু হয়। এই সময়েই দেবতারা নিদ্রা থেকে জেগে ওঠেন এবং বিশ্বকর্মার পূজার আয়োজন শুরু করা হয় । হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি ‘কন্যা সংক্রান্তি’ তে পড়ে।গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জী অনুসারে এটি সাধারণত প্রতি বছর ১৬ থেকে ১৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে উদযাপিত হয়। দিনটি ভারতীয় সৌর বর্ষপঞ্জি এবং বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসের শেষ দিন। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও আসাম, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা এবং ত্রিপুরা রাজ্যে এবং নেপাল ও বাংলাদেশে সাড়ম্বরে দিনটি পালিত হয়।তবে কোন কোন অঞ্চলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে দীপাবলির একদিন পর গোবর্ধন পূজার সাথেও বিশ্বকর্মা পূজা পালন করা হয়।

                 বিশ্বকর্মা পূজা মূলত কারখানা শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পালন করা হয়। কখনো বিশ্বকর্মার মূর্তি স্থাপন করে কিংবা কখনও কখনও পটে আঁকা চিত্র সামনে রেখে তাঁর পূজা করা হয়। এসময় দোকান কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠানের সকল কর্মী একসাথে এক জায়গায় জড়ো হয়ে তাঁর পূজা করে ও দিনটি উদযাপন করে। বিশ্বকর্মার সন্তুষ্টি অর্জন ও তার প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে কেবল স্থপতি সম্প্রদায় নয়, সব ধরনের কারিগর, সূতার, মিস্ত্রি, কামার-কুমার, স্বর্ণকার, শিল্প কর্মী, কারখানার শ্রমিক, ঢালাইকর সহ অনেক ধরনের পেশার মানুষ এদিন তাঁর পূজা করে। তারা আরও উন্নত ভবিষ্যতের জন্য, নিরাপদ কাজের পরিস্থিতি এবং নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সর্বোপরি নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে। আবার শ্রমিকেরা বিভিন্ন যন্ত্রপাতি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রার্থনা করে। কখনো কখনো কারিগরেরা এসব যন্ত্রপাতি বিশ্বকর্মার নামে সমর্পন করে এবং ওই সময় সেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বিরত থাকে। ইলেকট্রনিক ও ইলেকট্রিক্যাল ফার্মেও পূজা করা হয়। পুজোর দিন সকলে ছুটির মেজাজে থাকে এবং কাজে বিরতি দেওয়া হয়।  বিশেষ খাবার দাবারের ব্যাবস্থা করা হয় এবং পূজার পরে এলাকায় সমবেতভাবে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতাও আয়োজন করা হয়। বিশ্বকর্মা পূজা উপলক্ষ্যে ঘুড়ি শিল্প বিশেষভাবে প্রসিদ্ধি লাভ করে। পুজোর পরের দিন নিকটবর্তী জলাশয়ে প্রতিমা নিরঞ্জন করে মিষ্টিমুখ করে অনুষ্ঠান সমাপ্ত করা হয়।

©সুমন কুমার দত্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.