মায়ের কোলে বসেই বিলে প্রথম রামায়ণ আর মহাভারতের গল্প শোনে। রামায়ণের গল্প শুনে ছোট্ট বিলের এত ভাল লাগে যে সে রাম-সীতার একটা ছোট মাটির মূর্তি কিনে ফুল দিয়ে পুজো করত। মাঝে মধ্যে সে রামের বদলে শিবের পুজোও করত। কিন্তু আদতে সে রামায়ণ শুনতে খুব ভালবাসত। পাড়ায় কোথাও যদি রামায়ণ পাঠের আসর বসত, সেখানে বিলের দেখা মিলতই।

ছোটবেলা থেকে বিলে ধ্যান-ধ্যান খেলতে ভালবাসত। এই খেলার মধ্যেই মাঝে মাঝে ধ্যান করতে করতে সে এমন আত্মহারা হয়ে যেত, যে তার বাইরের জগৎ সম্পর্কে কোন খেয়ালই থাকত না। একদিন এইভাবে সে বাড়ির এক কোণায় এমন গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে উঠেছিল যে বহুক্ষণ তার কোন হুঁশ ছিল না। তার বাড়ির লোক শেষ পর্যন্ত ঘরের দরজা ভেঙে তাকে ঝাঁকুনি নিয়ে নিয়ে তার চেতনা ফিরিয়ে আনে।

ভবঘুরে সাধুদের সম্পর্কে বিলের খুব আগ্রহ ছিল। বাড়ির দরজায় কোন সাধু এসে দাঁড়ালেই বিলে খুব খুশি হয়ে তাকে বাড়ির ভেতর থেকে যা ইচ্ছা তাই এনে দিয়ে দিত। ঘুমাতে যাওয়ার সময়ে ছোট্ট বিলের একটা অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হত। যেইমাত্র সে তার চোখ বুঝত, তার ভ্রূ-দুটির মাঝখানে এক ঝলমলে বিন্দু দেখা দিত, যা রঙ বদলাতে থাকত, আর এক সময়ে সেই বিন্দুটি বড় হতে হতে যেন তারা সারা শরীর কে উজ্জ্বল সাদা আলোয় ধুইয়ে দিত। এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়েই ছোট্ট ছেলেটা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ত। বিলে ভাবত, সবারই বুঝি এমনি হয়।কিন্তু এটা আসলে তার ভবিষ্যতের বিশালত্বের দিকেই নির্দেশ করত।

তাই বলে ভেব না  বিলে, খুব গম্ভীর একটা ছোট্ট ছেলে ছিল। সে কিন্তু আসলে ছিল একটা খুব দুষ্টু ছোট ছেলে। সে এত দুরন্ত ছিল আর তাকে মাঝে মাঝে সামলানো এত কঠিণ হয়ে পড়ত যে তার পেছনে সবসময়ে বাড়ির দুজন দাসী বহাল ছিল। তাই তার মা মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলতেন – “আমি শিবের মত একটা ছেলে চাইলাম, আর শিব নিজে না এসে একটা ভূতকে পাঠিয়ে দিলেন।”

দুষ্টু বিলে দিদিদের-বোনেদের পেছনে লাগত, আর পেছনে তাড়া করে গেলেই খোলা নর্দমায় নেমে পড়ে তাদের মুখ ভ্যাংচাত। সে জানত, দিদিরা কিছুতেই নর্দমায় গিয়ে নামবে না।
 বাড়ির গরুটি ছিল তার খেলার সাথী, আর তার অন্য অনেক পুষ্যি ছিল- একটা বাঁদর, একটা ছাগল, একটা ময়ূর, এক ঝাঁক পায়রা আর দুই-তিনটে গিনিপিগ। বাড়ির কাজের লোকেদের মধ্যে কোচোয়ান ছিল তার বিশেষ বন্ধু, আর বিলে তার দেখাদেখি বড় হয়ে সহিস হতে চাইত —তার মনে হত, মাথায় পাগড়ি বাঁধা আর হাতে চাবুক নিয়ে জুরিগাড়ি চালানো সহিস হওয়াটা একটা দারুণ ব্যাপার!

ছয় বছর বয়সে নরেন কে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হল। কিন্তু সেখানে নানারকমের বন্ধুবান্ধবের সাথে মিশে সে আরো দুুুস্ট্মি শিখল, যে বাড়ির লোকেদের সেইসব মোটেও পছন্দ হল না। তাই তাকে বিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে এনে বাড়িতে শিক্ষক রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হল। নরেন দ্রুত নিজের পড়াশোনায় এগিয়ে যেতে লাগল।

 যখন অন্য ছেলেরা বর্ণমালা চিনতে ব্যস্ত, ততদিনে সে লিখতে পড়তে শিখে গেছে। তার স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। তার শিক্ষক বই থেকে পড়ে যেতেন, আর সেটা শুনেই তার পড়া হয়ে যেত।মাত্র সাত বছর বয়সেই সংস্কৃত ব্যকরণ বই ‘মুগ্ধবোধ’ , এবং রামায়ণ ও মহাভারতের অনেকটা করে অংশ তার মুখস্থ হয়ে গেছিল।

