অধ্যাপক হরিপদ ভারতী (Haripada Bharati) (২৮ জুন, ১৯২০ — ১৯ মার্চ, ১৯৮২) ছিলেন ভারতীয় জনসঙ্ঘের এক প্রথিতযশা নেতা, সুবক্তা এবং আদ্যন্ত পণ্ডিত এক ব্যক্তি। জনতা পার্টির সদস্য হিসাবে ১৯৭৭ সালে তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হন। আমৃত্যু তিনি বিধায়ক ছিলেন।
জরুরী অবস্থার সময় (১৯৭৫ সালের ২৭ শে জুন) তিনি ‘মিসা আইনে’ কারারুদ্ধ হন। তাঁকে প্রেসিডেন্সি জেলে রাখা হয়। জেলের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যে চিঠিপত্র তাঁর পত্নী শ্রীমতী প্রগতি ভারতীকে লিখেছিলেন এবং আই.বি.-র শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে গোপনে তাঁর ব্যাগে ফেলে দিতেন, সেই পত্রগুচ্ছই সম্পাদনা করে পরে লিখেছিলেন কালজয়ী গ্রন্থ ‘জেলে মিসা বাইরে মিসা’ (প্রথম প্রকাশ: চৈত্র, ১৩৮৪)। এই গ্রন্থে প্রেসিডেন্সি জেলের অভ্যন্তরে সুদৃশ্য যে বাগিচা ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের বর্ণনা দিয়েছেন তার মধ্যে তাঁর প্রকৃতি প্রেম পরিস্ফুট হয়েছে। প্রস্তুত আলোচনায় তারই খানিক নির্যাস দেওয়া গেল।

জেলের কুঠুরিতে প্রবেশ করার সরকারী প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক রাত হল। বর্ষাকাল। বৃষ্টিতেও ভিজেছেন খানিকটা। রাত দুটো নাগাদ স্পেশাল ওয়ার্ডে তাঁর ঠাঁই হল, জেলের পরিভাষায় যার নাম ‘গোরা ডিগ্রী’। রাত আড়াইটেয় সামান্য খাবার জুটলো। তারপর শুয়েছেন। ভোরে তাঁর লক আপ খোলা হয়েছে। তখন ভোর সাড়ে পাঁচটা। সেই সময় তাঁর নজর পড়ল জেলের অভ্যন্তরের প্রকৃতি পরিবেশের দিকে। তিনি লিখছেন,
“বেশ চওড়া এবং অনেকখানি লম্বা বারান্দার কোল ঘেঁষে উঁচু পাঁচিল ঘেরা এক বাগান। সেখানে নানান রকমের ফুলের গাছ, আর তাতে গুচ্ছ গুচ্ছ রং বেরঙের ফুল। বারান্দাটার ঠিক সামনেই ডানহাতি এক প্রকাণ্ড স্বর্ণচাঁপার গাছ, তাতে অসংখ্য ফুল ফুটে রয়েছে। আার তার পাশেই অনেকগুলি গোলাপ গাছ, কয়েকটা বেলফুলের গাছ, তার পাশে একেবারে বারান্দার গা ঘেঁষে রকম-বেরকমের পাতা বাহারের ঝাড়।… ও গাছ আছে আশেপাশে আরও অনেক জায়গায়। যেমন গোলাপ গাছ আছে প্রায় সারা বাগানটা জুড়েই। গোটা চারেক কামিনী ফুলের গাছ। দু দুটো বড় গন্ধরাজের গাছ, আর বারান্দার ওঠবার সদর সিঁড়ির কাছেই আছে এক বিস্তীর্ণ কাঁঠালিচাঁপার গাছ। ভুরভুর করে গন্ধ বেরুচ্ছে সেখান থেকে। আর ওই সিঁড়ির দুপাশে ঠিক যেন গেট সাজাবার মতো করে দাঁড়িয়ে আছে দুটো ঝাঁকড়া নাতি দীর্ঘ আশ্চর্য গাছ।.. মূল সিঁড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পথে এসে মিশেছে যে সান বাঁধানো সরু মতন রাস্তাটা, তার দুপাশে রয়েছে সারি সারি রজনীগন্ধার ঝাড়, আর বড় বড় ফুলে অবনত অসংখ্য সূর্যমুখীর গাছ।… রাস্তার আবেষ্টনীরর মধ্যে প্রায় চতুষ্কোণ গোছের যে জমিটুকু রয়েছে, তাতে রয়েছে অনেকগুলো গোলাপ গাছ, আর প্রায় মধ্যস্থলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি সুন্দর ছোটোখাটো ঝাউগাছ। এছাড়া দু-দুটো হাসনাহানার ঝাড় আছে, গোলক চাঁপার গাছ আছে, অপরাজিতা আছে, কী নেই? মায় শিউলীও বাদ পড়েনি।”

