মোদী জমানায় তাবৎ সাফল্যকে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতে বসলে, তা একটি পৃথক গ্রন্থের আকার নিতে পারে। আমি এখানে কেবল এমন কয়েকটি বিষয় তুলে ধরতে চাই, যেগুলি এই জমানায় প্রকৃত গ্রামোন্নয়নরূপে চিহ্নিত হয়ে থাকবে এবং যে সত্যকে খারিজ করা বিশিষ্ট কোনও বিরোধীর পক্ষেও সাধ্যাতীত। বিজেপি সরকারের অনুসৃত পন্থাগুলির অন্যতম গ্রামের উন্নয়ন। টিভির পর্দায় অশালীন মন্তব্যে এবং হুঙ্কারময় পীড়াপীড়িতে এই সত্য যে নস্যাৎ হবার নয়, সাম্প্রতিক লোকসভা নির্বাচন তা প্রমাণ করেছে। আমি এখানে ঐকান্তিকভাবে, কিন্তু খুব সংক্ষেপে, এমন কয়েকটি তথ্যকে উপস্থাপিত করতে চাইছি, যেগুলি গ্রামীণ ভারতের উন্নয়নে প্রকৃতই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।
গ্রামীণ ভারত মানেই ভারতের আত্মা। তদনুযায়ী মোদীজীর বিশেষ সুপারিশ ছিল, গ্রামের উন্নয়নকেই যেন পাখির চোখ করা হয়। আমার স্মরণে আছে, ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭৫ তম বার্ষিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী একটি স্লোগান তুলেছিলেন— “দারিদ্র্য, তুমি ভারত ছাড়ো।’ তখন তিনি এও বলেন, দারিদ্র্য তখনই ভারত ছাড়বে, যখন আমাদের গ্রামগুলি প্রকৃত অর্থে সমুন্নত হয়ে উঠবে। এই বক্তব্যে কোনও প্ররোচনা নেই। এটা নিয়েই বাস্তবের কাছে নিজেকে সমর্পণ। ২০১৭ সালে একটি সরকারি সমীক্ষাতেই জানতে পারলাম, গ্রামীণ ভারতে ৬৯ শতাংশ পরিবারের একটিও এক হেক্টর জমির মালিক নয়। অথচ পূর্ববর্তীকালের দশকের পর দশক আমাদের শ্রবণে ও আস্বাদনে আছড়ে পড়েছে ‘গরিবি হঠাও’ ইত্যাদি রকমারি শূন্যগর্ভ শপথগুলি। মনে হয়েছে, এ দেশে রাজনীতি মানে কি সারশূন্য কূটকাচালি, পরিবারতন্ত্র এবং অনুগামীদের কালোটাকার পাহাড়ে ওঠার বন্দোবস্ত করে দেওয়া ?
সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে অবতীর্ণ হবার অনেক আগেই বিজেপি সরকার ওই দরিদ্র নিঃস্ব গ্রাম্য পরিবারগুলির উন্নয়নের একটি বাস্তবসম্মত রূপরেখা নির্ণয় করে। সেই রূপরেখার নাম ‘দীনদয়াল অন্ত্যোদয় জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন। অচিরে এই মিশন সরকারের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রককে বহুলাংশে জনমুখী করে তোলে। গ্রামোন্নয়ন হতে থাকে বহুমুখী, যদিও তাদের সার্বিক সাফল্যলাভ আরও সময়সাপেক্ষ বিষয়। যে সমস্ত কাজ এ যাবৎ হয়েছে, আয়তচোখে তা পরিমাপ করে দেখুন। অবশ্যই খুশি হবেন। কাজ চলছেও অবিরল। পরিধি ও ব্যাপ্তিতে রয়েছে বিবিধ জীবিকার আয়োজন, সড়ক নির্মাণ, আবাসন নির্মাণ, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গ্রামীণ তরুণ-তরুণীদের দক্ষতাবৃদ্ধি, সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা, জল সংরক্ষণ ইত্যাদি। নবভারত ক্রমে উদ্ভাসিত হচ্ছে এই সকল পরিচালিত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। আমি ব্যক্তিগত কারণে ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ছত্তিশগড় ইত্যাদি কয়েকটি রাজ্যে গত বছর ঘুরে এসেছি। এমন কয়েকটি গ্রামাঞ্চল আমার নজরে এসেছে, যেখানে গ্রাম্যবিবাদ এবং মহিলাদের প্রতি অবজ্ঞা জ্ঞাপনের অবক্ষয়ও যেন আজ পুরোপুরি অতীত তথা পরপারেগত। গ্রামগুলির উন্নয়ন পরতে পরতে সুনিশ্চিত করছে সামাজিক সুস্থতাকেও।
