১১ ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯3- আজ থেকে ১২৮ বৎসর আগে, সুদূর ভারতের এক ভ্রমনশীল সন্ন্যাসী, সমগ্র বিশ্ববাসীকে হিন্দু ধর্মের সাথে পরিচিত করিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। সারা বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করেছিল যখন আমেরিকার শিকাগো শহরে বিশ্বের প্রথম ধর্ম মহাশভায় স্বামীজি সেই ইতিহাস সৃষ্টকারী ভাষণ দিয়েছিলেন এবং তাদের সম্মুকে ভারতের আত্মা এবং আধ্যাত্মিকতাকে প্রস্তুত করেছিলেন ।আজ অব্দি বিশ্বের দরবারে ভারতের সর্ব প্রথম ও সর্বোত্তম প্রতিনধি ও প্রতিমূখ হলেন স্বামীজি ই, যিনি সমগ্র বিশ্বকে অবগত করেছিলেন যে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা, ভারত অশিক্ষায় নিমজ্জিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন দেশ আদৌ নয়, বরং ভারতবর্ষ বৈদিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মবাদের কেন্দ্রস্থল, যা বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ অনুগামীদের আকৃষ্ট করে । ভারত তার সহনশীলতার চেতনা, সনাতন সংস্কৃতি, বিভিন্ন সংস্কৃতি ও মানসিকতার আত্মীকরণ এবং তার আধ্যাত্মিকতার জন্য সর্বজন স্বীকৃত এবং সম্মানিত, যার ফলে ভারতের আত্মা সমস্ত নেতিবাচকতার ঊর্ধে উত্তীর্ণ হতে স্বক্ষম হয়েছে |
স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালের ৩১ এ মে বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই ) থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোর পথে যাত্রা শুরু করেন। যেহেতু তিনি একটি বিত্তশালী ছিলেন না, বহুদিন সাংসারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ন্যাসী হয়েছিলেন, তাই এই যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগৃহীত করেছিলেন তাঁর মাদ্রাজের শিষ্যগণ, মহীশুরের রাজা, রামনাদ, ক্ষেত্রীর রাজা অজিত সিং, দিওয়ান এবং অন্যান্য অনুসারীরা। ক্ষেত্রীর রাজা অজিত সিং, যাত্রার পূর্বে স্বামীজীর বিবেকানন্দ নামটি প্রস্তাব করেন । আমেরিকা যাওয়ার পথে, তিনি চীন, জাপান এবং কানাডা ভ্রমণ করে হিন্দু ধর্মের প্রচার করেন এবং সেখানে ধর্মীয় নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ ও করেন।
শিকাগো পৌঁছে স্বামীজী দেখতে পেলেন যে বিশ্ব ধর্ম মহাশভা আরম্ভ হতে এখনও বেশ কিছু দিন সময় লাগবে। তাছাড়া, মহাসভায় প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত শংসাপত্র তাঁর কাছে ছিলেন না। এ হেনো অবস্থায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মহাশভা শুরু না হওয়া পর্যন্ত শিকাগোতে থাকা তার পক্ষে কঠিন হবে। অতএব তিনি বোস্টনে চলে যান যেখানে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হেনরি রাইটের সাথে দেখা করেন। স্বামীজীর প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং শ্রেষ্ঠত্বের সাথে পরিচিত হওয়ার পর, অধ্যাপক রাইট, বিশ্ব ধর্ম মহাশভায় হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য দৃঢ়তার সাথে স্বামীজী কে আহ্বান জানান । যখন রাইট জানতে পারলেন যে স্বামীজী আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত নন এবং মহাশভায় যোগদানের জন্য তাঁর কোনো শংসাপত্র নেই, তখন তিনি বিবেকানন্দকে বলেছিলেন- “আপনার পরিচয়পত্র চাওয়া অর্থ হোলো সূর্যকে প্রশ্ন করা তাঁর কিরণ দেবার অধিকার আছে কিনা | ” অধ্যাপক রাইট নিজেই এক পরিচয় পত্র লিখেছিলেন স্বামীজীর সম্বন্ধে | তাতে তিনি লিখেছিলেন যে স্বামীজী এমন একজন ব্যক্তিগত যার পান্ডিত্য আমেরিকার সমগ্র পন্ডিত ব্যক্তির সম্মিলিত পান্ডিত্যের চেয়েও অনেক বেশী | অবশেষে রাইট সাহেবের প্রচেষ্টায় অসম্ভব সম্ভব হোলো – বিশ্ব ধর্ম মহাসভার রুদ্ধ দ্বার স্বামীজীর জন্য খুলে গেলো | ৯ই সেপ্টেম্বর স্বামীজী পুনরায় শিকাগো পৌঁছলেন |
১১ ই সেপ্টেম্বর বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় স্বামীজীই প্রথম ভাষণ দেন। মা সরস্বতীর কাছে প্রণাম করে তিনি তার প্রাথমিক স্নায়বিকতা ঝেড়ে ফেললেন যা তাকে শক্তি প্রদান করেছিল এবং তাঁর মনে হয়েছিল যেন এক অদৃশ্য শক্তি তাঁর শরীর ও মন কে দখল করেছে।
“আমেরিকার বোন ও ভাইয়েরা!” এই সম্ভাষণ দিয়ে স্বামীজী তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন । শুধুমাত্র তাঁর এই সম্ভাষণ শুনেই তিনি সাত হাজার জনতার কাছ থেকে একটি স্থায়ী অভিবাদন পেয়েছিলেন, যা দুই মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। নীরবতা ফেরার পর বিশ্বের সর্ব প্রাচীন সভ্যতা, ভারতবর্ষের তরফ থেকে বিশ্বের সর্ব কনিষ্ঠ দেশ গুলির মধ্যে অন্যতম, আমেরিকা কে তিনি শুভেচ্ছা জানিয়ে তাঁর ভাষণ শুরু করলেন | সভ্যতার আতুর ঘর, ভারত বর্ষ তার সনাতন সংস্কৃতির মাধ্যমে সারাদিন বিশ্ব কে শিখিয়েছে সহিষ্ণুতা, শিখিয়েছে কি ভাবে জাতী ধর্ম, বর্ণ যে রঙ নির্বিশেষে সকল কে আপন করে নিতে হয়, কি করে বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমৃশনের মধ্য দিয়ে এক উন্নত ও সর্বোত্তম সংস্কৃতি ও জাতী হিসেবে উন্নীত হওয়া যায় এবং এই সহিষ্ণুতা ও গ্রহনশীলতা বহু প্রাচীন যুগ থেকে বহু কঠিন তপস্যা সিদ্ধ, জ্ঞানদীপ্ত মুনি ঋষিদের শিক্ষার ফল, যা আজ সন্তান ধর্ম হিসেবে পরিস্ফুট হয়ে ভারতের অন্তর্নিহিত আত্মার পরিচয় দ্যায় |
স্বামীজী নিজের উদ্বোধনী ভাষণে বললেন – “হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ, আজ আপনারা আমাদের যে আন্তরিক ও সাদর অভ্যর্থনা করেছেন, তার উত্তর দেওয়ার জন্য উঠতে গিয়া আমার হৃদয় অনিবর্চনীয় আনন্দে পরিপূর্ণ হয়েছে।
পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন সন্ন্যাসী-সমাজের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই। সর্বধর্মের যিনি প্রসূতি-স্বরূপ,তাঁর নামে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্গত কোটি কোটি হিন্দু নরনারীর তরফে আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।”
এর পর তিনি বলেন – “এই সভামঞ্চে সেই কয়েকজন বক্তাকেও আমি ধন্যবাদ জানাই, যাঁরা প্রাচ্যদেশীয় প্রতিনিধিদের সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য প্রকাশ করলেন যে, অতি দূরদেশবাসী জাতিসমূহের মধ্য থেকে যাঁরা এখানে এসেছেন, তাঁরাও বিভিন্ন দেশে পরধর্মসহিষ্ণুতার ভাব প্রচারের গৌরব দাবি করতে পারেন। যে ধর্ম জগৎকে চিরকাল পরমতসহিষ্ণুতা ও সর্বাধিক মত স্বীকার করার শিক্ষা দিয়া আসছে, আমি সেই ধর্মভুক্ত বলে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি ।