সাত বছর বয়সে, নরেন ভর্তি হল পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠা করা মেট্রোপলিটান ইন্‌স্‌টিটিউশনে। সেখানে তার শিক্ষকেরা সহজেই তার প্রখর বুদ্ধির আন্দাজ পেলেন। কিন্তু পরে তার ক্লাসের বন্ধুদের থেকে জানা গেছে, নরেন এত দুরন্ত ছিল যে বেশিরভাগ সময়েই তাকে তার ডেস্কে দেখতে পাওয়া যেত না।

নরেন তার বন্ধুদের খুব প্রিয়পাত্র ছিল। তার বন্ধুরা তাকে সবাই তাদের নেতা মেনে নিয়েছিল। তার পছন্দের খেলা ছিল ‘রাজার বিচারসভা’। একটা ক্লাসঘরের সব থেকে উঁচু ধাপ হত তার সিংহাসন। সেই ধাপে আর কেউ বসতে পারত না। সেখানে বসে সে তার বন্ধুদের মধ্যে থেকে মন্ত্রী, সেনাপতি, যুবরাজ, কোটাল বেছে নিয়ে নিচের ধাপগুলিতে বসাত। তারপরে সে তার দরবার চালাত আর রাজার মত বিচার করত।।
 কেউ তার কথা না শুনলেই সে তার দিকে কটমট করে তাকাত।

খেলাধূলায় তার উৎসাহের অভাব ছিল না। ইশকুলে টিফিনের ঘন্টা পড়লে, সে সবথেকে আগে খেয়ে নিয়ে সোজা খেলার মাঠে ছুটত। রোজ নিত্য নতুন খেলা খেলতে  তার ভারি ভাল লাগত। তাই সে বন্ধুদের নিয়ে মাঝে মাঝেই নতুন খেলা বানাত। বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া হলে, তারা নরেনের কাছে সমস্যার সুরাহা চাইতে আসত। 

নরেন কিন্তু আরো একটা প্রতিভা ছিল। ক্লাসে শিক্ষকেরা পড়াতে থাকতেন, আর তার ফাঁকে ফাঁকেই সে কিন্তু বন্ধুদের রামায়ণ-মহাভারতের গল্প , অথবা বাড়িতে কি কি দুষ্টুমি করেছে সেইসব গল্প বলত। 
একদিন ক্লাসে পড়ানোর সময়ে নরেন আর তার বন্ধুরা কথা বলছিল। মাস্টারমশাই হটাৎ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- বলত আমরা কি নিয়ে পড়াশোনা করছি? অন্য ছেলেরা চুপ করে রইল। কিন্তু নরেন বলে দিতে পারল তখন ক্লাসে কি পড়া হচ্ছিল। কি করে? কারণ , নরেনের সেই অদ্ভূত শক্তি ছিল যা দিয়ে সে এক সাথে একাধিক বিষয়ে মন দিতে পারত। তাই তাকে যত প্রশ্ন করা হল, সব বিষয়ে সে ঠিক ঠিক উত্তর দিল। তখন মাস্টারমশাই জিজ্ঞেস করলেন – তোমাদের মধ্যে কে কথা বলছিল? সব ছেলেরা নরেনের দিকে দেখাল। মাস্টারমশাই তো বিশ্বাসই করতে চান না। তিনি ভেবেই পেলেন না এমন ছাত্রকে কি বলবেন!

তার নির্ভয় এবং কুসংস্কারহীন চরিত্র নিয়ে আরো একটা গল্প আছে। নরেন তার এক বন্ধুর বাড়ির বাগানে একটা গাছে চড়তে খুব ভালবাসত- গাছে চড়ে সে ফুল পাড়ত; তার সাথে সে গাছের ডাল থেকে পা ঝুলিয়ে দিয়ে, মাথা নিচের দিকে করে দুলতে থাকত, আর তারপরে সোজা ডিগবাজি খেত। এইসব হইচই হওয়ার ফলে সেই বাড়ির এক বুড়ো দাদু খুব বিরক্ত হচ্ছিলেন, তাই নরেনকে নিরস্ত করার জন্য তিনি ঠিক বললেন যে ওই গাছে ভূত আছে, যে কিনা গাছে কেউ চড়লেই তার ঘাড় মটকে দেয়। নরেন চুপচাপ কথাটা শুনল। কিন্তু সেই বৃদ্ধ যেই ফিরে গেলেন, সে অমনি আবার গাছে চড়তে থাকল। তার বন্ধুরা তো বৃদ্ধের কথা শুনে ভয় পেয়ে গেছিল। তারা তাকে বারণ করতে লাগল। কিন্তু নরেন হেসে হেসে বলল -‘তুই কি গাধা রে! আরে, এই বুড়ো দাদুর গল্প সত্যি হলে তো আমার ঘাড় অনেকদিন আগেই মটকে যেত রে!’

