‘ছেলে নিয়ে ফূর্তি করলে নিজের মেয়েকেও জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিতাম’, নির্ভয়ার ধর্ষকদের বাঁচাচ্ছেন যে আইনজীবী

তাঁর আইনের মারপ্যাঁচে নাকানিচোবানি খেল গোটা দেশ। একবার ২২ জানুয়ারি, একবার ১ ফেব্রুয়ারি–পরপর দু’বার পিছিয়ে গেল ফাঁসি। চরম শাস্তির মুখে গিয়েও হাসতে হাসতে আদালত থেকে বেরলো নির্ভয়ার চার ধর্ষক ও নৃশংস হত্যাকারী। আসামিদের কাঁধে হাত দিয়ে ‘ভিকট্রি’ দেখালেন যে আইনজীবী, এতদিনে তাঁর নাম জেনে গেছে গোটা দেশ। প্রশংসা নয়, বরং ধিক্কারের মালা পরানো হয়েছে তাঁর গলায়। সেই এপি সিং ওরফে অজয় প্রকাশ সিং এখনও মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁর মক্কেলদের বাঁচাতে। ফাঁসির ৪৮ ঘণ্টা আগেও হার মানেননি তিনি। নতুন করে ফাঁসি রদের আর্জি জমা করেছেন দিল্লির আদালতে।

ব্যক্তিগত জীবনেও সংস্কারের ঘেরাটোপের বাইরে খুব একটা যাতায়াত নেই এপি সিংয়ের। সমাজের গতে বাঁধা ধারণাতেই আটকে তাঁর রুচি। সে কথা নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন অজয় প্রকাশ। বাড়িতে কড়া অনুশাসন তাঁর। এক ছেলে এবং এক মেয়ে, হুকুমের বাইরে যেতে পারে না কখনও। মুক্ত স্বাধীন চিন্তা তাঁর বাড়ির চৌকাঠ পেরোয়নি। নিয়মের বেড়াজালে আটকে পরিবার। তাই অবলীলায় অজয় প্রকাশ বলতে পারেন, “যে মেয়ে রাতের বেলা ছেলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে কতটা ভাল জানা আছে! এত দরদ কিসের! আমার মক্কেলদের বাঁচাবোই।”

বয়স ৪৬ বছর। লখনৌ ইউনিভার্সিটিতে আইন নিয়ে পড়াশোনা। ১৯৯৭ সাল থেকে সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি করছেন। তেমনভাবে কখনও প্রকাশ্যে আসেননি। ভাগ্যের শিকে ছেঁড়ে ২০১২ সালে। নির্ভয়ার ধর্ষকদের বাঁচাতে গিয়েই খবরের শিরোনামে চলে আসেন অজয় প্রকাশ। রাতের দিল্লি তখন এক বিভীষিকা। প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করে, যৌনাঙ্গে লোহার রড ঢুকিয়ে নৃশংস নির্যাতন করে খুন করে ছ’জন। সেই অভিশপ্ত ১৬ ডিসেম্বর। ছিন্নভিন্ন যোনি নিয়ে, ক্ষতবিক্ষত ছাত্রীর দেহ দেখে লজ্জায় মুখ ঢেকেছিল দেশ। সেই ছ‘জনের মধ্যে একজন নাবালাক আইনে ছাড়া পেয়ে যায়। বাকি পাঁচজনের মধ্যে রাম সিংয়ের রহস্যমৃত্যু হয় জেলের ভিতরেই। খবর ছড়ায় আত্মহত্যা করেছে রাম সিং। বাকি চারজন পবন গুপ্ত, অক্ষয় ঠাকুর, বিনয় শর্মা ও মুকেশ সিংয়ের বিচার শুরু হয় দিল্লির নিম্ন আদালতে।