পাখি ব্যাতিরেকে মালঞ্চ হয় নাকি? নন্দনতত্ত্বে ‘বায়ো-অ্যাস্থেটিক গার্ডেন’ থাকবারই কথা, কারণ অধ্যাপক হরিপদ ভারতী ছিলেন দর্শনের শিক্ষক। কাজেই এরপর উনার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বাগানের টিয়াপাখির ঝাঁক, বউ কথা কও আর নিশিবকের দিকে। এই কাননের নয়নানন্দ তাঁকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে কানন সৃষ্টির কারিগরদের বিচক্ষণতা ও তাদের সৃজন ক্ষমতাকেও তারিফ করেছেন। মনে করেছেন এই সৃষ্টি নিতান্তই একপেশে কাজ নয়। তাঁর দৃষ্টি পড়ল সামনের পাঁচিলের গা ঘেঁষে ডালপালা বিস্তার করে দাঁড়িয়ে থাকা পেয়ারা গাছের দিকে। ফলাহারে ব্যস্ত এক ঝাঁক ঝকঝকে টিয়াপাখি। এডাল থেকে ওডালে, ওপর থেকে নীচে মুহুর্মুহু স্থান পরিবর্তন করে, ডানা ঝাপটে, টিট্টি টিট্টি শব্দের কলরব তুলে পাকা ডাঁসা অসংখ্য নধর নধর পেয়ারা খেতে তারা ব্যস্ত। শুধু টিয়াপাখির রূপেই তিনি আকৃষ্ট হলেন তাই নয়, ওই পেয়ারা গাছের পাশে পাঁচিল ঘেঁষে এক ছোট্ট আমগাছে একটি হলদে বউ কথা কউ পাখিকে নজর করলেন। লিখছেন, “কিন্তু ওই টিয়াপাখির রূপেই কি বেশিক্ষণ আকৃষ্ট হয়ে থাকবার উপায় আছে এখানে! একটা অত্যন্ত সুন্দর হলদে পাখি আবার কোত্থেকে যেন উড়ে এসে বসল…খানিকক্ষণ চেয়ে চেয়ে ওই হলদে পাখিটাকে দেখলাম।”

