বিগত তিন দশকে, এই তিনজন রাষ্ট্রবাদী নেতাদের জীবন বলিদানের জন্যে ইসলামিক সন্ত্রাসিরা কাশ্মীর উপত্যকার কিশ্তওয়ার, ডোডা ও ভাদারভাতে সন্ত্রাসের সম্প্রসারণ করতে পারেনি

৯ই এপ্রিল ২০১৯, কিশ্তওয়ারে ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীর হাতে নির্মম ভাবে নিহত হলেন জাতীয় স্বামসেবক সংঘের সদস্য স্বর্গীয় চন্দ্রকান্ত শর্মা। এই হামলায় ওনার দেহরক্ষী রাজেন্দ্র সিং এরও মৃত্যু হয়। গত ৬ মাসে এইরকম ২ জন বড় রাষ্ট্রবাদী নেতার হত্যা হয়েছে। যদিও উপত্যকায় এইপ্রকারের সন্ত্রাসী নির্মম হত্যাকাণ্ড আগেও হয়েছে, বিশেষ করে জম্মুর ডোডার ভাদারভা ও কিশ্তওয়ার জেলায়।

গত ৩০ বছরে জম্মু কাশ্মিরে একের পর এক পাকিস্তান সমর্থিত সান্ত্রাসবাদ ঘটে চলেছে। সন্ত্রাসবাদিরা একটা বড় ভাগ নিজেদের কব্জায় করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সফলতা না পেয়ে তারা শেষে কাশ্মিরের ছোট ভাগ মানে দক্ষিন ভাগে নিজেদের কেন্দ্র স্থাপন করেছে। ১৯৮৯ এর পরে সন্ত্রাসবাদিরা জম্মুর ডোডা, রাজৌরি, পুঞ্ছ, কিশ্তওয়ার ইত্যাদিতে নিজেদের খুঁটি গাড়ার ও সন্ত্রাস প্রসারনের যথেষ্ট চেষ্টা করেও সফল হতে পারেনি, স্থানীয় জনগনের সন্ত্রাস ও বিছছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সামনে। কিন্তু কোনরকমে এই সন্ত্রাসবাদিরা, যারা এই সন্ত্রাসের প্রতিবাদের অন্যতম আওয়াজ ও সন্ত্রাসের পথের কাঁটা তাদেরকে ক্রমশ নিশানা বানিয়ে এসেছে।

সন্ত্রাসিরা সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের সম্মুক্ষিন হয়েছে ডোডা ও কিশ্তওয়ারে। মানে সন্ত্রাস ছড়ানোর জন্যে শুধু কাশ্মিরে নয়, জম্মুতেও বেছে বেছে হিন্দুদের হত্যা করা হয়েছে। যেমন এই ৯ই এপ্রিলের ঘটনা, সন্ত্রাসিরা দিন দুপুরে প্রকাশ্যে জেলা হাসপাতালে ঢুকে মেডীকেল এসিস্টেন্ট ও জাতীয় স্বামসেবক সংঘের সদস্য চন্দ্রকান্ত শর্মা কে গুলি করে হত্যা করল। এই হামলায় চন্দ্রকান্ত শর্মার একজন পিএসও –র ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ও চন্দ্রকান্ত শর্মা চিকিৎসা চলাকালীন মারা যান।

স্বর্গীয় চন্দ্রকান্ত শর্মা ছোট থেকেই সঙ্ঘের সাথে নিজেকে জুড়েছিলেন। উনি নিজের কার্যকালে হিন্দুদের একত্রিত করার কাজ খুব ভাল ভাবে করেছেন। তারওপর উনি সৈনিক দলের যে কোন সাহায্যের জন্যে যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। এই ব্যাপারটাই সন্ত্রাসিদের চোখের কাঁটা হয়েছিল, তাই তারা ওনাকে নিশানা করলো। তিনি জানতেন যে উনি সন্ত্রাসবাদিদের নিশানাতে আছেন এবং ওনাকে সুরক্ষাও প্রদান করা হয়েছিল। তবুও উনি বিচলিত না হয়ে, নির্ভয়ে সমাজ সেবাতেই নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। ওনার পদ, প্রতিষ্ঠাতে কোনরকম আগ্রহ ছিল না, শুধু সাধারণ গরিব মানুষের সেবায় নিজের জীবন ব্যাতিত করাই ওনার একমাত্র আকাঙ্খা ছিল।