‘দীনদয়াল অন্ত্যোদয়… মিশনে যে সকল গ্রামের উন্নয়ন শুরু হয়েছিল, আজ তাদের অবস্থা সত্যি আশ্বস্ত রাখে। চর্চা করে দেখেছি, এমত সাফল্যের পিছনে নিম্নোক্ত ব্যবস্থাদির ভূমিকা ব্যাপক :
(ক) মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে সহায়তাপ্রদান ও উদ্দীপ্ত করে তোলা;
(খ) কৃষি-শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি;
(গ) গ্রামীণ মানুষদের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থাকে এক বিশেষ উচ্চতায় পৌঁছে দেওয়া;
(ঘ) পোশাকিতত্ত্বের বদলে অভিজ্ঞ মানুষের পরামর্শকে অধিক মান্যতা দান। দেখতে হবে সুড়ঙ্গপথে যেন চিরাচরিত শোষক লোকগুলি প্রবেশ করে পুনরায় জাল বিস্তারের সুযোগ না পায়।
সরকারের এমত দৃষ্টিভঙ্গী ও তদনুযায়ী অগ্রগমন গ্রামীণ ভারতে মোদীজীর জনপ্রিয়তাকে প্রাণবন্ত করেছে। এই সময়ে ভারতের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকও যে যথেষ্ট সচেষ্ট হয়েছে প্রকল্পগুলিকে বাস্তবায়িত করতে, তা বহু দৃষ্টান্ত দ্বারা সত্যরূপে সাব্যস্ত। তথাপি, আমার অনুধাবন যে, অন্ত্যোদয় মিশন একটি বিশাল উন্নয়নযজ্ঞের শুভ সূচনা মাত্র। ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌছতে বিজেপি সরকারকে আরও অনেক-অনেক পথ অতিক্রম করতে হবে। এই মুহূর্তে ভারতে গ্রামের সংখ্যা দশ লক্ষের অধিক। সরকারের মনোবাঞ্ছ যতই জোরালো হোক না কেন, সকল গ্রামের সার্বিক উন্নয়ন এক দশকেও সম্ভব কি না, সন্দেহ। নরেন্দ্র মোদী রাহুল গান্ধীর মতো বায়বীয় চিত্রাঙ্কন করছেন না। এই ক্ষেত্রে, তার কণ্ঠস্বরেও তোষামোদের ব্যাপারটা কম। তিনি বলছেন, গ্রামগুলির প্রার্থিত মানোন্নয়ন করতে বাদ্দের পরিমাণ অনেক বাড়াতে হবে। ২০১২-১৩ আর্থিক বছরে তৎকালীন সরকার এই খাতে যতাটা বরাদ্দ করেছিল, ২০১৭–১৮ সালে বিজেপি সরকার সেই বরাদ্দের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি করে। আমার অবাক লাগে, প্রাক নির্বাচনী ভাষণে শূন্যগর্ভ প্রত্যাশায় উন্মাদপ্রায় বিরোধী নেতা-নেত্রীরা আর্থিক সমীক্ষায় এই সমস্ত বিষয়গুলি নিয়ে ন্যূনতম সাড়াশব্দও তুলতেন না। যুক্তিতর্কে তাদের মেধার প্রকাশ সত্যিই লাপাত্তা। বাস্তব সত্য এই যে, বিজেপি সরকার গ্রামোন্নয়নে এবার। আরও অধিক বরাদ্দের পথে হাঁটবে। ব্যয়ের পরিমাণ সর্বত্র সমান হতে পারে না। সম্ভাবনার দিকগুলিকে নিয়ে গভীরভাবে চর্চা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রায় হারিয়ে যাওয়া প্রকল্পগুলির পুনর্বহাল করা যেতে পারে। একদা ড. স্বামীনাথন যেভাবে গ্রামের পর গ্রাম