একদিকে কলকাতার ছাপোষা মধ্যবিত্ত ভ্যালুজ, যা আমৃত্যু বয়ে নিয়ে গেছিলেন তিনি, অন্যদিকে আজ অবধি বাংলার সেরা স্টার। এই দুইয়ের মাঝে আসল উত্তম হারিয়ে যাচ্ছিলেন। যেমন হারিয়ে গেছে চাঁপাডাঙার বউ কিংবা অনুপমার মত তাঁর অভিনীত প্রায় দুশো সিনেমা। সত্যজিৎ আগেই আন্দাজ করেছিলেন এমনটা হবে।
উত্তম যখন এসেছিলেন, তখন বাংলা সিনেমায় ব্যর্থ হবার সুযোগ কাউকে দ্বিতীয় বার দেওয়া হত না। উত্তম ভাগ্যবান। প্রায় ছয়বারের পরেও আবার সুযোগ পেয়েছিলেন। নাম হয়ে গেছিল এফ এম জি। ফ্লপ মাস্টার জেনারেল। বয়সে প্রায় দেড়া অভিনেত্রীদের সঙ্গে বারবার কাস্ট করে যেন প্রমাণ করেই দেওয়া হয়েছিল, এর দ্বারা কিসসু হবে না। ভালভাবে পোর্ট ট্রাস্টের চাকরিটুকুও না। আর ঠিক তখনই ম্যাজিক ঘটে গেছিল তাঁর জীবনে। এমন হয়ত হবারই ছিল। সৌজন্যে এক দল কমেডিয়ান আর পাবনার এক গৃহবধূ। সাড়ে চুয়াত্তর আর ওরা থাকে ওধারের পর আশাপূর্ণা দেবীর অগ্নিপরীক্ষায় সুচিত্রা ছিলেন অটোমেটিক চয়েস। নায়ক হিসেবে অসিতবরণ প্রায় ঠিক, এমন সময় উত্তমের প্রবেশ। তারপর একের পর এক মেগাহিট। উত্তম বাংলার ফেনোমেনন হয়ে গেলেন।
তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে, তাঁকে মিউজিয়াম বন্দি করে মহানায়ক করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে বাঙালি যতটা উদ্যোগ নিল, তাঁর কাজকে বাঁচিয়ে রাখতে তার এক আনাও নয়। জানি না মায়াডোর- এ সেই থিয়েট্রিকাল অভিনয় কেমন ছিল যা থেকে ক্রমাগত অভ্যাসের মাধ্যমে যাত্রা হল শুরু, তাসের ঘর, নবজন্ম কিংবা ডাক্তারবাবুর মধ্যে দিয়ে অবশেষে তাঁর নায়ক-এ উত্তরণ। তবে উত্তম কোনদিন বর্ন অ্যাকটর ছিলেন না। নিজেই বলেছেন বহুবার। শুধু তাই নয়, তার চেহারাতেও বহু খামতি ছিল। মোটা নাক, চ্যাপ্টা ঠোঁট, গালে বসন্তের দাগ। আর এই সবার পিছনে যে জিনিসটা দেখা যেত না একেবারেই, সেটা হল অদম্য এক পরিশ্রম। একেবারে না ছোড় একটা ভাব। আই উইল গো টু দ্য টপ, টু দ্য টপ।
উচ্চারণের খামতি মেটাবার জন্য রীতিমত টিউটর রাখতেন। একটা শব্দ বারবার উচ্চারণ করে পারফেক্ট হতে চাইতেন জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সেই যে একদিন, তখন তিনি সুপারস্টার, আলগোছে মেক আপরুমে বসে শুনতে পেলেন অভিনেতা কানু ব্যানার্জী বলছেন “খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন”-এ উত্তম খুবই ভাল করেছে, কিন্তু বুড়ো বয়েসে চোখে একটা ঘোলাটে ভাব আসে। সেটা মিসিং”। উত্তম বলতেই পারতেন “কে কানু ব্যানার্জী? আমি উত্তম। আমি ইন্ডাস্ট্রি”। না বলে ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেলেন সেই ঘোলাটে ভাব আয়ত্ত করার। যখন “লাল পাথর” রিলিজ করল, সবাই চমকে দেখলেন বৃদ্ধ উত্তমের দৃষ্টি ঘষা কাচের মত। ঠিক যেমন কানুবাবু বলেছিলেন।
সত্যি বলছি, এই এত বছর ধরে সেই অ্যান্টনী ফিরিঙ্গী, সপ্তপদী, সবার উপরে কিংবা খুব বেশি হলে সাগরিকা দেখে দেখে ক্লান্ত হয় যাই না? সংবাদপত্র জানায় বহু ছবিতে ছবি খারাপ হলেও উত্তমের অভিনয় ভাল ছিল। সেই সব ছবিরা মিলিয়ে গেছে কালের গর্ভে। লাখটাকা, কামনা, কল্যাণী, পুণর্মিলন- এই সব ছবির নামটুকুও কজন শুনেছি? বুকে হাত দিয়ে বলুন তো!
