আধুনিক ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায়

আধুনিক ভারতের জনক রাজা রামমোহন রায় (The Father of Modern India) :-
250 বছর জন্মজয়ন্তীতে আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ
💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐💐
জন্ম:- 22 শে মে 1772
জন্মস্থান :- শ্রীরামপুর (মামারবাড়ী)
পৈত্রিক ভিটা:- রাধানগর গ্রাম; জেলা – হুগলী
পিতা :- রামকান্ত এবং মাতা :- তারিণী দেবী (রামকান্তের মধ্যমা স্ত্রী)
কন্যা এবং দুই পুত্র জগমোহন ও রামমোহন
“রায়”পদবীর ইতিকথা :- প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত ফারুকশিয়ারের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কাজ করতেন। সেই সূত্রে পরিবারে রায় পদবীর ব্যবহার এদের বংশ ছিল। কিন্তু রামমোহনের মাতা ছিলেন ঘর তান্ত্রিক ঘরের কন্যা।
▫️শৈশব ও শিক্ষা :- গ্রামের পাঠশালাতে তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। নয় বছর বয়সে পড়াশোনা করতে রামমোহন রায় কে পাঠানো হয় পাটনা শহরে। পাটনা সে সময়ে আরবি ও ফারসি ভাষা শিক্ষার পীঠস্থান ছিল। পরবর্তীকালে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা এবং হিন্দুধর্ম শিক্ষা করতে তিনি বেনারসে যান। সংস্কৃত শেখেন গুরু নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কার এর কাছ থেকে। তিনি 24 বছর বয়সে ইংরেজি ভাষা শিখতেও শুরু করেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যেই খুব সূক্ষ্মভাবে ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে পটু হয়ে ওঠেন। পরে গ্রিক ও হিব্রু ভাষা শেখেন।
🌷
▫️কর্মজীবন:- তরুণ বয়সে তিনি কলকাতায় মহাজনের কাজ করতেন। ১৭৯৬ সালে মাত্র 24 বছর বয়স থেকে অর্থ উপার্জন শুরু করেন। ১৮০৩ – ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ১১ বছর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারী ছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজে সিভিলিয়ান কর্মচারীদের মধ্যে সর্বাধিক ঘনিষ্ঠতা হয় জন ডিগবির সাথে। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি তিন বছর রামগড়ে মাঝখানে এক বছর ভাগলপুরে এবং পাঁচ বছর রংপুরে ছিলেন। কোম্পানির কাজে ডিগবির অধীনে তিনি দেওয়ান রূপে কাজ নির্বাহ করতেন। ১৮১৫ খ্রিষ্টাব্দে রামমোহন কলকাতায় আসেন এবং কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন তখন থেকেই প্রকাশ্যে তার সমাজ সংস্কার প্রচেষ্টা শুরু হয়।
▫️সতীদাহ প্রথা রদ এবং রামমোহন :-
বেদান্ত উপনিষদগুলি করে তিনি বলেন সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতি বহির্গত প্রমাণ করে পুস্তক লিখলেন প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ এর প্রতিবাদে রক্ষণশীল সমাজের পুস্তিকা বের হল বিধায়ক নিষেধকের সংবাদ। খ্রিস্টাব্দে নিজের মতের পক্ষে রচনা করেন বেদান্ত ভাষ্য নামে এক গ্রন্থ এরপর খ্রিস্টাব্দে সাল পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে আরো 6 টি গ্রন্থ রচনা করেন যথাক্রমে– বেদান্তসার ,কেনোপনিষদ, ঈশোপনিষদ, কঠোপনিষদ, মান্ডুক্যপনিষদ এবং মূন্ডক্যপনিষদ। এইসব বইয়ের হিন্দু ধর্মের গ্রন্থ গুলোর অংশবিশেষ বাংলায় অনুবাদ করে বিভিন্ন ধর্মীয় কুসংস্কারের অসারতা প্রমাণের চেষ্টা করেন‌।
রাজা রামমোহন রায় হিন্দু ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম ও তৈরি করতে চাননি তথাপি হিন্দু ধর্মের মূল তত্ত্ব এবং তৎকালীন সমাজে প্রচলিত ধার্মিক গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন এবং প্রকৃত হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করে সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতবাসী আত্মগৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন।
🌷🌷
▫️রামমোহনের উপর সতীদাহের প্রভাব :- ১৮০৩ সালে রামমোহনের পিতার মৃত্যু হয় ।পিতার মৃত্যুর আট বছর পর ১৮১১ সালে রামমোহনের বড় ভাই জগমোহনের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর সময় জগমোহন যুবক ছিলেন; অর্থাৎ তার স্ত্রী ছিলেন যুবতী। সতীদাহ প্রথা অনুযায়ী তার স্বামীর সাথে তাকেও পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করা হয়। রামমোহন রায় তার বৌদিকে বাঁচানো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এই ঘটনা তার মনে গভীর রেখাপাত করে এবং সতীদাহ প্রথা বন্ধের যুদ্ধ প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন।