হলদে পাখি দেখতে দেখতেই বিকট চীৎকারে অনেকগুলি পাখি ডেকে উঠল কোথা থেকে! অধ্যাপক ভারতী প্রথমে ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি। ‘কোয়াক কোয়াক’ করে সেই ডাক। সিঁড়ি দিয়ে নামলেন, দুই পা এগোতেই বুঝলেন পুরো ব্যাপারটা। দোতালায় উঠবার সিঁড়ির ঠিক পাশে বাঁ দিকে বিরাট এক আম গাছ। তাতেই আস্তানা গেড়ে শাখায়-প্রশাখায় বসে রয়েছে বিচিত্র-দর্শন অসংখ্য বক — শরীরটি সাদাটে, পিঠের অংশে কালো এক চিলতে রং আর মাথায় ঝুঁটি। শুধু আমগাছই নয়, পাশের উঁচু উঁচু পামগাছের মাথাতেও তাদের অবস্থিতি। জেল-অঙ্গন ছাড়িয়ে বাইরের নানান গাছেও তারা রয়েছে অজস্র। অধ্যাপক ভারতী লিখছেন, “এই অঙ্গনের পাঁচিলের বাইরেও যতদূর চোখ যায় — সর্বত্রই আম গাছে, তেঁতুল গাছে, অশ্বত্থবৃক্ষে সর্বত্রই ওই বকালয়। অন্যান্য আরও অনেক ছোট বড় পাখিও অবশ্য রয়েছে পাশাপাশি।”
আরও যে সমস্ত গাছ তাঁর নজরে পড়েছে তা হল, রান্নাঘরের গা ঘেঁষে গোলক চাঁপার গাছ; তার পাশে একটি ছোটো আমগাছ এবং তার মাথা জুড়ে ঝিঙ্গে গাছের লতা; বাড়ির পেছনেও গোলক চাপা ফুলের গাছ ও তাকে লতিয়ে-পেঁচিয়ে ওঠা বরবটি, পেয়ারা গাছ, কাঁঠাল গাছ সমেত নানান ফলের গাছ; অনেকখানি জায়গা জুড়ে এঁকে বেঁকে জন্মানো কুমড়ো লতা; ঢেড়স, লঙ্কা, লাল শাকের মত সব্জির গাছ এবং পাঁচিল বরাবর কিছুটা আখের গাছ।

হরিপদ ভারতীর জেল-জীবনে শ্রীঅরবিন্দ-স্মরণ

১৯০৮ সালে অরবিন্দ যখন জেলে, তখনও বাক-স্বাধীনতা হরণ করেছিল ব্রিটিশ সরকার। হরিপদ ভারতীর লেখা বই-এ শ্রীঅরবিন্দের কারাজীবনের কথা এসেছে, তার লেখা থেকেই বক্তব্যের উজ্জ্বল উদ্ধার করতে চাই। আজ দুটি গ্রন্থের তুলনামূলক আলোচনা করবো এবং অবশ্যই নিয়ে আসবো শ্রীঅরবিন্দ প্রসঙ্গ।

অধ্যাপক হরিপদ ভারতী ও তাঁর সহমতাবলম্বীরা ১৯৭৫ সালে জেলের মধ্যেই পালন করেন স্বাধীনতা দিবস। সেই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, বন্দেমাতরম, জয়হিন্দ ধ্বনির মধ্যে জাতীয় পতাকা উড্ডীন করেন কারান্তরালে থাকা বন্দীদের এক দল। আলিপুর জেলের যে ঘরে নেতাজী বন্দী ছিলেন বন্দীরা সেখানে গেলেন ও তাঁর প্রতিকৃতিতে মালা দিলেন, দেওয়া হল পুষ্পার্ঘ্য। এরপর সবাই গেলেন শ্রীঅরবিন্দের ঘরে। এবার হরিপদ ভারতীর ভাষায় বলি, “প্রথমেই আমরা গিয়ে থামলাম ঋষি অরবিন্দের আবক্ষ প্রস্তর মূর্তির সামনে। ওই মূর্তির পেছনেই ঋষি অরবিন্দের পুণ্যস্মৃতি-বিজড়িত ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ। জেলের ভাষায় সেল। এক সময় ওই সেলেই সেদিনের মহাবিপ্লবী মহানায়ক অরবিন্দ দিনের পর দিন অতিবাহিত করেছেন। ওই সেলে বসেই একদিন ওই কক্ষের মধ্যেই তিনি ভগবান বাসুদেবের দর্শন লাভ করেছিলেন। তা প্রথমেই আমরা পুণ্য প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করলাম। অরবিন্দের জয়ধ্বনি দিলামপুষ্পাঞ্জলি দিলাম প্রথমে ভগবান বাসুদেবের প্রতিকৃতিতে। পুষ্পাঞ্জলি দিলাম একে একে শ্রীঅরবিন্দ ও শ্রীমায়ের প্রতিকৃতিতে। তারপর বাইরে এসে সশ্রদ্ধ পুষ্প মালিকা দুলিয়ে দিলাম শ্রীঅরবিন্দের প্রতিকৃতিতেও। এখানে দাঁড়িয়ে তরুণ বন্ধুরা অরবিন্দের উদ্দেশ্যে রচিত একখানা বন্দনা গানও গাইলেন। তা ও সময়ে ওখানে আমরা ক’টি প্রাণীই যে ছিলাম, তা নয়। ও জেলের অনেক বন্দী, মায় মেয়াদি অপরাধীরা পর্যন্ত তখন ওখানে নিষ্ঠার সঙ্গে নীরবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের অনুষ্ঠান দেখছিলেন।…. অরবিন্দ অনুষ্ঠানের পরে আমরা দল বেঁধে গেছি জেল গেটের দিকে। ঠিক ওই জেল ফটকের সামনাসামনি পুষ্পোদ্যানের ভেতরে রয়েছেন দেশ গৌরব নেতাজী সুভাষ। শ্বেত প্রস্তরের আবক্ষ মূর্তিরূপে তিনি বিরাজ করছেন। তা তাঁর কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে প্রণাম জানালাম। তাঁর গলায় পুষ্পমালা পরিয়ে দিলাম। জয়ধ্বনি দিলাম, নেতাজী সুভাষ জিন্দাবাদ। সোচ্চারে দেশ বন্দনা করলাম — জয় হিন্দ।”