উত্তম আজকেও শুধু এক আবেগ হয়ে রয়ে গেছেন। বসন্ত চৌধুরী বা প্রদীপ কুমারের আভিজাত্য তার ছিল না। ছিল না সৌমিত্রের মত অতি ধারালো, প্রায় ঝরে পড়া ইনটালেক্টের ছটা। কিন্তু অদ্ভুত এক মধ্যবিত্ত হাবভাব ছিল মানুষটার সারা দেহ মন জুড়ে। যার জন্য সবার সামনে সে অর্থে এক্সট্রার রোল পাওয়া সন্তোষ সিংহের পায়ে ধরে প্রণাম করতে তাঁর বাঁধত না এক মুহুর্ত। যে কারণে শিল্পী সংসদ হবার পরে যুযুধান দলের সৌমিত্র যখন নিতান্ত অস্বস্তিতে তাকে হাত জোড় করে প্রণাম করেন, তিনি হেসে বলতে পারেন “কি রে পুলু, এত বড় হয়ে গেছিস দাদাকে আর পায়ে ধরে প্রণাম করতে পারিস না?” এমনই ছিলেন উত্তমকুমার।
ভবানীপুরের পুজো প্যান্ডালের প্রতিমা পুড়ে যাওয়ায় নতুন প্রতিমা রাতারাতি আনিয়ে দিয়েছিলেন। শর্ত একটাই। কেউ যেন না জানতে পারে। বেনামে কত ছাত্রকে পড়াশুনোর টাকা দিতেন তার ইয়ত্তা নেই। একেবারে শিখরে উঠেও শিকড়কে ভুলে যান নি এক মুহুর্তের জন্যেও। আর তাই তিনি ঠাকুমার আদরের ধন, মায়ের বাছা, মেয়ের প্রেমিক, ছেলের গুরু আর স্বামীদের চিরকালীন হিংসে হয়ে রয়ে গেলেন এখনও।
তাঁকে, তাঁর অভিনয়কে যে যথার্থ আর্কাইভ করা প্রয়োজন (যেমন সত্যজিৎ বা ঋত্বিক এর কাজের কিছুটা হলেও হয়েছে) সেটা আমরা কবে বুঝব? আর কতদিন পরে? মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে হারিয়ে গেছিল তাঁর সতেরো বছরের প্রিয় টেপ রেকর্ডারটা। বলেছিলেন ওটা শুধু তাঁর নস্টালজিয়া হয়ে থেকে যাবে। উত্তম নিজেও কি ঠিক তাই হয়ে যাচ্ছেন? সেই একই ছবি, একই কাজের চর্বিতচর্বন শুধুমাত্র ডকুমেন্টেশনের অভাবে? মন ভেঙে যায়।
যাই হোক, জাস্ট মনে রাখবেন “উত্তমের মত কেউ নেই। উত্তমের মত আর হবে না”
জন্মদিনে প্রণাম।
কৌশিক মজুমদার