১লা নভেম্বর ২০১৮, পাক সমর্থিত সন্ত্রাসিরা বিজেপির সচিব অনিল পরিহার ও তাঁর ভাই অজিত পরিহার এর হত্যা করল। টোপ্পল গলি এলাকাতে নিজেদের দোকান বন্ধ করে যখন ঘরে ফিরছিলেন তখন তাদের গুলি করে নির্মম হত্যা করা হয়। একপ্রকারে বলা যায়, কিশ্তওয়ারে সন্ত্রাসের বিরোধিতা করার দাম তাদের নিজের জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে।

৯০ এর দশকে যখন জাম্মুতে সন্ত্রাসের ঘটনা বাড়তে থাকে, তখন অনিল পরিহার স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ ও ভিলেজ ডিফেন্স সমিতি গঠন করেন এবং আস্তে আস্তে সন্ত্রাসপূর্ণ এলাকাগলি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। ফলে, গ্রামের মানুষ যারা ঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন তাঁরা একে একে ফিরে আসেন। মাছলি মাতা দর্শনে যারা সন্ত্রাস ও বাধা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে তাদের বিরুদ্ধে খলাখুলি মোকাবিলা করেন।

উনি অনুচ্ছেদ ৩৫ এ বিরুদ্ধ বাজার বন্ধ ও ধরনা ইত্যাদিও করেন। এইসব ঘটনার পরে পরেই উনি হত্যার ধমকি পেতে শুরু করেন। পুলিস প্রশাসন সবাই এই ব্যাপারে জ্ঞ্যাত হওয়া সত্তেও নিরাপত্তায় কোনরকম তৎপরতা দেখায়নি। গুপ্ত বার্তায় এই খবর এসেছিল যে কিছু সন্ত্রাসবাদি এই এলাকায় সক্রিয় হয়ে গেছে । কিন্তু এই সঙ্ক্রান্তে ওনার সুরক্ষা বাড়ানো হয়নি। পূর্ববর্তী সরকার এস.ও.জি আগেই সরিয়ে দিয়েছিল, যা সন্ত্রাস নির্মূল করার জন্যে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সঙ্খ্যালঘু হিন্দুদের সুরক্ষা সরিয়ে নেওয়া হয়ে, সূচনা থাকতেও মুখ্য সড়ক ও চৌমাথা ইত্যাদিতে সিসিটীভি না দেওয়া, নতুন থানা না বানানো ইত্যাদি এইরকম অনেক গাফিলতি করা হয়। পরিহারের হত্যার মূল উদ্দেশ্য ২০ বছরের শান্তির পর ও থিতিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসের আবার সক্রিয় হওয়ার ইঙ্গিত।

৩০এ এপ্রিল ২০০৬ ডোডা জেলার কুলহান্দে থাভা গ্রামে ১০-১২ জন সন্ত্রাসবাদি নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসিদের ওপর হামলা করে। রাতের অন্ধকারে আসা সন্ত্রাসবাদিরা সেনার ইউনিফরমে ছিল, ওরা গ্রামবাসীদের ঘর থেকে বের করে এক লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলল। ২২ জন হিন্দুর নরসংহার করা এই পিশাচেরা এক ৩ বছরের বাচ্চা মেয়ে কেও ছাড়েনি। এই হামলার সাথেই উধমপুর জেলায় বসন্তগঢ এলাকায় লালো গ্রামে সন্ত্রাসবাদিরা ১৩ জন হিন্দু মেষপালক বর্গের মানুষের গুলি করে নির্মম হত্যা করে। দুই হত্যাকাণ্ডেই পাকিস্তান সমর্থিত লষ্কর-এ-তইবা দায়িত্ব নিয়েছিলো। মনে করা হয়, এই হামলা সরকার ও হুরিয়াত কনফারেন্স এর মাঝে হওয়া বার্তা কে বাধা দেওয়া।