“অক্ষয়ের স্ত্রী সেই সুদূর বিহার থেকে এসে আমার পায়ে পড়েছিল। কোথাও থেকে নম্বর পেয়েছিল হয়তো। খুব গরিব, আমি না করতে পারিনি,” এপি সিং সেই থেকেই দোষীদের পরিত্রাতার ভূমিকায়। অক্ষয় ঠাকুর, পবন গুপ্ত ও বিনয় শর্মা—তিনজনেরই আইনজীবী এপি সিং। মুকেশের অবশ্য অন্য আইনজীবী আছেন, তাঁর নাম বৃ্ন্দা গ্রোভার। এপি সিং বলেছেন, এই দোষীদের বাঁচানোর দায়িত্ব নেওয়াটা খুব একটা পছন্দ করেননি তাঁর বৃদ্ধা মা। “মা বলেছিল মেয়েটাকে ন্যায় দিতে। কিন্তু মা ও আমার স্ত্রী বাড়িতে থাকে। বাইরের কতটা জানে ওরা। এইসব প্রতিবাদ, মোমবাতি মিছিল, যন্তরমন্তরে জমায়েত দেখেইনি ওরা। বিচারের আর কী বুঝবে,” এপি সিং মায়ের কথা শোনেননি।

একদিকে পরিবার, অন্যদিকে যুক্তি, সংস্কারবদ্ধ বিচার—এপি সিং বেছে নিয়েছিলেন নিজের মতামতকেই। উল্টে তাঁর দাবি ছিল, “ওই ছেলে ও মেয়েটি নিশ্চয়ই ভাইবোন ছিল না। রাখি পরাতে রাতের বেলা রাস্তায় বার হয়নি। বিয়ের আগে যৌন সম্পর্কে জড়ায় যে মেয়েরা তাদের আমি পছন্দ করি না।” এখানেই অবশ্য তাঁর যুক্তি থেমে থাকেনি। নিজের সন্তানদের টেনে এনে এপি সিং বলেন, “আমার মেয়ে যদি বিয়ের আগে এমন ছেলে নিয়ে ফূর্তি করে বেড়াত, তাঁকে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে পরিবারের সকলের সামনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারতাম।”

দিল্লির নিম্ন আদালত যে মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল সেটা ছিল ২২ জানুয়ারি। তখনই তুরুপের তাস ছাড়েন এপি সিং। ফাঁসির রদের পিটিশন, রায় সংশোধের আর্জি তথা কিউরেটিভ পিটিশন, এরপরেও রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন, সেই আবেদন বাতিল হলে তার পাল্টা চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ফের রিভিউ পিটিশন—একে একে আইনের সবকটা অস্ত্রকে ঝুলি থেকে বার করেন তিনিই। নির্দিষ্ট সময় অন্তর আইনের নিয়ম মেনেই একটার পর একটা তাস ফেলে নিজের মক্কেলদের চরম শাস্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে চলেন অজয় প্রকাশ। প্রথমবার ফাঁসি রদ হয়, যখন সুপ্রিম কোর্টে রায় সংশোধনের আর্জি জানিয়েছিল দুই অভিযুক্ত। সেই আর্জি খারিজ হওয়ার পর দিল্লির নিম্ন আদালতের ওই মৃত্যু পরোয়ানার রায় চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে মামলা দায়ের করেছিল মুকেশ সিং। মুকেশের আইনজীবীকে সেই পরামর্শও নাকি দিয়েছিলেন এপি সিং। প্রথমবার মৃত্যু হাত থেকে বেঁচে নাকি এপি সিংয়ের পায়ে পড়েছিল অক্ষয়, বিনয় ও পবনের পরিবার। তাদের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ভগবান।

