প্রথম অংশ

দ্বিতীয়:

ভূপতিত মানুষকে লড়াইতে সাহায্য করতে হলে হাত বাড়াতে হয়, কিন্তু তার হয়ে লড়াই করলে ভূপতিত মানুষ ভূপতিতই থাকবে। এর আগেও ইউ পি এ সরকার দুটাকা কিলোর চাল, তিনটাকা কিলোর গম এর প্রকল্প চালু করেছে। একের পর এক সরকার এসেছে আর গেছে- ফসলে সহায়ক মূল্য বাড়িয়েছে, সারে ভর্তুকি বজায় রেখেছে, কৃষিঋণ মকুব করে গেছে। তাতে দারিদ্র কমেছে? কৃষক আত্মহত্যা কমেছে? কৃষি কি একটা লাভজনক জীবিকায় পরিণত হয়েছে? প্রতিটা প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ‘না’। বরং চক্রবৃদ্ধির সুদের মতো পরিস্থিতি আরো নিম্নগামী হয়েছে, বিশ্বের বৃহত্তম কৃষিপ্রধাণ দেশে কৃষিব্যবস্থা সরকারের একটা দায়ে পরিণত হয়েছে, গ্রামীণ কৃষিব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য খারাপ হয়েছে আর যখনই সরকারের পক্ষে টানা সম্ভব হচ্ছে না তখনই জনমানসে ক্ষোভের ভয়ে সরকারকে করের চাপ বাড়াতে হচ্ছে সেই শ্রেণির উপরে যারা আপাত ভাবে এই অপদার্থতার সঙ্গে জড়িত নয়। লাভবান হচ্ছে কেবল তারাই যারা এই কৃষক আত্মহত্যাকে সামনে রেখে, ফাটা পাকে সামনে রেখে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিচ্ছে; লাভবান হচ্ছে তারাই যারা এই বিপুল শ্রেণীর মানুষকে স্বয়ম্ভর হতে না দিয়ে নিজেদের কৃপাপ্রার্থী করে রাখছে, নিজেদের পোষা ভিক্ষুক করে রাখছে।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে এই ন্যায় প্রকল্প এই ভিক্ষুক বানানোর পদ্ধতিরই একটি নবীন সংস্করণ মাত্র। দরিদ্র শ্রেণিকে স্বয়ম্ভর না করে, কৃষির সমস্যা গুলোর সমাধান না করে হাতে কিছু টাকা দিয়ে দেওয়া দেশের আপামর জনগণকে গল্পের দ্বিতীয় বন্ধুটার অবস্থায় পরিণত করবে। সেখানে এই টাকাই ব্যবহার করা যেতো খরা অধ্যুষিত অঞ্চলে মাইক্রো-ইরিগেশন, বন্যাপ্রবণ অঞ্চলে হাইড্রোফোনিক ফারমিং আর অতিব্যবহৃত জমিতে অরগ্যানিক ফার্মিং কে প্রোমোট করার জন্য। ব্যবহার করা যেতো অ্যাপ ভিত্তিক কৃষক-মাণ্ডি-স্থানীয় বিক্রেতার মধ্যে সাপ্লাই-ডিমাণ্ড চেন তৈরী করার যাতে অনর্থক মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দূরে সরানো যায়। ব্যবহার করা যেতো কৃষকদের সেই বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার যাতে সেই অ্যাপ তারা ব্যবহার করতে পারে। এতে যেমন ফসলের বিক্রয়মূল্য কমতো, তেমন কৃষকও ফসলের বেশী দাম পেতো। কর্মসংস্থানও বাড়তো আবার সরকারের উপর আর্থিক বোঝা কমত যেটা সরকার আবার এগ্রিকালচারাল টেকনোলজির উন্নতিতেই ব্যবহার করতে পারতো। যে ফড়ে ব্যবস্থা দেশের কৃষিব্যবস্থার অন্যতম রোগ বলে কথিত সেই ব্যবস্থাই এই অ্যাপ ভিত্তিক এগ্রিকালচারে ধাক্কা খেত।