পরবর্তীকালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক কলিকাতায় গভর্নর হিসেবে আসলে রাজা রামমোহন রায়ের সাথে সখ্যতা হয় এবং বেন্টিক রামমোহন রায়ের একেশ্বরবাদী তথা হিন্দু ধর্মের গূঢ় তত্ত্ব সম্বন্ধে আকৃষ্ট হয়। লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক এর সহায়তায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ৪ঠা ডিসেম্বর রাজা রামমোহন রায়ের উপস্থিতিতে ব্রিটিশ-ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে সতীদাহ প্রথা কে আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল ঘোষণা করা হয়।
🌷🌷🌷
▫️”হিন্দু কলেজ” প্রতিষ্ঠা :- ১৮১৬ সালে বাঙালি হিতৈষী সুইস ঘড়ি ব্যবসায়ী ডেভিড হেয়ারের সাথে আত্মীয় সভায় পরিচয় হয়। কলকাতায় ইংরেজি বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য হিন্দু কলেজের প্রস্তাব রাখেন রামমোহন রায়। এরপর ১৮১৭ সালে কলকাতার গরানহাটা হিন্দু কলেজের দ্বার উন্মোচন হয়। এটি কলকাতার উচ্চ শিক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান। যদিও রাজা রামমোহন রায় তৎকালীন হিন্দু রীতি নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তাই জন্য হিন্দু কলেজের প্রধান কমিটি থেকে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় হিন্দু কলেজের স্থাপনের প্রধান কমিটি থেকে সরে যাবার পরও রাজা রামমোহন রায় নিজেকে সর্বোত্তমভাবে এই কলেজ প্রতিষ্ঠান জন্য আনুষাঙ্গিক ভাবে সাহায্যে নিজেকে এগিয়ে দেন। এর বর্তমান নাম প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি।
🌷🌷🌷🌷
▫️ব্রাহ্মসমাজ ও রামমোহন :- বেদান্ত গ্রন্থ প্রকাশের সঙ্গে তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ একেশ্বর উপাসনার পথ দেখান এবং ১৮১৫ সালে ‘আত্মীয় সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু আত্মীয়দের নিয়ে শুরু করেন আত্মীয় সভা এরপর 1828 সালে আত্মীয় সভা কে ‘ব্রাহ্মসমাজ’ এ রূপান্তরিত করে। নিজে প্রধান থেকে তারাচাঁদ চক্রবর্তীকে সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করেন। ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়ি ভাড়া করে ব্রাহ্ম সমাজের জন্য একটি উপাসনালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এই উপাসনালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্রাহ্মধর্ম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
🌷🌷🌷🌷🌷
▫️বিলেত যাত্রা :- ১৮৩০ সালে ১৯শে নভেম্বর তিনি কলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। দিল্লির বাদশাহ ‘পুতুল সম্রাট’ দ্বিতীয় আকবর তাকে ‘রাজা’ উপাধি দেন। ১৮৩১ সালে ৮ই এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌঁছলেন। সম্ভ্রান্ত বিদ্বৎ সমাজের কাছে তাঁর প্রচুর সমাদর হয়েছিল। 1832 খ্রিস্টাব্দে শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন।
🌷🌷🌷🌷🌷🌷
▫️শেষ জীবন:- ১৮৩১ সালে মুঘল সাম্রাজ্যের দূত হিসেবে যুক্তরাজ্য ভ্রমণ করেন। ১৮৩৩ সালে ২৭শে ডিসেম্বর মেনিনজাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬১বছর বয়সে অ্যভন নদীর তীরে বিখ্যাত ব্রিস্টল শহরের স্টেপলটনে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর স্মৃতি শৌধ নির্মাণ করেন। ১৯৯৭ সালে মধ্য ব্রিস্টলে তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
🌹🌷🌹🌷
▫️বাংলা গদ্যে অবদান :- বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হলেও রামমোহন রায়কে বাংলা গদ্যের জনক হিসেবে কেউ কেউ মনে করেন।
১৮১৫- ১৮৩০ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরের মধ্যে রামমোহন রায় যাবতীয় পুস্তক রচনা করেছিলেন। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ ও ভাষ্য রচনা করেছিলেন। রামমোহন রায়ের লিখিত গ্রন্থ গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– বেদান্ত গ্রন্থ (১৮১৫);বেদান্তসার(১৮১৫); ভট্টাচার্যের সহিত বিচার(১৮১৭); গোস্বামীর সহিত বিচার(১৮১৭); সহমরণ বিষয়ক প্রবর্তক ও নিবর্তকের সংবাদ (১৮১৯); পথ্যপ্রদান (১৮২৩)
এছাড়া তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় “গৌড়ীয় ব্যাকরণ” (১৮৩৩)। এটি বাঙালির লেখা প্রথম বাংলা ব্যাকরণ। তিনি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা “সংবাদ কৌমুদী” সম্পাদন করেন। পরবর্তীকালে তিনি একাধিক পত্রিকা সম্পাদন করেছেন এসব পত্র-পত্রিকা বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশের সহায়ক হয়েছিল।
🌻🌻🌻🌻🌻🌻
▫️বিবিধ সামাজিক কাজ:-
(১)সংবাদপত্রের উপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়ে ভারতবাসীকে স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার দেবার দাবি জানিয়ে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ‘প্রেস রেগুলেশন’ এর প্রতিবাদ জানিয়ে রাজা রামমোহন রায় সুপ্রীম কোর্টে দরখাস্ত পেশ করেছিলেন । ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দের বৈষম্যমূলক ‘জুরি আইন’ বন্ধ করার জন্য এবং কৃষকদের ওপর করের বোঝা কমাবার জন্য রাজা রামমোহন রায় বহু চেষ্টা করেন ।
(২) ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির সনদ প্রাপ্তির সময় রাজা রামমোহন রায় বিলাতের পার্লামেন্টে যে প্রতিবেদন পাঠান, তা তাঁর প্রগতিশীল অর্থনৈতিক চিন্তার পরিচায়ক । তিনি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে শোষিত কৃষককুলের সপক্ষে বক্তৃতা করেছিলেন । নতুন সনদে তিনি কৃষকদের স্বার্থরক্ষা জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান ।

🙏🙏🙏

বৌদ্ধিক বিভাগ
মধ্যভাগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.