উচ্চশিক্ষায় সিবিসিএস সিস্টেম কতটা প্রাসঙ্গিক

পিনাকী দে মল্লিক, সহকারী অধ্যাপক (নৃতত্ত্ব বিভাগ), হলদিয়া কলেজ :

উচ্চশিক্ষার বিশ্বায়নের কথা মাথায় রেখে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (UGC) চয়েস বেসড ক্রেডিট সিস্টেম শুরু করে। এই নতুন ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি সর্বপ্রথম শুরু হয় দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষ থেকেই দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় সফলতার সঙ্গে সিবিসিএস চালু করে।
ধরে নেওয়া যাক সিবিসিএস সিস্টেম ছাত্রছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব ‘পছন্দ'(choice)-এর উপর উপর নির্ভর করবে । এবং শিক্ষার মুক্তাঙ্গনে ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষার ছাত্রছাত্রীরা বিশ্বমানের প্রতিযোগিতায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হবে। পশ্চিমবঙ্গের আধা সরকারি এবং সরকারি কলেজে প্রায় বারো বছর নৃতত্ত্ব অধ্যাপনার সুবাদে আমার নিজস্ব কিছু পর্যবেক্ষণ রয়েছে যা আমি এই প্রতিবেদনে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমার এই পর্যবেক্ষণের বেশ কয়েকটি দিক রয়েছে। বিভিন্ন বিষয়ের অধ্যাপকদের সঙ্গে কথোপকথন এবং ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সংযোগের ফলে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এই দিকগুলি পরিপুষ্ট হয়েছে।
আমার এই নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত দিক গুলি বেশ কয়েকটি প্রশ্ন যা আমি প্রাসঙ্গিকতার সঙ্গে বোঝানোর চেষ্টা করেছি।

১) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নম্বর ভিত্তিক পার্সেন্টজ ভিত্তিক সিলেবাস তুলে দিয়ে নতুন সিবিসিএস সিস্টেম চালু করার আগে ভারতবর্ষের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনও সমীক্ষা করেছিল? নাকি পাখির চোখ করা হয়েছিল শুধুমাত্র দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার অন্তর্গত কলেজ গুলি? উত্তর আজও অজানা।

২) এবার আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের কথায়। এখানে কলেজের সংখ্যা পর্যাপ্ত এবং এই কলেজ গুলি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত। তফাৎ ছাত্রছাত্রীদের অভিব্যক্তি, কলেজের পরিকাঠামো, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং অন্যান্য আর্থ-সামাজিক দিকগুলি। আমি যে কলেজে নৃতত্বের অধ্যাপনা করছি তা মেদিনীপুর জেলার বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত। আমার কলেজের চিত্র হয়ত এ রাজ্যের আর পাঁচটা কলেজের অবস্থাকে পরিস্ফুট করবে। এই আশা রাখি।

৩)আমাদের কলেজে সিবিসিএস শুরু হলেও বহু অধ্যাপকের কাছেই এই বিষয়টি এখনও পরিষ্কার নয়। ছাত্রছাত্রীদের কাছে পছন্দের বিষয় বাছাই তো দূরের কথা পরীক্ষার ভারে তাদের নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। যেখানে নৃবিদ্যা স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বেশ কঠিন একটি বিষয়। আর এর কোনও ভাল পাঠ্য বই নেই। তাই জেনারেল ছাত্রছাত্রীরা যখন এই বিষয়টি বেছে নেয় এবং নৃতত্ত্ব আদতে কি তা না জেনেই নৃবিজ্ঞানের শাখাসমূহ বিস্তারিত ভাবে পড়তে বাধ্য হয়। আর এই ‘অনিচ্ছুক’ পড়ুয়াদের পড়াতে গিয়ে আগ্রহ হারান বহু অধ্যাপক।

৪) নতুন এই সিলেবাসে সমস্ত শিক্ষাক্রমই মূলত প্র্যাকটিক্যাল এবং ইন্টারনাল ভিত্তিক। ফলে সিলেবাস শেষ না হলেও চিন্তা নেই। প্র্য়াকটিক্যাল, অ্য়াটেনডেন্স এবং ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টেই নম্বর উঠে আসে। কিন্তু আমার প্ৰশ্ন এখানে, নম্বর এলেও কি শিখলাম? কেন শিখলাম? কি জানলাম? কোথা থেকে জানলাম। শিক্ষার এই মুখ্য বিষয়গুলি কি গৌণ হয়ে পড়ছে?

৫) আমাদের কলেজে একজন প্রতিনিধি আছেন। যিনি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে থাকেন। আমার প্রশ্ন, তিনি যে বিভাগের অধ্যাপক সেই বিভাগের সমস্যাগুলিকে তিনি যেভাবে তুলে ধরবেন। অন্য বিভাগের বিষয়গুলি বা সমস্যাগুলিকে তিনি কী একই ভাবে তুলে ধরতে পারবেন?

৬)সিবিসিএস-এর পঠন পাঠনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে আজ পর্যন্ত কোনও বিষয়ভিত্তিক ডেমনস্ট্রেশন দেওয়া হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে কি হবে জানা নেই। অথচ পরীক্ষার অধিকাংশ প্রশ্নই আসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু প্রদীপের তলায় যেমন অন্ধকার গাঢ় হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কলেজগুলির পরিকাঠামো তেমন প্রকট হয়ে ওঠে। আমাদের কলেজে শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বার্থে গঠিত ‘বোর্ড অফ স্টাডিজ’ আজও অপরিবর্তিত। ফলে কোন বিষয়ে কোন প্রতিনিধি তার সমস্যা তুলে ধরবেন। তার উপায় নেই।

৭) আমাদের কলেজে সিবিসিএস চালু হলেও স্নাতক স্তরে নৃতত্ত্বের সঙ্গে রসায়ন কিংবা সংখ্যাতত্ত্বের মত তথাকথিত জটিল বিজ্ঞান বিষয় পড়তে হয়। অথচ নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে জীববিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞান ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে নৃবিজ্ঞানের সঙ্গে একটি তাত্ত্বিক বিষয় থাকলে ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত হত। সেই ব্যাপারে কোনও ভাবনা চিন্তাই করা হয়নি। এরফলে পরবর্তীকালে কোর অ্য়াকাডেমিকসের কি হাল দাঁড়াবে তা আমার জানা নেই।
আমার এই ছোট প্রতিবেদনে অনেকেই হয়ত অসন্তুষ্ট হবেন। তাঁদের কাছে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই একটা দিশা খুঁজছি। তাই একমাত্র গবেষণার পরিসরই বলতে পারে সিবিসিএস ঠিক কতটা প্রাসঙ্গিক। এবং এই বিশ্বায়নের প্রতিযোগিতার যুগে ভারতের স্থান ঠিক কোথায় রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.