#পর্ব_২
লোককথা বা রূপকথা গুলির মাইগ্রেশন যে ঘটেছে তার প্রমান রয়েছে ঐতিহাসিক ভাবে।তবে দ্বিতীয় স্তরে আক্ষরিক মাইগ্রেশন সাম্প্রতিককালের , উপনিবেশ স্থাপনের পরে ক্রীতদাস আমদানির কালে।
দূর থেকে দূরান্তের প্রান্তের নানা দেশের লোককথার মধ্যে সাদৃশ্য দেখা যায় , দীর্ঘ দিনের গবেষণার ফলে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা একটি তত্ত্বে পৌঁছেছেন।এঁরা মনে করেন এইসব লোককথা রূপকথা নিরপেক্ষভাবেই লোকসমাজে সৃষ্টি হয়েছে । কোনো মাইগ্রেশনের ফলে নয়। পৃথিবীর বুকে সুপ্রাচীন মানবজাতির অসম সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটেছে। বিকাশের এইসব স্তরে মানুষ সার্বজনীন কতকগুলি অভিজ্ঞতা অর্জন করে। তাছাড়া একসময় সমগ্র পৃথিবী জুড়ে সুপ্রাচীন সনাতনী ধর্ম ও প্রথারই প্রচলন ছিল এবং দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত তার বিকৃতি হয় নি। তাই এইসব দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাকে মৌখিক সাহিত্যের রূপ দিতে গিয়ে আদি মানব সমাজ সদৃশ চিন্তাকেই প্রতিফলিত করেছিল।
পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠা প্রাচীন মানব সমাজের উর্বর ভূমিতে বৃদ্ধি পেয়ে ওঠা সব সভ্যতার অভিজ্ঞতাই এক, তাই লোককথা একই কাহিনী রূপ পায়। পার্থক্য ঘটে কেবল স্থান ও পাত্রের নামে। উক্ত নৃবিজ্ঞানীদের মতে , বিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কহীন অবস্থাতেই এইসব লোককথার জন্ম হয়েছে। পৃথিবীর অসংখ্য এলাকায় লোককথার জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে এই তত্ত্ব অবশ্যই বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক।
ভারতে পঞ্চতন্ত্র খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ থেকে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। আর অষ্টম শতাব্দী সেগুলি ভাষান্তরিত হয় সিরিয়াক এবং আরবিক ভাষায়।সেখান থেকে ই সেই পঞ্চতন্ত্র গ্রিস হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। ঈশপের নীতিকথাও খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দ নিকটবর্তী সময়কালে সংকলিত হয়।
এবার একটি কথা বলি – আজ থেকে প্রায় ২০০০ হাজার বছর আগে গ্রিক ভাস্কররা স্বেচ্ছায় বৌদ্ধমূর্তি নির্মাণে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ইতিহাসে এটি এক বিরল ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে, যে বিরল ঘটনাটি ভারতবর্ষে ‘গান্ধার’ নামে এক অভূতপূর্ব শিল্পরীতির জন্ম দিয়েছিল । এই বিস্ময়কর শিল্পরীতির মূলে রয়েছে ভারতীয় বৌদ্ধ মার্গ এবং গ্রিক শিল্পরীতির মিশ্রণ। যে কারণে গান্ধার শিল্পকে ‘গ্রিক-বৌদ্ধ’ শিল্প বলে অবহিত করা হয়। অনেকে এই শিল্পকে আবার ভারতীয় শিল্পে আরোপিত গ্রিক শিল্পরীতির স্থানীয় প্রকাশ বলে বর্ণনা করেছেন। অনেকে আবার মনে করেন, গান্ধার শিল্পের ভাস্করের অন্তরটি ছিল ভারতীয় কিন্তু হাত দু’টি ছিল গ্রিক …
গ্রিকরা গান্ধারকে বলত ‘গান্ডারীর নগর’। গান্ধারের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা । শিক্ষা ও বানিজ্যকেন্দ্র হিসাবে তক্ষশিলা সুপরিচিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি পারস্যের সম্রাট করু বা সাইরাস গান্ধার জয় করেন। পারস্য সম্রাট ডারিয়ুসের বেহিস্তান শিলালিপিতে (খ্রিস্টপূর্ব ৫২০-৫১৮) গান্ধারগন কে আকিমেনীয় সাম্রাজ্যের প্রজাপুঞ্জের অন্যতম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গ্রিসের সঙ্গে পারস্যের যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই থাকত। পারস্যের সৈন্যবাহিনীতে ‘সুতির কাপড় পরা’ ভারতীয় সৈন্যের উল্লেখ করেছেন গ্রিক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস।
খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের শুরুতে আলেকজান্দার ব্যাকট্রিয়া এবং বুখারা জয় করে সির দরিয়া অবধি অগ্রসর হন। এর পর হিন্দুকুশ পাহাড়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে মে মাসে সিন্ধু নদের নিকটে পৌঁছন। গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলা ছিল সিন্ধু নদ ও ঝিলাম নদীর মধ্যবর্তী স্থানে। ঝিলাম নদীকে গ্রিকরা বলত হাইডাসপেস। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গান্ধারের রাজা ছিলেন ট্যাকসিলিস। তিনি আলেকজান্দারের জন্য মূল্যবান উপঢৌকন পাঠান। তাঁর মৃত্যুর পর অম্ভি গান্ধারের রাজা হন। অম্ভি আলেকজান্দারে কে ৬৫ হাতি এবং ৩০০ ষাঁড় উপহার দেন।