আমরা শুধু সকল ধর্মকেই সহ্য করিনা, সকল ধর্মকেই আমরা সত্য বলে বিশ্বাস করি । যে ধর্মের পবিত্র সংস্কৃত ভষায় ইংরেজী ‘এক্সক্লুশন’ (ভবার্থঃ বহিষ্হকরণ, পরিবর্জন) শব্দটি অনুবাদ করা যায় না, অমি সেই ধর্মভুক্ত বলে গর্ব অনুভব করি । যে জাতি পৃথিবীর সকল ধর্মের ও সকল জাতির নিপীড়িত ও আশ্রয়প্রার্থী জনগণকে চিরকাল আশ্রয় দিয়ে আসছে, আমি সেই জাতির অর্ন্তভুক্ত বলে নিজেকে গর্বিত মনে করি| ”
স্বামীজী আরও বলেন – “কোটি কোটি নরনারী যে-স্তোত্রটি প্রতিদিন পাঠ করেন, যে স্তবটি আমি শৈশব থেকে আবৃত্তি করে আসছি, তাঁরই কয়েকটি পঙক্তি উদ্ধৃত করে আমি আপনাদের বলছি -বিভিন্ন নদীর উৎস বিভিন্ন স্থানে, কিন্তু তারা সকলে যেমন এক সমুদ্রে তাদের জলরাশি ঢেলে মিলিয়ে দেয়, তেমনি হে ভগবান্, নিজ নিজ রুচির বৈচিত্র্যবশতঃ সরল ও কুটিল নানা পথে যারা চলছে, তুমিই তাঁদের সকলের একমাত্র লক্ষ্য। পৃথিবীতে এযাবৎ অনুষ্ঠিত সন্মেলনগুলির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহাসন্মেলন এই ধর্ম-মহাসভা গীতা-প্রচারিত সেই অপূর্ব মতেরেই সত্যতা প্রতিপন্ন করছি, সেই বাণীই ঘোষণা করছি
-যে যে-ভাব আশ্রয় করে আসুক না কেন, আমি তাহাকে সেই ভাবেই অনুগ্রহ করিয়া থাকি। হে মনুষ্যগণ সর্বতোভাবে আমার পথেই চলিয়া থাকে।”
স্বামীজীর উপরোক্ত বক্তব্যগুলির নির্যাস টুকু নিলে যা উপলব্ধ হয় তা হোলো এই যে – ভারতীয়তার মূল মন্ত্র হোলো আমাদের সনাতন সংস্কৃতি যা আমাদের সহনশীল তৈরী করেছে, জাতী, ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ করতে শেখায় নি, উপরন্তু সমস্ত জাতী, সম্প্রদায়ের ও সংস্কৃতির সবচেয়ে সেরা ও গ্রহণযোগ্য বৈশিষ্টগুলি আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে গ্রহণ করে আমাদের একটি উন্নততর জাতী হিসেবে বিকশিত হতে সাহায্য করেছে | সনাতন ধর্ম হিংসা বা হানাহানির উপদেশ দ্যায় না, এ ধর্ম শান্তির ধর্ম, সৌভাতৃত্বের ধর্ম , যা আমাদের সমগ্র বিশ্বে সমস্ত মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে সাহায্য করে | শ্রীমদ্ভগবত গীতাতেও এর উল্লেখ আছে | ধর্মীয় অহংবোধ ও আসহিষ্ণুতার উদাহরণ দিতে গিয়ে স্বামীজী কূপ মণ্ডকের কাহিনী উদ্ধৃত করেন, সেই কূপ মণ্ডক যে সমুদ্র নিবাসী মণ্ডক কে এই কারণে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো কারণ সেটা বলেছিলো যে কূপের তুলনায় সমুদ্র অনেক বৃহৎ, কাজেই সেখানে বসবাস করে অনেক আরাম আছে | এই মানসিকতার ফলে কূপ মণ্ডকের না হোলো জ্ঞান বৃদ্ধি, না হোলো কোনো সার্বিক উন্নতি – সেটা চিরটাকাল কূপেই থেকে গেলো | স্বামীজী অনুভব করেছিলেন যে সারা বিশ্বের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলিও ‘কূপের ব্যাঙের’ মত আচরণ করছে , তাদের সীমিত গন্ডির মধ্যে বসবাস করছে, ভিন্ন কোন প্রথা ও আদর্শ গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক তারা । এটি অন্যদের প্রতি সংকীর্ণ মানসিকতা এবং অসহিষ্ণুতার দিকে পরিচালিত করছে। সমস্ত ধর্মীয় মতবাদ যখন সেই প্ররম শক্তিমান ঈশ্বর কে প্রাপ্তির পথ বই আর কিছু না তাহলে নিজের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই হিংসা ও হানাহানি কেন? কেন কারও অভাব অনটন কে উপলক্ষ করে তাকে নিজের ধর্মীয় মতবাদে রূপান্তরিত করার লালসা? যদি সমগ্র মানবজাতি স্বামীজীর শিকাগো ভাষণের প্রতিটি বাক্য নিজের মরমে পোষিয়ে নিতো, তাহলে ধর্মের নামে এই সন্ত্রাস, নিরীহ মানুষদের নির্মম হত্যা, বলপুর্বক বা অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ধর্মান্ত করণ ঘটতো না |
