প্ল্যাটফর্মে কৃষ্ণ লীলা, ট্রেনের গায়ে দশভুজা, মৈথিলি চিত্রকলায় সেজে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে বিহারের মধুবনী স্টেশন

দেওয়াল জুড়ে গ্রাম্যজীবনের রঙিন দৃশ্যপট। ট্রেনের গায়ে রাম-সীতা বা পুরানের কোনও গল্পগাথা। প্ল্যাটফর্মের আনাচ কানাচে রাধা-কৃষ্ণের প্রেম লীলা। একটা গোটা রেল স্টেশনকে মধুবনী বা মৈথিলি চিত্রকলার আদরে মুড়ে ফেলেছে বিহার,— মধুবনী স্টেশন।

রাজ্যের সুপ্রাচীন সংস্কৃতির ছোঁয়া এই স্টেশনের সর্বত্র। রামধনুর সাত সুর খেলে এই স্টেশনের ইট-কাঠ-পাথরে। মৈথিলি লোকগাথার গল্প বলে স্টেশন। ৬৬তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ‘বেস্ট ন্যারেশন’ বিভাগে তাই সেরার শিরোপা জিতে নিয়েছে বিহারের মধুবনী স্টেশন।

১৪ হাজার বর্গফুটের গোটা স্টেশনটাই মধুবনী চিত্রকলার সাজে সজ্জিত। প্ল্যাটফর্মের দেওয়াল, যাত্রীদের বসার বেঞ্চ, সিঁড়ির প্রতিটা ধাপ রাঙিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় মৈথিলি শিল্পীরা। প্রায় ২০০ শিল্পীর নিখুঁত তুলির ছোঁয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠেছে পুরানের গল্প, মহাভারত-রামায়ণ, অথবা গ্রামের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীও এই শিল্পের একটা বিশেষ অঙ্গ। শিল্পীদের মধ্যে ৮০ শতাংশই মহিলা। বিনামূল্যে স্টেশন সংস্কারের কাজ শুরু করেছেন বহুদিন ধরেই।

বিহারের মধুবনী জেলার এই স্টেশনের তিনটি প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। সবকটি মধুবনী চিত্রকলায় সেজে উঠেছে। গত বছর অক্টোবরের শেষ থেকে স্টেশন সংস্কারের কাজ শুরু করেছে রেল মন্ত্রক। দেশের সুন্দর রেল স্টেশগুলির তালিকায় দ্বিতীয় স্থানেই রয়েছে মধুবনী স্টেশন।

ইদানীং মধুবনী পেন্টিং হিসেবে নাম করলেও, শতাব্দী প্রাচীন এই শিল্পের জন্ম মিথিলা রাজ্যে। লোকগাথা, কল্পনা আর বাস্তবকে তুলির টানে জীবন্ত করে তুলেছিলেন মহিলারাই। মৈথিলি বা মধুবনী শিল্পের মূল আকর্ষণ এর জ্যামিতিক নকশা এবং হরেক রঙের বাহার। প্রতিটা ছবির মূল বৈশিষ্ট্য প্রাচীন লোকগাথা। পুরানের টুকরো টুকরো ঘটনাও প্রাঞ্জল হয় তুলির ছোয়াঁয়। স্থানীয় কোনও উৎসবের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয় গ্রামের গাছ, পালা, নদ-নদী। হোলি থেকে বাঙালির দুর্গাপুজা, মৈথিলি চিত্রকলায় জায়গা পেয়েছে সবই। শাড়ির নকশাতেও মধুবনীর পেন্টিং বেশ জনপ্রিয়। মধুবনী সিল্কের জনপ্রিয়তা রয়েছে সব রাজ্যেই।

মধুবনী রেল স্টেশন বলে নয়, মধুবনী জেলার রাস্তাঘাটেও এই চিত্রশিল্পের বিন্যাস দেখা যাবে। রামপট্টি থেকে রাজনগর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা এখন ‘মধুবনী সরণী’। এই পথের দু’ধারে গাছে গাছে আঁকা চিত্রকলা পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণ। শহরের স্বচ্ছতা ও রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে পটনা শহরেও এখন মধুবনী শিল্পের কারুকাজ। শহরের ৩০টিরও বেশি এলাকাকে দেওয়াল-চিত্রণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। প্রায় ৫০০ শিল্পীর তুলিতে শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে রাম-সীতা, গুরু গোবিন্দ সিংহ থেকে দশভুজা দুর্গা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.