আজ যখন তৃণমূল প্রচার করছে, “উন্নয়ন ঘরে ঘরে, ঘরের মেয়ে ভবানীপুরে”, একটিবারের জন্যও আরুশি কিংবা ভূবনেশ্বর দাসের পরিবারের মুখোমুখি হতে ঘরের মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি দেখা যাবে?

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা আজানিয়াকে আপনারা সকলেই চেনেন নিশ্চয়ই। ২রা মে ভোটগণনার শেষে কালীঘাটে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভিক্ট্রি সাইন দেখাচ্ছিল ছোট্টটি। একরত্তি মেয়েটিকে প্রচণ্ড স্নেহ করেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। ২৩ ফেব্রুয়ারি অভিষেকের বাংলোতে সিবিআই আসার আগে যখন ঘুরে গিয়েছিলেন মমতা, তখনও সেই আজানিয়াকে দেখা গিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীর হাত ধরে থাকতে৷ দেখেই বোঝা যায়, তৃণমূল সুপ্রিমো প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন তাঁর নাতনীকে।

বয়সের ব্যবধান আর কতই বা হবে? আজানিয়ার প্রায় সমবয়সী আরও এক শিশু আরুশি কুমারী। তাকেও ভবানীপুরের ‘ঘরের মেয়ে’ বলা চলে, জন্ম কালীঘাটেই। কিন্তু আপনারা ওকে চেনেন না। চিনবেনই বা কীভাবে? তার বাবার পেছনে তো আর সিবিআই, ইডি পড়ে নেই৷ বাবার নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও নয়! তার বাবা ভবানীপুরের ৭৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা, শ্রমজীবী নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার! সেই আরুশি কুমারী ছটফট করতে করতে মারা গিয়েছিল।

কারণ? গত মার্চ মাসে কলকাতা পুরসভার সরবরাহ করা পানীয় জলে দূষণের জেরে ভবানীপুরের ৭৩ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের খেতে হয়েছিল বিষাক্ত জল। তথাকথিত ‘ঘরের মেয়ে’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তবুও ১ সপ্তাহ ব্যাপী প্রশাসনিক উদাসীনতার জন্য সেই বিষাক্ত জল পান করতে হয়েছিল। তাই অসুস্থ হয়ে চিত্তরঞ্জন শিশু সদনে ভর্তি হওয়ার পরেও আরুশির ৪ বছরের ছোট্ট দেহ আর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি। সকলের অগোচরে বেরিয়ে গিয়েছে শেষ নিঃশ্বাস। ব্যস, তারপর সব শান্ত! মিডিয়া নেই, চেঁচামেচি নেই, আর্তনাদ থাকলেও শোনার লোক নেই..
ওই বিষাক্ত পানীয় জলের পান করে শশিশেখর বোস রোডের আরও ৫-৬ জন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। হাসপাতালে কয়েকদিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে কোনক্রমে তারা বেঁচে ফিরেছিল।

কিন্তু কেবল আরুশি নয়, এই বিষাক্ত জল পান করে প্রাণ হারাতে হয়েছিল সজ্জন, রিংকি তামাং, ভুবনেশ্বর দাস-দের! গুরুতর অসুস্থ হয়েছিলেন ৭৩ নং ওয়ার্ডের শতাধিক বাসিন্দা। ৭৩ নং ওয়ার্ডের শশীশেখর বসু রোড সহ একাধিক চত্বরে পানীয় জল দূষিত হয়ে রয়েছিল সপ্তাহখানেক। সেখানে অন্যান্য বসতির সঙ্গে পৌরসভার শ্রমিক আবাসন আছে। পাশে বেশ কয়টি বস্তি এলাকাও আছে। ফলে দূষিত জল খেয়ে সাধারণ মানুষ, বস্তিবাসী থেকে শ্রমিক অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। অকালে প্রাণ হারান কিছু মানুষ। কিন্তু মজার বিষয় দেখুন, তথাকথিত ‘ঘরের মেয়ে’কে কিংবা আরেকটু নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে ‘পাড়ার মেয়ে’কে একটিবারের জন্যও পাশে পায়নি এই বিপর্যস্ত পরিবারগুলো। তাঁদের ভোটে নির্বাচিত বিধায়ক, ‘ঘরের মেয়ে’ তখন তাঁর ‘মেজ বোন’ নন্দীগ্রাম নিয়ে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন যে তিনি ‘বড় বোন’ ভবানীপুরকে কার্যত ভুলে গেছিলেন! নাহলে এমন একটা পরিস্থিতিতে তিনি একবারের জন্য হলেও পাশে দাঁড়াতে এলেন না!

মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভা নির্বাচনের কিছুদিন আগেই উন্নয়ন কেমন হয়েছে তা দেখতে ভবানীপুর বিধানসভা ঘুরে যেতে বলেছিলেন। অথচ তাঁর বাসস্থান ৭৩ নং ওয়ার্ডেই পানীয় জল সপ্তাখানেকের উপর দূষিত হয়ে থাকলেও কোন হেলদোল দেখা যায়নি এলাকার বিধায়ক হিসাবে তাঁর এবং তাঁর দল তৃণমূল প্রশাসকমণ্ডলী পরিচালিত পৌরসভার। জল বিভাগ আবার প্রশাসক ফিরহাদ হাকিমের নিজের হাতেই ছিল, যিনি আজ ঘুরে ঘুরে ভবানীপুর উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে ভোট প্রার্থনা করছেন, সেদিন তিনি ‘বিজেপি শুয়োরের বাচ্চাদের মারো’ প্রচারেই ব্যস্ত ছিলেন!

আজ যখন তৃণমূল প্রচার করছে, “উন্নয়ন ঘরে ঘরে, ঘরের মেয়ে ভবানীপুরে”, একটিবারের জন্যও আরুশি কিংবা ভূবনেশ্বর দাসের পরিবারের মুখোমুখি হতে ঘরের মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি দেখা যাবে? ‘ঘরের মেয়ে’ আপনি ; এই ঘর ভুলে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানিতে সেদিন আপনি ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আজ অন্তত একবার সেদিনের উদাসীনতার জন্য ক্ষমা চান পরিবারগুলোর কাছে, ক্ষমা চান ওই কোল খালি হওয়া আরুশির মায়ের কাছে! পারবেন ওই পৌর শ্রমিক ভূবনেশ্বর দাসের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মমতাময়ী স্বরূপ, যা বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন প্রত্যক্ষ করত সারা পশ্চিমবঙ্গ, তা প্রশাসক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে আশা করা বন্ধ করে দেবে বাঙালি? যত দিন যাচ্ছে প্রশ্নচিহ্নটা যেন ততই গাঢ় হচ্ছে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.