বাঘ মনুরোথ বা কপিলামঙ্গল: গোপূজন বেদ হতে লৌকিক সুপ্রাচীন সংস্কার – পর্ব ১

পর্ব ১

ধনুঃ শতং পরী হারো গ্রামস্য স্যাৎ সমন্ততঃ।

শম্যাপাতাস্ত্রয়ো বাপি ত্রিগুণো নগরস্য তু।।

সুবিশাল অখণ্ড ভারতের বৈদিক হতে লৌকিক সমাজে সেই সুপ্রাচীন কাল হতে গাই-গোরু ভগবতী জ্ঞানে পূজিতা হয়ে আসছেন। পূর্ব কালে বিবাহ থেকে যজ্ঞানুষ্ঠান সকল ক্রিয়া কর্মে গোধন দান পুণ্য কর্ম বলে বিবেচিত হতো। গরু বা গো হলেন দুঃখ বিনাশিনী মাতা।

গো এবং শস্যধনই তো সকল ধনের শ্রেষ্ঠ ধন। বিখ্যাত পন্ডিত ও বিদেশি ভারততত্ত্ববিদেরা আমাদের সনাতন শাস্ত্রে যেখানেই গো শব্দ পেয়েছেন তার অর্থ করেছেন গরু! কিন্তু হলায়ুধ সংস্কৃত কোষে পাওয়া যায় ‘গো’ শব্দের দশটি অর্থ যার সবকটিই সংস্কৃত সাহিত্যে ও কথ্য সংস্কৃতে প্রয়োগ হয়েছে! ‘গো’ শব্দের দশটি অর্থ হল- (১) দিশা,(২) দৃষ্টি,(৩) কিরণ,(৪) স্বর্গ,(৫)বজ্র,(৬)বাণী বা বেদান্তবাক্য,(৭) বাণ,(৮)বারি,(৯)ভূমি ও (১০) গরু নামক পশু। সকলের নিকটই আমরা কোনো না কোনোভাবে কৃতজ্ঞ।

বেদে বলা হয়েছে – অঘাসু হন্যতে গাবঃ কথাটার লৌকিক সরল অর্থ হল, সুপ্রাচীন যুগ হতে গরুই ছিল  প্রধান সম্পদ, বিবাহাদিতে যৌতুক হিসাবে গরুই দান করা হত। মঘা নক্ষত্রে সূর্যের কিরণ মন্দীভূত হয়, কাজেই কন্যার পিতৃপ্রদত্ত গবাদি পশু ঐ সময়েই পতি গৃহে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হত আর অর্জুন্যো পর্য্যুহ্যতে মানে ফাল্গুনী নক্ষত্রে কন্যা স্বামী গৃহে যাত্রা করতেন।

 মাতা রুদ্রাণাং বসূনাং স্বমাদিত্যনামমৃ তস্য নাভিঃ

প্র নু বোচং চিকিতুষে জনায়,মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট।( ঋ ৮/১০১/১৫)

এর অর্থ হল গরু হল বসু, রুদ্র আদিত্যদের কন্যা, মা ও ভগিনীর সমান।গরু দুধ অমৃত দান করে।সকলে জেনে রাখ গরু,,যার অদিতি,তাকে বধ করো না।

ঘৃতং দুহানামদিতিং জনায়াগ্নে মা হিংসী পর মে ব্যোমন্।১৩/৪৬

মানে মানুষকে যে ঘৃতদান করে তার নাম অদিতি, কাজেই তাকে হিংসা কোরো না।

যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা  সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন।  তিনি অবস্থান করেন প্রতি জীবে , যাঁরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে উপকার করেন। 

বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শিলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু এবং গরু পবিত্র পশু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর।  সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব,  দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের  মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “

তাই দুগ্ধ এবং বল প্রদানকারীনী গরুকে মাতা রূপে পূজা এক অতি সুপ্রাচীন প্রথা । 

বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের পশ্চিমে এবং মানভূম এলাকায় এই গো বা ভগবতী পূজার থেকে জন্ম হয়েছিল কপিলা মঙ্গলগানের। তুর্কি আক্রমনের পরবর্তীকাল থেকে কবি ভারতচন্দ্রের মৃত্যুকাল পর্যন্ত মধ্যযুগে বঙ্গে একশ্রেণীর কাব্য রচিত হয় , যেগুলির জন্মরাজসভায় কিন্তু প্রচার হয়েছে পল্লী সভায়। এগুলিকেই মঙ্গলকাব্য বলা হয় । মঙ্গল নামক বিশেষ সুরে গায়েনদের এগুলি গাইতে হয়। এ ছাড়াও মঙ্গল নামটির বিবিধ তাৎপর্য আশুতোষ ভট্টাচার্য ব্যাখ্যা করেছেন। প্রধান ধারার মঙ্গলকাব্য ছিল তিনটি – মনসামঙ্গল , ধর্মমঙ্গল , চণ্ডীমঙ্গল। এ পাশাপাশি বহু মঙ্গলকাব্য লেখা হয়েছে। সেগুলিকে লৌকিক বা আঞ্চলিক মঙ্গলকাব্য বলা যেতে পারে। সুন্দরবনে তাই ব্যাঘ্র দেবতার জন্য যেমন লেখা হয়েছিল রায়মঙ্গল , তেমনি রাঢ়বঙ্গে রচিত হয় কপিলামঙ্গল। 

কেতকাদাস , ভরতদাস , দ্বিজকবিচন্দ্র প্রমুখ কবি কপিলামঙ্গল রচনা করেন। অন্যান্য সকল মঙ্গলকাব্যের মতো এতেও তাঁরা পৌরাণিকতার সঙ্গে লৌকিকতার সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন। লোকসমাজে ভগবতী বন্দনার মধ্যদিয়ে পশুপ্রেমের মহতী ভাবনাকে প্রচার করেছিলেন। কৃষিনির্ভর রাঢ় অঞ্চলে বহু বহুকাল ধরে প্রচলিত বাঁদনা ও খুঁটান গানগুলি থেকেই কপিলামঙ্গল কাব্যের  জন্ম। আজও রাঢ়অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে কপিলামঙ্গল কাব্য পঠিত হয়, গীত হয়। তবে সারা বছর হয় না ,হয় কর্তিক মাসের বিশেষ একটি সময়। এখনও গ্রামে গ্রামে কপিলামঙ্গল পট নিয়ে পেশাদার গায়েন দেখা যায়। সম্ভবত দ্বিজ কবিচন্ডই এই মঙ্গলকাব্যের প্রথম এবং প্রধান কবি। কারন তাঁর কাব্যই রাঢ় অঞ্চলে বহুকাল ধরে প্রচারিত হয়ে আসছে। দ্বিজ কবিচন্দ্র মল্ল রাজসভাকবি ছিলেন। তাঁর পুরো নাম ছিল শঙ্কর কবিচন্দ্র। 

ধর্ম সাহিত্যের সম্পর্কের সীমায় কপিলামঙ্গল কাব্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন বঙ্গ তথা ভারতে গোভক্তিকে কেন্দ্র করে এর সৃষ্টি হয়েছে। গো ভক্তির উৎস হল লোকসমাজে বেঁচে থাকার তাগিদ স্বরূপ কৃষিকর্ম। রাঢ়ভূমে কৃষিকেন্দ্রীক ধর্মাচারের বিষয়টি হল কপিলামঙ্গলের পশ্চাৎ পটভূমি। 

কপিলামঙ্গল গানের দুটি ধারা আছে – ১. মৌখিক এবং ২. শিষ্ট।

মৌখিক সাহিত্যের ধারাটি হল গোরু বাঁদনা ও খুঁটান গান তা পূর্বেই বলেছি। এগুলির কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো রচয়িতা নেই। শিষ্ট ভগবতী বন্দনার ধারাটি হল কপিলামঙ্গল কাব্য। এটি গেয় কাব্য। 