অক্ষয় ঠাকুরের রিভিউ পিটিশনে দিল্লির দূষণ, হিন্দু পুরাণ এমনকি মহাত্মা গান্ধীকে টেনে এনে উদ্ভট যুক্তি সাজিয়ে আদালতের সময় নষ্ট করার পরিকল্পনাও তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। ১৪ পাতার সেই রিভিউ পিটিশনে এপি সিং লিখেছিলেন, “বেদ, পুরাণ, উপনিষদ অনুযায়ী যুগের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ুও কমে। আগে মানুষ হাজার বছরের বেশি বাঁচত, এখন কলিযুগ। এই যুগে মানুষের আয়ু কমে ৫০-৬০ বছরে এসে ঠেকেছে। খুব কম মানুষই ৮০-৯০ বছর পর্যন্ত বাঁচেন। আয়ুই যখন কম, তখন আর মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিয়ে কী হবে!” তিনি জানতেন এমন যুক্তি নিয়ে হাসি-মস্করা হবে, আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবেন তিনি। গোটা আদালত কক্ষ যখন তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল, তাতে বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হননি অজয় প্রকাশ। নিজেই বলেছেন, বেরনোর পরে আদালত চত্বরেও আওয়াজ উঠেছিল “একেও ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেওয়া উচিত।”

এরপরেই ছিল নাবালকত্বের তাস। পবন গুপ্তকে নাবালক সাজিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে পিটিশন দাখিল করেন এপি সিং। তাতেও বিস্তর সময় নষ্ট হয়। এরপরেও এপি সিংয়ের যুক্তি ছিল, ঘটনার দিন অক্ষয় ঠাকুর দিল্লিতে ছিলেনই না। বরং বিহারে নিজের গ্রামে ছিলেন। সেখানকার বাসের ঝুটো টিকিটও আদালতে পেশ করেন। তবে সেই ভুয়ো প্রমাণ ধোপে টেকেনি। রাম সিংকে খুনকরা হয়েছে বলে আওয়াজও তোলেন সংবাদমাধ্যমের সামনে, তাতেও বিশেষ কোনও ফল হয়নি।

রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি খারিজ হবে সেটাও জানতেন বিচক্ষণ আইনজীবী। তাই তাঁর অন্য পন্থাও ভাবা ছিল। দ্বিতীয়বার ফাঁসির দিন ঠিক হওয়ার আগে যখন দীর্ঘ টালবাহানা চলছে, এপি সিং হঠাৎই রটিয়ে দেন তিহাড় জেলে তাঁর মক্কেলরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। এমনকি তাঁদের পিটিশন দাখিল করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্রও নাকি দিতে দেরি করছেন জেন কর্তৃপক্ষরা। এখানেই শেষ নয়। জেল কর্তৃপক্ষকে কাঠগড়ায় তুলে, ফের ফন্দি আঁটেন অজয় প্রকাশ। এবার মুকেশের আইনজীবী বৃন্দার সঙ্গে হাত মিলিয়ে তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেন জেলের ভিতরে যৌন নির্যাতন করা হচ্ছে চার দোষীকে। মুকেশকে দিনের পর দিন অমানবিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি অক্ষয় ঠাকুরের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক তৈরি করতে তাকে বাধ্যও করেছে জেল কর্তৃপক্ষ। এই ফন্দিও ধোপে টেকেনি। কারণ গোটা দেশের সহানুভূতি নির্ভয়ার সঙ্গেই ছিল। এখানেও নিজের বক্তব্য রাখেন অজয় প্রকাশ। দাবি তোলেন, ভোট রাজনীতির দেশের মানুষের সহানুভূতি পেতে সরকার চারজনকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চাইছে।

আর ৪৮ ঘণ্টা বাকি। ফের ফাঁসি রদের পিটিশন দাখিল করেছেন এপি সিং। দোষীদের বাঁচানোর একটা শেষ চেষ্টা করবেন তিনি। তবে এবার আইনও কঠোর। বিচারক ধর্মেন্দ্র রানা সাফ বলেই দিয়েছেন, ফাঁসি রদের আর কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ৩ মার্চ ভোর ৬টার অপেক্ষা করছে গোটা দেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.