আজ আমরা যা লক্ষ্য করছি তা হল, সনাতন ধর্মের অনুসারীরা সব সময়ই অন্যান্য মতবাদের যা সেরা তা একত্রিত করার চেষ্টা করেছে, তাদের আপন করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এর বিপরীতটা ঘটেনি, যা সব দ্বন্দ্বের মূল কারণ। অতএব, দুর্ভাগ্যবশত, আজ সনাতনীদের মূল কার্য হল প্রথমে তাদের ধর্মকে রক্ষা করা এবং আত্মরক্ষা করা, অতীব আত্মীকরণের পথে হেঁটে আজ সনাতন ধর্ম তথা সংস্কৃতি বিলুপ্ত হতে বসেছে কারণ বাকি ধার্মিক সাম্প্রদায়গুলির তরফ থেকে আত্মিকরণের কোনো নিদর্শন ই পাওয়া যায় নি| স্বামীজীই আমাদের শিখিয়েছিলেন যে যেকোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলে নমনীয়তা পরিত্যাগ করে আত্মরক্ষায় জন্য লড়াই করতে হবে|
১১ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বরের অব্দি মহাসভার অধিবেশন চলে । ১৯ সেপ্টেম্বর, স্বামীজি হিন্দু ধর্মের উপর একটি নিবন্ধ উপস্থাপন করেন এবং “হিন্দু ধর্মের অর্থ” , এই বিষয়ে কথা বলেন। তিনি বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মগুলি, অর্থাৎ হিন্দু ধর্ম, জথরুষ্টপন্থা এবং ইহুদি ধর্মের বিষয়ে অবগত করান এবং খ্রিস্টধর্মের অস্তিত্ব ও উত্থান নিয়ে কথা বলেন । এরপর তিনি বেদান্ত, দর্শন, হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর , আত্মা এবং নশ্বর দেহের অবস্থাণের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য রাখেন |
২৭ এ সেপ্টেম্বর উপসংহারে স্বামীজি বলেন :
“সাম্পদায়িকতা, গোঁড়ামি ও এগুলির ভয়াবহ ফলস্বরূপ ধর্মোন্মত্ততা এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুকাল অধিকার করে রেখেছে । এরা পৃথিবীকে হিংসায় পূর্ণ করেছে, বরাবার একে নরশোণিতে সিক্ত করিয়াছে, সভ্যতা ধ্বংস করেছে এবং সমগ্র জাতিকে হতাশায় মগ্ন করেছে। এই-সকল ভীষণ পিশাচগুলি যদি না থাকত, তাহা হইলে মানবসমাজ আজ পূর্বাপেক্ষা অনেক উন্নত হত। তবে ইহাদের মৃত্যুকাল উপস্থিত; এবং আমি সর্বতোভাবে আশা করি, এই ধর্ম-মহাসমিতির সন্মানার্থ আজ যে ঘন্টাধ্বনি নিনাদিত হয়েছে, তাইই সর্ববিধ ধর্মোন্মত্ততা, তরবারি অথবা লিখনীমুখে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রকার নির্যাতন এবং একই লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর ব্যক্তিগণের মধ্যে সর্ববিধ অসদ্ভাবের সম্পূর্ণ অবসানের বার্তা ঘোষণা করুক ।”
তিনি তার সমাপনী বক্তৃতায় ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্প্রীতি ই যে মানুষের বেঁচে থাকার এবং একে অপরের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একমাত্র রসদ, এ কথা উল্লেখ করেন। তিনি দৃঢ় ,শুনিশ্চিৎভাবে বলেন যে নিজের ধর্মীয় বিশ্বাসকে অন্যের উপর বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া, অপরের ধর্মকে ধ্বংস করে নিজের ধর্মীয় অনুশাসন প্রতিষ্ঠায় সফল হওয়ার আশা করা – এগুলি সব অলিক স্বপ্ন| তিনি বলপূর্বক ধর্মান্তকরনের বিরুদ্ধে জোরালো বক্তব্য রাখেন। কিন্তু আজ আমরা ভারতে যা লক্ষ্য করছি তা হোলো তাঁর এ সকল কথার একেবারেই বিপরীত – হয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে অথবা লোভ দেখিয়ে ধর্মান্তকরণ করা হচ্ছে , যা সম্পূর্ণভাবেই স্বামীজীর আদর্শের পরিপন্থী| তাঁর এ সকাল চিন্তাধারা কেবলমাত্র সনাতণীদের পাথেয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনটাই অনুভূত হচ্ছে |
