২০১৮ সাল। শ্রীনগরের ছাত্তাবাল এলাকা। ভোর রাত থেকেই সুনসান সড়ক। থমথম করছে গোটা এলাকা। ঘিঞ্জি সরু রাস্তার পাশে একটি নির্মীয়মাণ বাড়ি। সামনে ইটের পাহাড়, বালি-পাথরে বন্ধ বাড়ির প্রবেশপথ। এই বাড়ির ভিতরেই নাকি ঘাঁটি গেড়েছে লস্করের সেই ‘মোস্ট ওয়ান্টেট’ কম্যান্ডার যাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
পাকাপোক্ত খবর দিয়েছে এনআইএ। আর দেরী নয়। ভোরের আলো ফোটার আগেই গোটা বাড়িটা ঘিরে ফেললেন সিআরপিএফ জওয়ানরা। গোটা টিমটার নেতৃত্ব দিচ্ছেন এক তরুণ কম্যান্ডান্ট। তাঁর ইশারা পেয়েই গর্জে উঠল আগ্নেয়াস্ত্র। আচমকা প্রত্যাঘাতে হকচকিয়ে গেল ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিদল। প্রস্তুত হওয়ার আগেই সেনাদের গুলি এফোঁড় ওফোঁড় করে দিল জঙ্গি-সর্দারকে। নিহত দলের বাকিরাও। সফল অভিযান। উল্লাস করে উঠলেন জওয়ানরা। তরুণ কম্যান্ডাটের মুখ তখনও গম্ভীর। এক মাথা মরেছে, কিন্তু বাকি এখনও অনেক। তাদের নিকেশ না করা অবধি শান্তি নেই। ছাড়পোকার মতোই তারা আস্তানা গেড়ে রয়েছে উপত্যকার আনাচ কানাচে।
নরেশ কুমার। সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সের (সিআরপিএফ) অ্যাসিস্টান্ট কম্যান্ডাট নরেশ কুমারকে সহকর্মীরা বলেন ‘গানস্লিঙ্গার’ । যেমন নিপুণ তাঁর নিশানা, তেমনি দুর্জয় সাহস। জঙ্গিদের গুলির মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়াতে পারেন। যেকোনও দুর্গম জায়গায় কৌশলে ঢুকে পড়তে পারেন। এমনই একজন সিআরপিএফ কম্যান্ডান্টকে পুলিশের অন্যতম সর্বোচ্চ সম্মান ‘পুলিশ মেডেল ফর গ্যালান্ট্রি’ দেওয়া হল প্রজাতন্ত্রের প্রাক্কালে।
৩৪ বছরের নরেশ কুমার তাঁর কর্মজীবনে কম করেও ৫০ জন জঙ্গিকে খতম করেছেন। এনকাউন্টারে তাঁর হাতেই জখম হয়েছে আরও ডজন খানেক জঙ্গি। নিহতদের তালিকায় যেমন রয়েছে লস্কর-ই-তৈবার সক্রিয় কম্যান্ডাররা, তেমনি রয়েছে হিজবুল মুজাহিদিন, জইশ-ই-মহম্মদের মতো পাক মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনের সক্রিয় সদস্য ও স্লিপার সেলরা।
সিআরপিএফ কম্যান্ডান্টের কথায়, “সঠিক সংখ্যা মনে রাখা অসম্ভব, তবে অসংখ্য জঙ্গিদমন অভিযান করেছি। উপত্যকার নানা জায়গায় দিনরাত এনকাউন্টার করেছি আমরা। কম করেও ৫০ জন জঙ্গিকে নিকেশ করেছি। তবে সংখ্যাটা বেশিও হতে পারে। জইশ ও হিজবুলের কম্যান্ডারদেরই মেরেছি সবচেয়ে বেশি।”
প্রথম পুলিশ মেডেল ফর গ্যালান্ট্রি (পিএমজি) পেয়েছিলেন ২০১৭ সালে। শ্রীনগরের এক এনকাউন্টারের পর। নরেশ কুমার জানিয়েছেন, ২০১৬ সালের ওই একাউন্টারে খতম হয় দুই জঙ্গি। তবে তাদের সংগঠনের নাম জানা যায়নি। এরপর ২০১৮ সালে পরবর্তী পিএমজি। দু’জন হিজবুল কম্যান্ডারকে নিকেশ করেছিলেন নরেশ কুমার। তাছাড়া গোটা কর্মজীবনে আরও অনেক জঙ্গিকে নির্ভুল নিশানায় ঝাঁঝরা করে দিযেছেন সিআরপিফের এই সাহসী কম্যান্ডান্ট।
তাঁর সেরা অভিযান ২০১৮ সালের ছাত্তাবালের এনকাউন্টার। লস্কর-ই তৈবার শীর্ষ কম্যান্ডার শওকত আহমেদ তাককে খতম করেছিলেন নরেশ কুমার। শওকত আহমেদ ওরফে হুফাইজা ছিল লস্করের ডিস্ট্রিক্ট কম্যান্ডার। গোটা পুলওয়ামায় তার শিকড় ছড়িয়েছিল। অবন্তীপুরের বাসিন্দা শওকত আহমেদ জঙ্গি দলে নাম লেখায় ২০১১ সালে। লস্করের সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠে। গোটা উপত্যকায় একাধিক জঙ্গি নাশকতার জন্য দায়ী শওকত একসময় মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি হয়ে ওঠে। ২০১৬ সালের পর থেকেই তার গতিবিধি ট্র্যাক করতে শুরু করেছিলেন এনআইএ-র গোয়েন্দারা। কখনও ডেরা পাল্টে, আবার কখনও নাম বদলে উপত্যকার নানা জায়গায় আত্মগোপন করে থাকতে শুরু করেছিল শওকত। শেষে ছাত্তাবালে তার গোপন ঘাঁটির খোঁজ পেয়ে সিআরপিএফকে খবর দেন গোয়েন্দারা। পোক্ত খবর হাতে আসার পরে আর এক মুহূর্তও দেরি করেননি কম্যান্ডান্ট নরেশ কুমার।
নরেশ কুমারের বাবাও সেনা জওয়ান ছিলেন। বাবার অনুপ্রেরণাতেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নরেশ। তাঁর স্ত্রী শীতলও সিআরপিএফের অ্যাসিন্টান্ট কম্যান্ডান্ট। নরেশ কুমারের সঙ্গে তিনিও কাশ্মীরে পোস্টেড।
পুলিশ মেডেল ফর গ্যালান্ট্রি ছাড়াও ১১ ডিজি সিআরপিএফ কমেন্ডেশন ডিস্ক, দু’টো জম্মু-কাশ্মীর পুলিশ মেডেল এবং এনআইএ-র দেওয়া একাধিক সম্মান রয়েছে নরেশ কুমারের ঝুলিতে।
সিআরপিএফের ডিজি ড. এপি মহেশ্বরী জানিয়েছেন, এ বছর প্রজাতন্ত্র দিবসে ৬২ জন সিআরপিএফ জওয়ানকে সার্ভিস মেডেল দেওয়া হবে, আরও সাতজন সিআরপিএফ অফিসার পাবেন বিশেষ সম্মান।