নীলগঞ্জ গণহত্যাঃ আজাদ হিন্দ ফৌজের সাথে ঘটা এক অজানা অধ্যায়

১৯৪৫ সালের পশ্চিমবঙ্গের ব্যারাকপুরের নীলগঞ্জ গণহত্যার কথা আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেন না। দু’হাজারেরও বেশি আজাদ হিন্দ বাহিনীর (আইএনএ) জওয়ানকে ব্রিটিশরা ডিটেনশন ক্যাম্পে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছিল। একেই বলে নীলগঞ্জ গণহত্যা কাণ্ড। আচমকা একদিন অতীশ বসাকের এক ফেসবুক পোস্ট আমার নজরে আসে। ওই ফেসবুক পোস্টে অবসরপ্রাপ্ত এক স্কুল শিক্ষক শিবশঙ্কর ঘোষের বয়ান সম্বলিত একটি ভিডিও ছিল। ঘোষবাবু নিজের চোখে দেখেছেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর জওয়ানদের মৃতদেহ ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল ট্রাক থেকে। এ কথা জানতে পেরে আমার বিবেক-হৃদয় কেঁপে ওঠে। এই ঘটনার তথ্যগত প্রমাণ আমি চাই অতীশ বসাকের কাছে, যাতে কিছু করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ওঁর কাছে কিছু ছিল না।

এরপর আমি মধুছন্দা কাঞ্জির সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি কলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা। তিনি আমাকে ডঃ জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলেন। চৌধুরীবাবু আমাকে বলেন তিনি ঝিকরগাছা ক্যাম্প নিয়ে কাজ করেছেন। নীলগঞ্জ ক্যাম্পে জয়ন্তবাবু নিজে কাজ করেছেন। বর্তমানে ওই ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারত সরকারের পাট শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এর পোশাকি নাম সেট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর জুট অ্যান্ড অ্যালাইড ফাইবার্স। কৃষি মন্ত্রকের আওতাধীন এটি। তিনি আমাকে বলেন, পাট শিল্প প্রতিষ্ঠানের লোকেরা এই হিমঘরে চলে যাওয়া ইতিহাস নিয়ে গবেষণা পছন্দ করেন না। এঁরা এ ব্যাপারে মোটেই উৎসাহী নন। তিনি অনেক কষ্ট করে প্রতিষ্ঠানের ভেতরের ছবি তুলেছেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করি, নীলগঞ্জ গণহত্যা প্রসঙ্গে কোনও নথি তাঁর কাছে আছে কি? দুর্ভাগ্যবশত তাঁর কাছে কিছুই নেই। তিনি কিছু বইয়ের কথা অবশ্য আমাকে বলেন। নীলগঞ্জ নিয়ে কিছু একটা করার জন্য সরকারের দ্বারস্থ হতে হবে, কিন্তু সরকারের দ্বারস্থ হতে হলে উপযুক্ত নথিপত্র প্রয়োজন। এভাবে শুরু হল নথিপত্র খোঁজা। কোথায় খুঁজব এই নৃশংস কাণ্ডের তথ্যপ্রমাণ?