নরেন ছিল সবার প্রিয়। পাড়ার সব পরিবার- সে ধনী হোক বা গরীব, উঁচু হোক বা নীচু জাত – সবার সাথেই তার সুন্দর সম্পর্ক ছিল। তার কোন বন্ধু যদি কোন কষ্টে পড়ত, তাহলে সে সবার আগে তাকে সান্ত্বনা দিতে যেত। সে এমন মজা -ফূর্তি করতে পারত যে এমনকি সব থেকে গম্ভীর গুরুজনেরাও তার কথায় হেসে ফেলতেন। 

নরেন একঘেয়েমি একদমই পছন্দ করত না। সে বন্ধুদের নিয়ে একটা নাটকের দল খুলে ফেলল, আর নিজের বাড়ির ঠাকুর দালানে নাটকের অভিনয় করতে শুরু করল। তার কিছুদিন পরে সে বাড়ির উঠোনে একটা কুস্তির আখড়া খুলে ফেলল, যেখানে তার বন্ধুরা নিয়মিত শরীরচর্চা করত। 
সেটা বেশ কিছুদিন চলল, যতদিন না তার এক ভাই নিজের হাত ভেঙে ফেলল। তারপরে সেটা থেমে গেল। তারপরে নরেন এক পড়শীর আখড়ায় গিয়ে যোগ দিল, আর সেখানে গিয়ে  তলোয়ার চালানো, লাঠিখেলা, নৌকা চালানো আর অন্যান্য খেলা শিখতে শুরু করল।একবার সে পাড়ার খেলার প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছিল। যখন সে এইসব নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ত, তখন সে বাড়িতে ম্যাজিক লন্ঠনের ছবি দেখাত।

এইরকম সময়ে তার ইচ্ছা হল রান্না শিখবে। সে বন্ধুদের জুটিয়ে যার যেমন সামর্থ্য চাঁদা যোগাড় করল। সব থেকে বেশি চাঁদা সেই দিল। আর সেই হল প্রধান রাঁধুনি।

 তার জীবনের মূল মন্ত্র ছিল সত্যি কথা বলা। সারাদিন সে খেলাধুলো – হই-হুল্লোড়ে সময় কাটালেও,রাতের দিকে সে ধ্যান করতে শুরু করল।
 নরেন যত বড় হতে লাগল, তার প্রকৃতিতে তত পরিবর্তন দেখা দিতে লাগল। সে নিয়মিত নানারকমের বই এবং খবরের কাগজ পড়তে শুরু করল, আর নানারকমের আলোচনা সভায় যেতে শুরু করল। ফিরে এসে সে তার বন্ধুদের সাথে সেইসব বিষয়ে নিজের মত করে আলোচনা করত। তার তর্ক-বিতর্ক করার ক্ষমতা দেখে তার বন্ধুরা হাঁ হয়ে যেত।

১৮৭৭ সালে, নরেন যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ে, তার বাবা মধ্য প্রদেশের রায়পুরে গেলেন। নরেনও সাথে গেল। রায়পুরে কোন স্কুল ছিলনা। এর ফলে নরেন তার বাবার সাথে অনেক বেশি করে সময় কাটাতে পারল। বাবার সাথে নরেনের নানা বিষয়ে আলোচনা হত।নরেনের বাবা মনে করতেন শিক্ষা মানে শুধু মাত্র অনেক তথ্য মাথায় রাখা নয়, শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হল স্বাধীন এবং উদার ভাবনাচিন্তা করতে শেখা। বিশ্বনাথ দত্তের সাথে অনেক পন্ডিত ব্যক্তি দেখা করতে আসতেন। নরেন তাঁদের আলোচনা বসে শুনত, মাঝে মাঝে আলোচনায় যোগও দিত। 

এই সময়ে সে চাইত বড়রা সবাই তার বিচার-বুদ্ধিকে যথেষ্ট সম্মান দিন। কেউ যদি তার ভাবনা-চিন্তাকে যথাযোগ্য মর্যাদা না দিত, তাহলে সে খুব রেগে যেত আর সবার সামনে সেটা প্রকাশও করে ফেলত। তার বাবা এটা সবসময়ে পছন্দ করতেন না, কিন্তু একই সাথে ছেলের এই আত্মসম্মানবোধ দেখে  মনে মনে গর্ব অনুভব করতেন।

১৮৭৯ এ বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতায় ফিরে এলেন।নরেনকে আবার স্কুলে ভর্তি করাতে একটু অসুবিধা হল, কারণ সে দুই বছর স্কুল করেনি। কিন্তু তার শিক্ষকেরা তাকে ভালবাসতেন আর তাই তাঁরা তাকে স্কুলে আবার ফিরিয়ে নিলেন। তখন নরেন পড়াশোনায় মন দিল, তিন বছরের পড়া এক বছরের মধ্যে শেষ করল, আর কলেজে ভর্তির পরীক্ষায় বেশ ভালভাবে পাশ করল।
এর পরে তো নরেন হয়ে উঠল অনেক বড় একজন মানুষ। দুনিয়াজুড়ে পরিচিত হল স্বামী বিবেকানন্দ নামে। 

তথ্যঃ
যুগনায়ক বিবেকানন্দ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.