‘শরীর খারাপে’ কাজ বন্ধ রাখলে দিতে হবে জরিমানা! গণহারে জরায়ু বাদ দিচ্ছেন মহিলা শ্রমিকেরা!

পেটে দু’বেলা ভাত জোগানোর তাগিদে উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন তাঁরা। কিন্তু সেই পরিশ্রমে একটা দিনের জন্যও কোনও রকম কমতি বা খামতি পড়া মানে, সেই দিন ভাতের জোগানে টান পড়া। তাই কোনও রকম অসুবিধা যাতে কাজের বাধা না হয়, সে জন্য সর্বদা চেষ্টা তাঁদের। কিন্তু প্রতি মাসে নিয়ম মেনে প্রাকৃতিক ‘শরীর খারাপ’ তাঁদের হয়ই। কারণ তাঁরা সকলেই মহিলা। আর মাসের ‘সেই সময়টায়’ একটা-দু’টো দিন বাধ্য হয়েই কাজে বাধা পড়ে।

তাঁরা সকলেই আখ খেতের শ্রমিক। ফলে খেতে ভারী কাজ করার মতো শরীরের জোর অনেক মহিলারই থাকে না ঋতুস্রাবের সময়ে। অথচ ছুটি মেলা দূরের কথা, কাজ না করলে মেলে না মজুরি। উল্টে দিতে হয় টাকা। আর সেই কারণেই শুধু দু’বেলা দু’মুঠো অন্নের জোগান নিশ্চিত করতে জরায়ু বাদ দেন সেই মহিলা শ্রমিকেরা। স্বেচ্ছাতেই। কারণ একমাত্র এই উপায়েই ঋতুস্রাব বন্ধ করা সম্ভব। তাই অবাধে চলছে জরায়ু বাদ দেওয়া তথা বন্ধ্যত্বকরণের পালা। কম পয়সায় ছোটো হাসপাতালে ‘ঝামেলা মিটিয়ে’ নিতে গিয়ে প্রায়ই সংক্রমণের শিকার হচ্ছেন তাঁদের অনেকে। ঘটছে মৃত্যুও। কিন্তু মালিক পক্ষ নির্বিকার।

ঘটনাস্থল মহারাষ্ট্র। কাজের খোঁজে বহু মানুষই আসেন এই রাজ্যে। না, সকলে মুম্বইয়ে আসেন না। রুপোলি দুনিয়া ছাড়াও এ রাজ্যে রয়েছে আরও অনেক জায়গা, যেখানে গ্ল্যামার দূরের কথা, সুস্থ ভাবে জীবনধারণের ন্যূনতম আলোটুকুও বিরল। পশ্চিম মহারাষ্ট্রের বিড় জেলার মহিলা আখ শ্রমিকেরা এই অন্ধকারেরই শিকার হচ্ছেন দীর্ঘ দিন ধরে।

অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত বিড়ে আখ চাষের মরসুম চলে। ওই সময়ে সেখানে ভিড় জমান প্রচুর শ্রমিক। আখ কাটার কাজ করেন মূলত মহিলা শ্রমিকেরা। তাঁদের স্বামীরা খেতের অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। এক এক জন দম্পতিকে এক একটি ‘ইউনিট’ হিসেবে ধরা হয় সেখানে। সেই মতোই তাঁদের মজুরি দেন ঠিকাকর্মীরা।

কিন্তু অভিযোগ, মাসের দুয়েক দিন ঋতুস্রাবের সময়ে শরীর দুর্বল থাকলে, মহিলা শ্রমিক যদি উপস্থিত থাকতে না পারেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর স্বামী তো মজুরি পান-ই না, উল্টে নিজেদের পকেট থেকে দিন প্রতি ৫০০ টাকা করে ঠিকাদারদের দিতে হয়!

এলাকার স্থানীয় মানুষেরা জানিয়েছেন, এই নিয়মই এই সব অঞ্চলের দস্তুর। তাই টাকা কাটা যাওয়ার ভয়ে দু’-তিন সন্তানের মায়েরা এখন জরায়ু বাদ দিয়ে বন্ধ্যত্বকরণের রাস্তা বেছে নিচ্ছেন।

শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, স্বামী-স্ত্রী যদি একসঙ্গে আখের খেতে কাজ করতে পারেন ওই ক’মাস, তা হলে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে দু’জনের পেট চলে যায়। যে সমস্ত মহিলা এই আখের খেতে কাজ করার জন্য আসেন তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৩০। অর্থাৎ তাঁদের যৌন জীবন সক্রিয় থাকে এবং সন্তানের জন্ম দিতেও তাঁরা সক্ষম হয়। কিন্তু সুস্থ যৌন জীবনের পরিচায়ক যে ঋতুচক্র, তার ফলে তাঁদের কাজের ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা। মেলে না মজুরি।

আখের খেতের মালিকদের মতে, মাসিক হলে মেয়েরা দু’দিন ছুটি নেয়। ফলে তখন কাজে লোকসান হয়। মেয়েরা দিনে তিন থেকে চার কুইন্ট্যাল আখ কাটতে পারেন। এভাবে প্রতি টন আখ কাটায় তাঁরা ২৫০ টাকা করে পান। এক দিন সেটা না পারলে অনেকটা ক্ষতি হয়। তাই কাজে ঢোকার আগেই তাঁরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে যান, সময়ের মধ্যেই হিস্টেরেক্টমি করিয়ে নেবেন তাঁরা। এমনকী এ জন্য মালিকেরা তাঁদের আগেভাগে কিছু টাকাও দিয়ে রাখে বলে জানা গিয়েছে।

শুধু তা-ই নয়। সূত্রের খবর, কাজ করতে এসে মালিকের হাতেই ধর্ষণের স্বীকার হতে হয় বহু মহিলা শ্রমিককে। এ ছাড়াও তাঁদের শারীরিক, মানসিক এবং হরমোনগত বহু রকমের সমস্যা তৈরি হয়। তাঁদের জন্য থাকে না শৌচাগারের ব্যবস্থাও। খেতের পাশেই তাঁবু খাটিয়ে কোনও রকমে কাজ সারতে হয়।

সম্প্রতি এই খবর পেয়ে নড়ে বসেছে মহারাষ্ট্রের জাতীয় মহিলা কমিশন। সব দিক খতিয়ে দেখে তারা রাজ্যের মুখ্যসচিবকে নোটিসও পাঠিয়েছে। ওই নোটিসে মহিলা কমিশন জানিয়েছে, যে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে এমন ভাবে জরিমানা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের যেন উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হয়!

পাশাপাশি, এই বর্বর অত্যাচারের শিকার যে সব মহিলা, তাঁদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা ও সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে রাজ্য সরকার কী কী পদক্ষেপ করল, তা যেন কমিশনকে জানানো হয়। কমিশনের চেয়ারপার্সন রেখা শর্মার বক্তব্য, যে পরিস্থিতিতে ওই সব মহিলা শ্রমিক আখের খেতে কাজ করছেন, তা শোচনীয়। বিষয়টি নিয়ে কমিশন যথেষ্ট উদ্বিগ্ন।

নারীসুরক্ষা ও মহিলাদের অধিকার নিয়ে যখন সারা দেশে এত রকমের ইস্যু, এত আলোচনা, এত প্রতিবাদ, তখন মহারাষ্ট্রের এই ঘটনা যেন নতুন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পিতৃতন্ত্রের দাপটে কী ভাবে কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন মহিলারা। শুধু কাজ করে টাকা রোজগারের জন্য কত বড় পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে তাঁদের!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.