দুর্ভাগ্যবশত, স্বামীজী এবং তাঁর শিক্ষা তাঁর স্বজতীয়রাই দীর্ঘকাল ধরে গ্রহণ করেননি, বরং নানা রকমভাবে তাঁকে অপমান করে গেছেন । স্বামীজীর জীবৎদশায় , বিশ্ব ধর্ম মহাশভায় হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে সফলতা প্রাপ্তির পর তাঁর সম্মানে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে তাঁর স্বজটি ভারতীয়দের প্রতিক্রিয়া এইরকম ছিল- গুরুদাস মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন যে, জন্মগত কায়স্থ স্বামীজি তাঁর নামের আগে ‘স্বামী’ যুক্ত করার ও কালাপানি অতিক্রম করে বিদেশ যাত্রা করার যে দুসাহস স্বামীজী দেখিয়েছিলেন তার জন্য তাঁর মৃত্যুদন্ড হওয়া উচিৎ । উত্তরপাড়ার মহারাজা, পিয়ারি মোহন মুখার্জি বলেছিলেন যে তিনি স্বামীজীকে সম্মান করতে রাজি আছেন কিন্তু তিনি তাঁকে স্বামীজী বলে সম্বোধন করবেন না । স্বামীজীর মৃত্যুর পর, বাংলা দৈনিক, ‘অমৃত বাজার পত্রিকা’ তাঁকে ‘মাংসাসী সন্যাসী’ বলে উল্লেখ করে – ওনার সম্পর্কে লেখার তো অনেক কিছুই ছিল, তবুও সেই সময়ের সংবাদ মাধ্যম ওনার খাদ্যভ্যাস নিয়ে কটূক্তি করা ছাড়া আর ভালো কিছুই খুঁজে পেলো না |
প্রতিকূলতা ও কটূক্তি উপেক্ষা করে স্বামীজী ও তাঁর অনুগামীগণ তাঁর নীতি ও আদর্শ প্রচার করে চলেন এবং তাঁর গুরু রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সম্মান ও স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ কৃত, স্বামীজী কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাম কৃষ্ণ মিশন ও মঠের মাধ্যমে আধ্যাত্মবাদ প্রচার করে চলেন । স্বামীজীর শিক্ষা ও ভাবধারা, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু সহ বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকেই ইংরেজ ঔ পনিবেশিক শাসকদের সাথে কার্যকরভাবে লড়াই করার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল- যার ফলে ইংরেজরা বলতে বাধ্য হয়েছিল যে ‘স্বামীজি জীবিতের চেয়ে মৃত অবস্থায় অনেক বেশি বিপজ্জনক।’
আমাদের দেশের শিক্ষা ও নীতি ও আদৰ্শ এযাবৎকাল ছিল স্বামীজীর শিক্ষা, আদৰ্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী যা ধ্বংসাত্মক বামপন্থী চিন্তাধারার জন্ম দিয়ে দেশের সার্বিক ক্ষতি সাধন করেছে | আমাদের দেশের পুরাতন শিক্ষা নীতি প্রতিটি স্তরে বহু বিদ্যান মানুষ কে পেয়েছি ঠিক ই কিন্তু তাদের গতিবিধি যন্ত্রসম, অর্থ উপার্জনের জন্য যত টুকু বুদ্ধিমত্যা প্রয়োগের প্রয়োজন আছে, ওনারা ততটাই করে এসেছেন| আজ আমাদের দেশের বর্তমান সরকার স্বামীজীর শিক্ষা ও নীতি কে অনুসরণ করে নুতন শিক্ষা নীতি উপস্থাপন করেছেন যা নুতন প্রজন্ম কে অনেক বেশী কর্মঠ ও বাস্তবমুখী করে তুলবে | স্বামীজী বলেছিলেন যে, আমরা তাঁর দেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হলে আমাদের জাতি আসন্ন বিপদের সম্মুখীন হতে পারে, যা আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। অতএব, একটি শক্তিশালী এবং সফল জাতি হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য এবং সার্বিক উন্নতির জন্য, সমস্ত ভারতীয়দের স্বামীজীর দেখানো পথ অনুসরণ করা অপরিহার্য।
রণিতা চন্দ