ন্যাশনাল আর্কাইভে যাই। প্রথম দিন কোনও পাস ছাড়াই আর্কাইভে প্রবেশ করি। গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকা জেনারেল সেকশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী আমাকে নাম পঞ্জিভুক্ত করতে বলেন। এরপর আমি আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কিত ফাইলের খোঁজ করি। তিনি আমাকে চতুর্থতলে থাকা প্রাইভেট আর্কাইভে খোঁজ করতে বলেন। সেখানে ফের আমি নাম নথিভুক্ত করাই। ৯৯৫-৯৯৭টি ফাইলের তালিকা আমার হাতে এল। আমাকে বলা হল, প্রয়োজনীয় ফাইল চিহ্নিত করে দিতে। আমি বুঝতে পারি, কমপক্ষে তিন-চার দিন লাগবে আমার। এই ফাইল তালিকায় আদৌ আমার প্রয়োজনীয় কিছু আছে কি না, সেটাও আমার জানা নেই। ইলেক্ট্রনিক্যালি এই ফাইল তালিকা পাওয়া যাবে? জানতে পারি, ইলেক্ট্রনিক্যাল তালিকা নেই। তবে স্কান করা ফাইল কম্পিউটারে রয়েছে। এই শুরু হল আমার প্রকৃত তথ্য অনুসন্ধান পর্ব। নীলগঞ্জ বানান, ইংরেজিতে বিভিন্নভাবে কি-ওয়ার্ড হিসেবে ব্যবহার করলাম । Nilganj, Nilgunj, Neelganj, Neelgung – বানান তো অনেকবার পাল্টালাম। কিন্তু কিছুই পেলাম না। এই নামে কিছু ফাইল পেলাম, তবে এগুলিতে নীলগঞ্জ গণহত্যা প্রসঙ্গে বিন্দুবিসর্গও নেই। যেমন একটি ফাইল পেয়েছি, তাতে নায়েক গিরওয়ার সিংয়ের আর্জি। নীলগঞ্জে যখন তাঁকে বন্দি করা হয়, তখন তাঁর কাছ থেকে ৭০ টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। রিলিজ হবার পর নায়েক গিরওয়ার এই টাকা ফেরত চেয়েছেন। আমি জানি, আমি যা খুঁজছি তা তো এখনও অধরা। অনেক মাস পর হাতে এল এক নথি।

সেই নথি ১৯৪৫ সালের ১২ অক্টোবরের। চিঠি প্রেরক মেজর জেনারেল, এইচ কিউ ৩০৩ এল অফ জি এরিয়া। চিঠি পাঠানো হয়েছে — জিএস বান্ড, ডিএমআই (ডিরেক্টরেট অফ মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স) , জিএইচকিউ; দিল্লি। এই চিঠিতে রয়েছে সেই কাণ্ডের কথা । ১৯৪৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর রাতের সেই ভয়ানক কাণ্ডের কথা। নীলগঞ্জ ক্যাম্পের পাহারার দায়িত্বে থাকা ২৬/৩ মাদ্রাজ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ই আর আর মেনন যুদ্ধাপরাধীদের (প্রিজনার অফ ওয়্যার) কারাগারে আসেন। আনুমানিক ১০টায় তিনি রোলকলের নির্দেশ দেন। যুদ্ধাপরাধীরা এতে অস্বীকার করেন। এরপর তিনি চলে যান। কোয়ার্টার গার্ডে অ্যালার্ম রাজিয়ে দেন ক্যাপ্টেন মেনন। ফের টমি-গান নিয়ে আসেন। পুরো কোম্পানি তাঁর পেছন পেছন আসে। পাথর-ইট-বাঁশ যুদ্ধাপরাধীরা তার দিকে ছোঁড়েন। এতে তাঁর কোম্পানির লোকরা চিৎকার করতে থাকেন, ‘আমাদের কোম্পানির কমান্ডার খতম।’ এরপর ব্রিটিশ ভাষ্য অনুসারে ওসি মেনন বলেন, তাঁর কোম্পানির লোকেরা গুলি চালিয়েছে। অথচ কোম্পানির লোকেরা বলেছে, ওসি মেনন গুলি চালিয়েছেন।
  

আমি বিশ্বাস করি, এরা সবাই এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছেন গোটা রাত, সেখানকার যুদ্ধাপরাধী সবাইকে খুন করার জন্য। আশপাশ এলাকার বাসিন্দারা ( সে সময় ওই এলাকা পরিত্যক্ত ছিল) গোটা রাত গুলির শব্দ গুনেছেন। দুজন সাক্ষী এখনও জীবিত। পরদিন বাসিন্দারা দেখেছেন, ট্রাক বোঝাই করে মৃতদেহ নিয়ে যেতে। রাস্তায় ট্রাক থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়তে ওঁরা দেখেছেন। ওই মৃতদেহগুলি নােয়াইখালের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়েছে বা ফেলে দেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসের পাম গাছের পাশ থেকে কিছু মৃতদেহ খুঁড়ে তোলা হয়েছে। আমি এই পুরো ফাইল জেরক্স করে ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে নিয়ে এসেছি।