চষে বেড়িয়েছেন, বহু অজ্ঞাতকুলশীল গ্রাম সম্পর্কে অভিজ্ঞ মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চালিয়েছেন সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে, গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের আধিকারিকদের তদ্রুপ প্রয়াসী হতে হবে গ্রামবাসীদের ব্যবহারিক জীবন ও সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে। কর্মজীবনে চক্রকারে ঘূর্ণনের মাধ্যমে আমি এটা বুঝেছি যে, হিমালয় সন্নিহিত তথা উত্তর-পূর্ব ভারতে যে সমস্ত গ্রাম রয়েছে, তাদের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াতেই হবে। এই ক্ষেত্রে স্টেটব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া সমেত ভারতের সরকারি ব্যাঙ্কগুলির ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য।
২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাঙ্ক গুলি কেবলমাত্র মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলিকে ঋণ দিয়েছে। ৭০ হাজার কোটি টাকার অধিক। লক্ষণীয় যে, ওই স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি যে সততা ও দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যাঙ্কের ঋণ পরিশোধ করেছেন বা করছেন, দেশের তাবড় ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের ক্ষেত্রে তা আমরা প্রত্যক্ষ করিনি। ব্যাঙ্কগুলিতে ‘Non-performing assets’-কে পর্বতপ্রমাণ করে তুলতে ওই ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অবদানই আমাদের লজ্জায়, বিরক্তিতে ও ঘৃণায় জর্জরিত রাখে। দু’দশক আগে কর্মরত অবস্থায় আমরা কয়েকজন আধিকারিক স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কাকদ্বীপ ব্যাঙ্ক থেকে যে প্রায় শ’চারেক মহিলা পরিচালিত স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ দিয়েছিলাম, সেখানে পরিশোধের হার ছিল ৯৮ শতাংশ, যা বৃহত্তর ক্ষেত্রগুলির বেলায় কম-বেশি অভাবনীয়। এইরকম বহু দৃষ্টান্তকে নিরীক্ষণে আনলে দেশের আর্থিক সংস্থাগুলি গ্রাম ভারতের দিকে দৃষ্টি ফেরাবার যৌক্তিকতা খুঁজে পাবে।
মোদীজী পর্যাপ্ত জোর দিতে বলেছেন গ্রামাঞ্চলে জলসংরক্ষণের ওপর। আমার স্মরণে আছে, ২০১৫ সালের মে মাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী সমকালীন ভারতের খরাপীড়িত ১৩টি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন এবং মুখ্যমন্ত্রীদের অনুরোধ করেন জলসংরক্ষণ ব্যবস্থার ওপর বিশেষ জোর দিতে। এরপরই ওই রাজ্যগুলিতে বিশেষ অনুদান গিয়ে পৌঁছায় উক্ত প্রকল্পকে সফল। করবার জন্য। আমি এরপর তিন দিনের জন্য ঝাড়খণ্ডে গিয়ে দেখেছি, ওই রাজ্যের। গ্রামাঞ্চলগুলিতে বিস্তর ডোবা খনন করা হয়েছে। পরবর্তীকালের সম্ভাব্য খরার বিরুদ্ধে ওই ডোবাগুলিই ধারালো আয়ুধের ভূমিকা পালন করবে। তেলেঙ্গানায় সেই একই উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করে ‘মিশন