ভাদ্র মাস থেকে রাঢ়অঞ্চলের বাঁকুড়া , মানভূম প্রভৃতি স্থানে গোধন পূজার শুরু হয়। ভাদ্রমাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টমীতে হয় গোয়াল পূজা। এর আঞ্চলিক পরিচয় ভগবতী পূজা। সকালে গোয়ালঘর পরিছন্ন করা হয়। তারপর মাটির ছঁচ দিয়ে আল্পনা দেওয়া হয়। গোরুর খুঁটিগুলিকে মাটির বেদিতে রাখা হয়। খুঁটিগুলিতে শালুক ফুলের মালা ঝুলানো হয়। তারপর পুরুত ঠাকুর বেদির উপর ধানভর্তি একটি পাত্র বা পাই – কণা রাখেন । নৈবেদ্য স্বরূপ মুড়কি বাতাসা খই ও গুড় পিঠা সাজানো হয়। এরপর শুরু হয় মন্ত্র উচ্চারণ সহযোগে পূজা। পূজার শেষে পুরোহিত দেবী ভগবতীর উদ্দেশ্যে একটি শশা উৎসর্গ করেন। এদিন কৃষিকর্ম বন্ধ থাকে।বাড়তি পার্বণ রূপে গাঁয়ে ঘরে ঘরে গুড়পিঠা তৈরির ধূম পড়ে যায়। গোয়াল পূজা এক অর্থে গুড়পিঠা খাওয়ার পরব রূপে সমাদৃত। এই দিনই রাধাষ্ঠমী নামে সুপরিচিত। ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রাধিকার জন্ম বলে শ্রুতি আছে। 

গোয়াল পূজাতে কেবলমাত্র গাই- গরু বাঁধার খুঁটি  নয় , পাঘা , গোয়াল পরিষ্কারের ঝাঁটা, মায় গোবর তোলার ঝুড়ি কেও দেব জ্ঞানে পূজা করা হয় । শুশুনিয়া পাহাড় থেকে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে গ্রাম থুমপাথরের বাউরিয়া গোয়াল পূজা করে নিজেরাই।  তারা এই পূজায় ভালাইডালের ব্যবহার করে। ভালাই ফল হল ভেষজগুণ সম্পৃক্ত।  এর দ্বারা গোয়াল এবং গোধনের রোগ জীবাণু মুক্ত রাখা যায় , এমন বিচার সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে।

এসব ভেষজগুণের কথা নিম্নোক্ত মানভূমি ছড়ায় প্রাপ্ত হয় – 

নিম- হর্তকি_ভালা

তিন থাকিতে মরি গেলা ?

মানভূমের শুঁড়ি বা সৌমন্ডল বাড়িতে গোয়ালপূজার দিন দেবঘরে রক্ষিত  #মহাপ্রভু তথা শালু বন্দী পুঁথি সম্পদকে গোয়াল ঘরে আনা হয় এবং পূজা করা হয় ।

মাঘ মাসে রাঢ়ভূমে কৃষিকর্মের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয় জমিতে গোবর সার ছড়ানো দিয়ে। নিজ নিজ সারকুঁড় বা সারা বছর যাবৎ সঞ্চিত গোবর কুঁড়ের গোময় চাষিরা গাড়ি ভর্তি করে খেতে চালান দেয়। #কৃষিপরাশরে আছে -”  সুবর্ণ , মণিমাণিক্য অভাব ঘুচাইতে পারেনা । সকল কর্মের মধ্যে কৃষিকর্মই শ্রেষ্ঠ। অন্ন বিনা মানুষ বাঁচিতে পারে না । “

 পরাশর তাঁর কৃষিতত্ত্বের পুঁথিতে বাহন _পালনের নিদান দিয়েছেন। তিনি বলেছেন কৃষি কাজ করতে হলে গোহিতকারী হতে হবে। বাহনকে পীড়া প্রদান করা চলবেনা। ভুষিজাতীয় খাদ্য দিয়ে বাহনকে পালন করতে হবে। সকাল সন্ধ্যা বাহনকে চড়িয়ে আনতে হবে। বাহনদের প্রতিদিন গাত্র মার্জনা করে তাদের পরিচ্ছন্ন রাখতে  হবে , তৎসহ গোশালার সংস্কার আবশ্যক। প্রতিদিন দুই সান্ধ্য মুহূর্তে গোয়ালে প্রদীপ জানাতে হবে। মাঘ মাসের রোদে সড়কে শুকাতে দিতে হবে।  কারণ –  

বিনা সারে না যদ্ ধান্যং ন ফল ত্যপি।

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা

২. কপিলামঙ্গল

৩. বাংলার পট ও পটুয়া

৪. ঋগ্বেদ

৫. মনুসংহিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.