আশ্চর্যের, এই গণহত্যার মাত্র তিন দিন আগে এক অর্ডিন্যান্স জারি হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, জওয়ানের নির্দেশ মেনে থামতে অস্বীকৃত হলে বা কোনও সম্পত্তি ধ্বংস করলে বা ধ্বংস করার অভিপ্রায় রাখলে ক্যাপ্টেন বা এর ঊধর্বতন পদমর্যাদার কোনও আধিকারিক বলপ্রয়োগ করতে পাবেন যা মৃত্যুর কারণ অবধি হতে পারে (আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট ১৯৪২, অর্ডিন্যান্স এসএলআই অফ ১৯৪২)। ব্রিটিশ নিশ্চিতভাবে সহস্রাধিক যুদ্ধাপরাধীকে ডিটেনশন
ক্যাম্পগুলিতে( টেকনিক্যালি বলা হত ইসিডিসি- ইস্টার্ন কম্যান্ড ডিটেনশন সেন্টার্স) রাখতে রাজি ছিল না। লালকেল্লায় বিচারপর্বের আগে এঁদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা বিপজ্জনক ছিল। সারা দেশে বিদ্রোহের ডঙ্কা যাতে আরও তেজি না হয়ে ওঠে সে জন্য ব্রিটিশ এই যুদ্ধাপরাধীদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখতে চায়নি। গণহত্যা(নথিতে প্রমাণিত) শেষে ক্যাম্প খালি করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের তাড়াহুড়ো, ওই এলাকার নির্জনতা, ব্রিটিশ প্রভাবিত সংবাদমাধ্যম, সব কিছু মিলে এটা স্পষ্ট, ব্রিটিশ প্রকৃতপক্ষে পরিকল্পনামাফিক আজাদ হিন্দ বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের গণহত্যা চালিয়েছে এবং সম্পূর্ণ বিষয়টি দাবিয়ে দিয়েছে।

আমি ভাবলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমি এই নিয়ে এক জাতীয় সংবাদমাধ্যমের চ্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগ করি। নয়ডায় এক খ্যাতনামা সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয় আমার। আমি তাঁকে সব নথিপত্র দেখাই। সব নথিপত্র পড়ে তিনি আমাকে বলেন, ওরা তো বলছে কেবল ৫ জন মারা গিয়েছে। তখন আমি তাঁকে বলি, যদি আপনি কেবল একটি খুন করেন, তা হলে ধরা পড়ার জন্য প্রমাণ-নথি রেখে দেবেন না এগুলি ধ্বংস করে দেবেন, ২ হাজারেরও বেশি লোককে ঠাণ্ডা মাথায় যখন খুন করা হয়েছে! কিংবদন্তি কর্নেল জি এস ধলন নিজের ডায়েরিতে এ ব্যাপারে লিখে গিয়েছেন। এর চেয়ে আর কী বেশি প্রমাণ লাগে আপনার? এ কথা জিজ্ঞেস করি সাংবাদিককে। তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও কলকাতার এক রিপোর্টারকে এ নিয়ে কাজ শুরু করতে বলেন। আমি এই কাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি গ্রহণের জন্য কলকাতার ওই সাংবাদিককে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে বলেন, তিনি নিজে থেকে তা রেকর্ড করতে পারবেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ নয়ডার ওই প্রবীণ সাংবাদিকের অনুমোদন লাগবে। কিন্তু সেই অনুমতি আর মেলেনি। সব মিলিয়ে নির্যাস, ওই টেলিভিশন চ্যানেলে এই নীলগঞ্জ গণহত্যা সম্পর্কিত কোনও শো আর প্রদর্শিত হয়নি।