২০০১ এর ২রা আগস্ট জম্মুর ডোডা জেলার কিস্তয়ারের লদ্দর গ্রামে লস্কর ই তইবা গোষ্ঠীর ১০জন জঙ্গি ঢুকে পরে। দিন দুপুরে ২০ জন হিন্দু পুরুষকে ঘর থেকে টেনে পাহাড়ি এলাকায় নিয়ে যায় এবং তাদের নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়। এর সাথে সাথে বেশ কিছু মানুষ জখমও হন । এই জঙ্গিরা জম্মুতে নিজেদের ঘাঁটি মজবুত করার চেষ্টা করছিলেন এবং সাথে সাথে জম্মুতে বসবাসকারী হিন্দুদের ভয় দেখিয়ে ঘর ছেরে পালাতে বাধ্য হতে হচ্ছিল । ডোডা জেলার রাষ্ট্র বাদি হিন্দু লোকজন দের তাড়ানোর দরকার পরে কারন তারা জঙ্গিদের কাজে বাধা দিচ্ছিল।

এই কাজের সুচনা হয় ১৫ই আগস্ট ১৯৯২ তে নিরীহ জনগনের ওপর গ্রেনেড হামলা গুলি চালানোর মাধ্যমে । ধীরে ধীরে এই ধরনের ঘটনা বাড়তে থাকে । জঙ্গিদের দুঃসাহসকে প্রতিহত করার কাজে এগিয়ে আসেন রুচির কুমার কউল । ৪ ঠা জুলাই ১৯৫৮ জন্মগ্রহন করেছিলেন রুচির কুমার কউল। তিনি অল্পবয়স থেকেই আর এস এসের কর্মী ছিলেন । তিনি জনসাধারনের মনোবল এতটাই বারিয়ে দেন যে তারা সামান্য তলোয়ার এবং কুঠারের সাহায্যে জঙ্গি নিধনে এগিয়ে আসে । রাজ্য এবং কেন্দ্রিয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য তিনি ৪১ দিন ধরে একটি গন আন্দলন চালান। দোকানপাট সব বন্ধ থাকে এবং সরকারি কর্মচারীরাও ২৮ দিন ধরে অফিস যাওয়া বন্ধ করে দেন । এই ভাবে স্কুল কলেজ অফিস সব বন্ধ হয়ে যায় । আতঙ্কবাদিরা এই খবর জেনে যায় । এবং রুচির কুমার জঙ্গিদের হিট লিস্টে চলে আসেন। বহু বার তাকে মারার চেষ্টা করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৯৪ সালে ৭ই জুন বাড়ির পাশের ক্ষেতে কাজ করার সময় জঙ্গিরা তাকে হত্যা করে।

দেশের প্রতি সমর্পিত প্রাণ রুচির কুমার এই ভাবে শহিদ হন। আর এস এসের জিলা কার্যবাহক রুচির কুমার মারা যাওয়ার সময় বিজেপির মণ্ডল প্রধান ছিলেন। তিনি চিরকাল সকলের প্রেরনা হয়ে থাকবেন কারন তিনিই সীমিত সামর্থ্য নিয়েও মানুষকে লড়াই করতে শিখিয়েছিলেন। এবং আতঙ্কবাদকে বারতে দেন নি। এই ধরনের হত্যাকে কেন্দ্র করে জনরোষ প্রতিফলিত হয় । অজিত ও অনিল পরিহারের হত্যার পর জনরোষ থেকে ভাঙচুর শুরু হয় । চন্দ্রকান্ত শর্মার হত্যা ও এই ধরনের জনরোষ সৃষ্টি করেছে । তার জেরে এস পির অফিসের সামনে ভাঙচুর হয়েছে । মানুষ এই হত্যার ভীষণভাবে বিরোধিতা করেছে। এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে জনগণ কোনদিন আতঙ্কবাদের সামনে নত হয় নি এবং আজ ও হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.