কারাকাহিনী‘ – গ্রন্থে নিজের কুঠুরি সম্পর্কে শ্রীঅরবিন্দ লিখছেন, “আমার কারাগৃহটি নয় ফুট দীর্ঘ, পাঁচ ছয় ফুট প্রস্থ ছিল। ইহার জানালা নাই, সম্মুখভাগে বৃহৎ লোহার গরাদ, এই পিঞ্জরই আমার নির্দিষ্ট বাসস্থান হইল। ঘরের বাহিরে একটী ক্ষুধার্ত উঠান, পাথরের জমি, ইটের উচ্চ দেওয়াল, সামনে কাঠের দরজা। সেই দটরজার উপরিভাগে মানুষের চক্ষুর সমান উচ্চতায় ক্ষুদ্র গোলাকার রন্ধ্র, দরজা বন্ধ হইলে শান্ত্রী এই রন্ধ্রে চক্ষু লাগাইয়া সময় সময় দেখে, কয়েদী কি করিতেছে।… একখানা থালা ও একটী বাটী উঠানকে সুশোভিত করিত।…ঘরের ভিতরেই দুইখানা আলকাতরা মাখান টুকরী দেওয়া হইত। সকালে ও বিকাল বেলায় মেথর আসিয়া তাহা পরিষ্কার করিত, তীব্র আন্দোলন ও মর্মস্পর্শী বক্তৃতা করিলে অন্য সময়েও পরিষ্কার করা হইত, কিন্তু অসময়ে পায়খানায় গেলে প্রায়ই প্রায়শ্চিত্তরূপে কয়েক ঘন্টা দুর্গন্ধ ভোগ করিতে হইত।….বলা বাহুল্য, এই ক্ষুদ্র ঘরে এমন ব্যবস্থা থাকায় সর্বদা, বিশেষতঃ আহারের সময় এবং রাত্রিতে বিশেষ অসোয়াস্তি ভোগ করিতে হইত। জানি, শোবার ঘরের পার্শ্বে পায়খানা রাখা, স্থানে স্থানে বিলাতী সভ্যতার অঙ্গবিশেষ, কিন্তু একটী ক্ষুদ্র ঘরে শোবার ঘর, খাবার ঘর ও পায়খানা — ইহাকেই too much of a good thing বলে। আমরা কু-অভ্যাসগ্রস্ত ভারতবাসী, সভ্যতার এত উচ্চ সোপানে পৌঁছা আমাদের পক্ষে কষ্টকর।”

( লেখক বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক )

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.