ডঃ জয়ন্ত চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন, ওই রাতে হত ১৫৮০ জনের তালিকা তার কাছে আছে । তিনি এই ফাইল পরে আর খুঁজে পাননি। একসময় আমি তাঁর কাছ থেকে এ সংক্রান্ত কোনও ফাইল পাইনি। আমি বিজয় নাগের সঙ্গেও যোগাযোগ করি। জয়শ্রী ম্যাগাজিনের প্রকাশক তিনি। একটি ফেসবুক পোস্টে তিনি উল্লেখ করেন, ১৫৮০ জনকে হত্যা করা হয়েছে নীলগঞ্জ ক্যাম্পে। বিজয় এ ব্যাপারে মধুসূদন পালের সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দেন আমাকে। মধুসূদন আমাকে বলেন, ঝিকরগাছা নামে একটি ফাইল আর্কাইভে রয়েছে। এই ফাইলে ওই সময় বন্দি ১৫৮০ জন জওয়ানের নাম রয়েছে। কিন্তু গণহত্যার বলি যাঁরা হয়েছেন, তাঁদের নামের তালিকা নেই।

আমি বুঝতে পারছিলাম, আমি অযথা এদিক-ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছি। এঁদের কারও কাছে নির্দিষ্ট তথ্য নেই। তাই এর তথ্য অনুসন্ধান আমি বন্ধ করে দিই। এরপর আমি বিস্তারিতভাবে একটি চিঠি লিখি প্রধানমন্ত্রীর কাছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে কোন স্মারক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে নীলগঞ্জের পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়ার অনুরোধ করি। আমি চিঠির প্রতিলিপি কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী এবং পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরকে দিই। পাশাপাশি নীলগঞ্জের নেতাজি সুভাষচন্দ্র মিশনের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করি। এই ইস্যুতে এই সংস্থা দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে। ওই দিন এরা প্রতি বছর প্রতিষ্ঠানের বাইরে অনুষ্ঠান করে থাকে। আমি স্থানীয় সাংসদ ও তাঁর ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গেও কথা বলি। এই প্রস্তাবিত অনুষ্ঠানের গুরুত্ব সম্পর্কে আমি ওঁদের বলি। আমি কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমরকে মুখ্য অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।

নেতাজি মিশনের সম্পাদক সুপ্রিয়রঞ্জন বসু ও অরূপ ঘোষ এ নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন পাট গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরের ব্যক্তিগত সচিবের সঙ্গে। তিনি তাঁদের আশ্বাস দিয়েছিলেন, প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছে । এ নিয়ে আমি অনেক দৌড়ঝাঁপ করি । ২০১৯-এর ২৫ সেপ্টেম্বর হবার কথা ছিল অনুষ্ঠান। কিন্তু লালফিতের ফাঁসে তা আর হয়ে ওঠেনি। আমি কৃষিমন্ত্রী তোমরের সঙ্গে দেখা করে তাকে মুখ্য অতিথি হওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন অনুষ্ঠান হবে। অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি আসতে পারবেন না। হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন তিনি। কিন্তু কিছুই হল না। নেতাজি মিশন অবশ্য প্রতি বছরের মতো গত ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠান করে প্রতিষ্ঠানের বাইরে।

কবে সেই পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রকাশিত হবে, এই প্রশ্ন নেতাজি অনুরাগীদের। এ ব্যাপারে মধুছন্দা কাঞ্জি, জয়ন্ত চৌধুরী, মধুসূদন কাঞ্জি, সুপ্রিয়রঞ্জন বসু, অরূপ ঘোষ প্রমুখ অনেক সাহায্য করেছেন আমাকে। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.