আর ঠিক এই কাজটাই নীরবে করে চলেছে দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী। গত তিন বছর ধরে এই দেশেই সরকারী উদ্যোগে আয়োজিত হয়ে চলেছে স্মার্ট ইন্ডিয়া হ্যাকাথন –সফটওয়ার এন্ড হার্ডওয়ার। সেখানে সবচেয়ে বেশী জোর দেওয়া হয়েছে দেশের সুরক্ষা আর কৃষি ব্যবস্থায়। কম্পিটিশন হচ্ছে সবচেয়ে কমদামী অথচ আধুনিকতম কৃষি অ্যাপ আর কৃষি যন্ত্র তৈরীর। সরকার থেকে পেটেন্ট নেওয়া হচ্ছে সেই কৃষি যন্ত্রের যা ফসল কাটার পর খড় পড়ানোর সমস্যাকে দূর করতে পারে। অংশ নিচ্ছে আড়াইলাখের বেশী মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী। আবার তাদেরকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে সেই যন্ত্র তৈরী করে স্বল্প লাভে বিক্রি করতে। ব্রেনড্রেন নিয়ে কাঁদুনী না গেয়ে ব্রেন ড্রেন হওয়ার পূর্বেই তাদের সসম্মানে দেশের কাজে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক বিপ্লব আসছে ক্রিয়েটিভিটি আর ক্রিয়াশীলতার মাধমে, দান খয়রাতি আর ‘ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ স্লোগানের মধ্যে দিয়ে নয়। আর তাতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করছে দেশাত্মবোধ আর জাতীয়তাবোধই।

একই সঙ্গে উন্নত করা দরকার গ্রামীন ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে। কৃষি ঋণ মকুব করে ব্যঙ্কগুলোর ঘট না উলটে বরং চাষিদের সাহায্য করা উচিত যাতে তারা ঋণ শোধ করতে পারে। অথচ বিরোধী দল এর সমপূর্ণ বিপরীত পথে হাঁটছে। তাদের ইস্তাহার যে বলছে ঋণখেলাপ আর ফৌজদারী অপরাধ থাকবে না তার চেয়ে ভয়ানক আর কিছুই নয়। এর অর্থ এবার সরকারও আর ঋণ মকুব নিয়ে মাথা ব্যাথা করবে না অথচ দুঃস্থ কৃষক ঋণ শোধ করার চেষ্টাও করবে না কারণ তার শাস্তি নেই। ব্যঙ্ক সুদ তো দূরের কথা আসলও ফিরত পাবে না। এর চেয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত আর কিছু হতে পারে না। এর অবশ্যম্ভাবী ফল একটাই- ব্যাঙ্ক আর কৃষিঋণ দেবে না। তখন বাহাত্তর হাজার টাকায় চাষী চাষ করতে পারবে তো? এই ইস্তাহার বাস্তবায়িত হলে কৃষিব্যবস্থা যে কোমায় ঢুকবে তা থেকে বার করতে কত জেনারেশন চলে যাবে ইয়ত্তা নেই। ভারত তার এক বিংশ শতকে প্রবেশ করেছে= সবুজ বিপ্লব আজ অতীত- তেভাগা আন্দোলন আজ অতীত- কৃষি এখন একটা গোল্ডেন পসিবিলিটি- টেকনো-ইকোনো রেভলিউশনের নতুন ক্ষেত্র। দুর্ভাগ্য এবং হাস্যকর যে, যখন শাসক দল কিছু নতুন ভাবতে পারছে, দেশের প্রধাণ বিরোধী দল সেই পথে না হেঁটে সেই আশির দশকীয় দান খয়রাতির পথে চলে গেল এবং তাদের ধামাধরারা রাজা তোর কাপড় কোথায় না বলে বাহ ক্যায়া তাজ বলে চলেছে।

কাজেই আবার প্রথম গল্পটায় ফিরে আসি। ভোট এসেছে- আমরাও বায়োস্কোপ দেখছি। আর আদিগঙ্গার পচা নালা দিয়ে, পরনানা-নানী-আব্বাজান হয়ে এখন ভাই-বহেনের জুটি আপার সেই এক গরিবী হটাও বুলি কপচাচ্ছে- আর ভিখিরী বানিয়ে রাখছে। প্রশ্ন এটাই, এই বেনো জলে আমরা পা তুলব নাকি আমাদের ভবিষ্যত জুতো সুদ্ধু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে? সিদ্ধান্ত আমাদের- কারণ দেশটা আমাদেরই।

ড:প্রতিবর্ত
সহকারী অধ্যাপক,আইআইটি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.