কাকাতীয়’। এইগুলিই আদত উন্নয়ন। এদের উপস্থাপনায় । ঢক্কানিনাদ নিতান্ত কম; কিন্তু কার্যকারিতা অনেক বেশি। গ্রামের মানুষ কৃতজ্ঞ থাকেন। শেষপর্বে নির্বাচনে সেটাই প্রতিফলিত হয়। রাজস্থানের গ্রামগুলি অমৃতের সন্ধান পায়। ‘মুখ্যমন্ত্রী জলসাবলম্বন প্রকল্পে’। মহারাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয় ‘শিরওয়ার প্রকল্প’-এর মাধ্যমে। গ্রামের নিম্নবিত্ত মানুষ চৈতন্যশূন্য নয়। তারা অঞ্চলপ্রধানের চেয়ার দখল করতে যে দল গুন্ডামি, রাহাজানি, নষ্টামি ইত্যাদিতে খুব নাম কিনল, তাদের যেমন ক্ষমা করে না, তেমনি যে দল তাদের সত্যিকারের উপকার করল, তাদের প্রতিও যথাকালে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে ভুল করে না। তাদের সঙ্গে যতই গল্পগুজব করুন, হাসি হাসি মুখেও তারা নিজেদের সঙ্কল্পের কথা সচরাচর জানাবেন না। ভেতরের উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ সত্যি কম।
গ্রামাঞ্চলে কর্মসংস্থানের প্রার্থিত লক্ষ্য পূরণ করা যায়নি, এটা সত্য। প্রতিকূলতা ছিল বহুমুখী। তবুও সরকার যে ২০১৫-১৬ এবং ২০১৭ —১৮ ওই দুই আর্থিক বছরে গ্রাম-ভারতে মোট ২৩৫ কোটি শ্রমদিবসের সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়, গ্রামের মানুষ তা কিন্তু ভোলে নি।
গ্রামগুলিতে আজ তথ্যভিত্তিক নজরদারি বাড়ছে। সুদখোরদের দ্বিধাগ্রস্তভাব এখন লক্ষণীয়। বিজেপি বিরোধীরা টালমাটাল ডিঙিতে দাঁড়িয়ে যে রকম কুৎসিত বাক্যপ্রবাহ অব্যাহত রেখেছেন, তার বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়া ভাবীকালেও বজায় থাকবে। ওই ধরনের বাক্যপ্রবাহে যাঁরা অভ্যস্ত তারা আদতে পরবর্তী ব্যর্থতার অনলে নিজেদের পূর্ণাহুতি দিলেন মাত্র। ওই সকল বাক্যনিক্ষেপ আমরা যে কোনও মহতীবার্তা খুজে পাইনি, এই বোধটুকু ঈশ্বর তাদের দিন। আবার আমরা দেখলাম, প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগাতে দেশের অন্যান্য অনেক দলের মুখ্যমন্ত্রীরা। কতখানি সচেষ্ট হয়ে গ্রামগুলির উন্নয়নে সফল হয়েছেন। গ্রাম ধরে ধরে সম্পদ ও সম্ভাবনাকে নির্ধারণ করেছেন। প্রতিবছর এইরকম বাছাই করা গ্রামাঞ্চলে কতটা উন্নয়ন বাস্তবায়িত হল, সরেজমিন তথ্যে তা প্রতিভাতও হল সর্বভারতীয় রিপোর্টে। আরে বাপু, দেশ কিন্তু একটাই। আর প্রাদেশিকতা একটা ব্যাধি। এই ব্যাধির যে বিষ ইংরেজরা আমাদের মধ্যে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে দিয়েছে, আমরা এখনও তার বিষাক্ত প্রভাব কোনও কোনও নেতা-নেত্রীর মধ্যে মাত্রাতিরিক্তভাবে দেখতে পাই। এঁরা বুঝতে পারছেন না, তাদের। মনোহরণদ্যুতি কত দ্রুত নিষ্পভ হয়ে পড়ছে। ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা একদা তাদের তুঙ্গে তুলেছিল। আজ অহমিকা ও সন্দেহবাতিকতা উপছে পড়ায় আজ সেই বিন্দাসপর্বের ইতি হতে চলেছে। তাদের শুভবুদ্ধি জাগ্রত হোক, প্রার্থনা করি।
শেখর সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.