আলেকজান্দারের ভারত আক্রমনের কিছু কাল পরে চন্দ্রগুপ্ত (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৪-৩০০) উত্তর ভারতের মগধে শক্তিশালী মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা করেন । এই বংশের শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন সম্রাট অশোক (খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩-২৩২) । অশোকের মৃত্যুর মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই মৌর্যবংশের পতনের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং সেই পতনের সুযোগে গ্রিকরা ভারতের উত্তরপশ্চিমের বিশাল অংশ জয় করে নেয়ে। অবশ্য এই সব গ্রিক আক্রমনকারীরা ইউরোপের মূলভূখন্ড থেকে আসেনি। মনে থাকার কথা খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দের শুরুতে আলেকজান্দার ব্যাকট্রিকা এবং বুখারা জয় করে সির দরিয়া অবধি অগ্রসর হয়েছিলেন। আলেকজান্দার যেখানেই যেতেন গ্রিসের আদলে নগর ও জনবসতি গড়ে তুলতেন। এসব গ্রিক মূলত ব্যাকট্রিয় গ্রিক। গান্ধার শিল্পের বিকাশ হয়েছিল এই ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের সময়ে। এর মানে, গান্ধার শিল্পের মূলে ছিল ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের শিল্পকৌশল।
ব্যাকট্রিয় গ্রিক শাসকরা ইন্দো-গ্রিক নামেও পরিচিত। ইন্দো-গ্রিক শাসকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মেনান্দার। সময়কাল: ১১৫-১৯০ খ্রিস্টপূর্ব। মেনান্দার এর জন্ম বর্তমান পাকিস্তানের শিয়ালকোট। শিয়ালকোটই ছিল মেনান্দার এর রাজধানী। ইনি বৌদ্ধ ভিক্ষু নাগার্জুনকে বৌদ্ধ মার্গ সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন। ইতিহাসে যা ‘মিলিন্দ পঞহো’ নামে পরিচিত। মেনান্দার সন্তুষ্ট হয়ে বৌদ্ধ মার্গের পৃষ্ঠপোষক হন।
গ্রিকদের পরে শকরা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল আক্রমন করে । মধ্য এশিয়ার যাযাবরদের নাম ছিল স্কাইথিয়। এদেরই এক শাখার নাম শক। এরা ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের আধিপত্য ধ্বংস করেই তবে ভারতবর্ষে এসেছিল। শকদের রাজধানী ছিল তক্ষশিলা; তক্ষশিলার প্রথম শক রাজার নাম ছিল মাওয়েস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর গোড়ায় সিংহাসনে বসেন। যা হোক। শকরা ব্যাকট্রিয় ইন্দো-গ্রিক প্রবর্তিত গান্ধার শিল্পের পৃষ্টপোষকতা অব্যাহত রেখেছিল।
শকদের পরে ভারতবর্ষে আসে কুষাণরা। কনিস্ক (১২৭-১৫১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন অন্যতম কুষাণ নৃপতি। কনিষ্কর রাজধানী ছিল পুরুষপুর; কনিষ্ক বৌদ্ধ মার্গ গ্রহণ করেন এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন। এসব কারণে গান্ধার শিল্পে গভীর কুষাণ প্রভাব অক্ষুন্ন থাকে । শক কিংবা কুষাণরা বিদেশী হিসেবে ভারতে এলেও বেশি দিন বিদেশী থাকেননি। এরা ক্রমশ ভারতীয় সভ্যতায় মিশে যান।
আফগানিস্তানের বামিয়ানে বৌদ্ধমূর্তি। আজও গান্ধার শিল্পের ধ্রুপদী উদাহরণ হয়ে রয়েছে।
ব্যাকট্রিয় গ্রিকদের শিল্পরীতি গ্রহন করেছিল শক ও কুষানরা। যার ফলে গড়ে উঠেছিল গান্ধার শিল্প -যে শিল্পের বিকাশকাল খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দ। বুদ্ধ এবং বৌদ্ধ গান্ধার শিল্পের একমাত্র বিষয়। বুদ্ধ এর আগেও ভারতীয় শিল্পের বিষয় ছিলেন, তবে প্রতীক হিসেবে; তাতে বৌদ্ধমূর্তির কোনও স্থান ছিল না। গান্ধার শিল্প বুদ্ধমূর্তি তৈরি করে নতুন এক ধারার প্রবর্তন করে ।
গান্ধার শিল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বুদ্ধকে মুখমন্ডলের অভিব্যাক্তিসহ মানবরূপে দেখানো।
প্রতীকের বদলে বুদ্ধমূর্তির উপাসনা মহাযান বৌদ্ধ মার্গ অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কুষানরা মহাযান বৌদ্ধ মার্গ গ্রহণ করেছিলেন। কাজেই গান্ধার শিল্পের সঙ্গে মহাযান বৌদ্ধ মার্গের সম্পর্ক গভীর। কুষাণ যুগে বৌদ্ধমূর্তির ব্যাপক চাহিদা ছিল। বেশ কিছু বুদ্ধের মূর্তি গ্রিক ভাস্করেরা নির্মাণ করেছিলেন বলেই গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর ছাপ ছিল। ভারতীয় মূর্তি গুলিতে মহাদেব শিবের ছাপ স্পষ্ট।
ভারত ও গ্রিক সম্পর্ক বোঝানোর নিমিত্ত আমি উক্ত ইতিহাস ব্যক্ত করলাম। পঞ্চতন্ত্রের সঙ্গে ঈশপের নীতিকথার কেন এত মিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ লোককথার লিখিত ঐতিহ্য