এবার কাশ্মীরি জনজীবনে স্বাভাবিকতা ফেরার সময়

কেউ বিষয়টার সঙ্গে একমত হতেও পারে নাও হতে পারে। কিন্তু ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ২৩ জন সাংসদের কাশ্মীর সফর কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে টেনে এনেছে। কিছুটা মতবিরোধ এই নিয়ে চলছে যে এই প্রচেষ্টাটি কি কেবলই দেখনদারি ছিল? না কি এটি ভারত-ইউরেপীয় কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে একটি বড়োসড়ো পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে? পাকিস্তানের তরফে নিরন্তর কাশ্মীর নিয়ে যে অপপ্রচার চলে আসছে তাকে রুখতে এটি কি তবে counter offenssive-এর কাজ করবে? ভারতের হাতে কি নতুন হাতিয়ার উঠে আসবে? মাত্র কয়েকদিন আগেই পূর্বতন জম্মু ও কাশ্মীরের ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক পরিচয় বদলে দুটি কেন্দ্ৰ শাসিত অঞ্চলের সৃষ্টি করেছে। একটি জম্মু-কাশ্মীর, অপরটি লাদাখ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর। ভাষায়—‘ভারতীয়দের মধ্যে বাধা হয়ে থাকা অস্থায়ী দেওয়ালটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই প্রশ্ন বা বিশ্লেষণগুলি নিয়ে ভাবার আছে।
সঠিক রাজনৈতিক প্রোটোকলের মাপকাঠিতে ধরলে ইউরোপের সাংসদীয় প্রতিনিধিদের এই সফরকে সে অর্থে সরকারি তকমা দেওয়া যাবে না। বাছাইকরা বিশেষ কিছু সাংসদ ভারতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে, মত বিনিময়ের অভিপ্রায়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে এ দেশে এসেছেন। কিন্তু যখন কোনো বিদেশি সাংসদদের প্রতিনিধি দল প্রথমে দেশের প্রধানমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, শ্রীনগরে অধিষ্ঠিত ১৫টি বিশেষ পুলিশ বাহিনীর জিওসি সেখানকার মুখ্যসচিব, নগরপাল ও আঞ্চলিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মিলিত হন তখন ‘বেসরকারি সফর’ তকমাটি একটু দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ধারা ৩৭০ বিলেপের পর যখন শ্রীনগরে বাইরের লোকের আসা যাওয়া কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
অবশ্যই কাশ্মীর সম্পর্কে ভারত তার দৃষ্টিকোণ, পরিস্থিতি নিজস্ব অভিজ্ঞতায় তুলে ধরতেই পারে। তবে Madi Sharma যিনি নিজস্ব টুইটারে নিজেকে ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মধ্যস্থতাকারী’বলে বর্ণনা করেছেন তিনিই ছিলেন এই সফরটির আয়োজক। আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদদের দেশে নিয়ে এসে আপ্যায়ন করা বিশ্ব কূটনীতিতে আদৌ নতুন নয়। এ কাজটা পাকিস্তান হরবকতই করে থাকে। এ প্রসঙ্গে গত ৭ অক্টোবর মার্কিন সেনেটর CH Hollen, Maggic Hassan Paul Jones apocals মোজাফরাবাদ সফরে যান। এই মোজাফরাবাদই পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী। ভারতের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সাংসদদের ভ্রমণের আয়োজনের পদ্ধতিটি কিছুটা নতুন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধীরা প্রশ্ন তুলছেন যদি বিদেশি প্রতিনিধিরা। সেখনে গিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন করে সর্বশেষ পরিস্থিতি সরেজমিনে দেখে তাদের বিশ্লেষণ তৈরি করতে পারেন তাহলে দেশীয় সাংসদরা সে সুযোগ পাবেন না কেন ?এ বিষয়ে জার্মানি থেকে আসা সাংসদ বিরোধীদের সঙ্গে কিছুটা তাল মিলিয়েই বলেছেন তারা সুযোগ পেলে ভারতীয় সাংসদদেরও অধিকার থেকেই যায়। তাই বিরোধীরা ভবিষ্যতে কবে সেখানে যেতে পারবে এ কৌতুহল তাঁদের থাকবেই।
গত ২৪ আগস্ট রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে ৮ দলের এক প্রতিনিধি দলকে শ্রীনগর বিমান বন্দর থেকেই ফেরত পাঠানো হয়। এই বিষয়টার আর একটু কৌশলী। মোকাবিলার দরকার ছিল। অবশ্য পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে কংগ্রেস নেতা ও জম্মু কাশ্মীরের ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী গোলাম নবি আজাদ সে রাজ্যে সফর করেছেন।
বিচ্ছিন্নভাবে না গিয়ে এই বার একটা সর্বদলীয় প্রতিনিধিদলের সফরসূচি ঠিক করে দিয়ে শ্রীনগরে পাঠানোর কথা ভাবা যেতে পারে। দেশের নিরাপত্তার কথাটি ধরে নেওয়া যায় সকলেই বোঝেন। আরও একটা কথাও মাথায় রাখা যেতে পারে ৩৭০ ধারা বাতিলের সময় সংসদের উভয় সভাতে বিরোধীরাও হাত খুলে সমর্থন দিয়েছিল। তাই একটা চাপা বিক্ষোভের পরিস্থিতিকে সঠিক পথে আসতে, দীর্ঘদিনের পুরনো বিরোধিতার মানসিকতাকে নিরাময় করতে একটি বহুদলীয় প্রতিনিধি নিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার চেষ্টা করা যেতে পারে। আম জনতার কাছে পৌঁছনোর এটাও নতুন পথ হতে পারে।
কাশ্মীরে সদ্য ব্লক উন্নয়নের নির্বাচন প্রক্রিয়া সমাপ্ত হলো। দশম শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষায় মোট ৮৮৮৩২ পরীক্ষার্থীর ৯৯ শতাংশ পরীক্ষায় বসেছে। বড়ো কম কথা নয়। শাসক দলের সাংসদ সুহ্মণ্যম স্বামী ও জোটসঙ্গী শিবসেনার কেউ কেউ এই সফরকে ভ্রান্ত পদক্ষেপ বলে ব্যাখ্য করেছেন। তাদের যুক্তিতে যেখানে ভারত বরাবর কাশ্মীরের বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে আনার বিরোধী এই প্রচেষ্টা তাই স্ববিরোধিতার শামিল। সরকার অবশ্য এর তীব্র বিরোধিতা করেছে। পররাষ্ট্র বিষয়ক দপ্তরের তরফে বলা হয়েছে“দেশের প্রকৃত ও সত্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলকে সঠিকভাবে ওয়কিবহাল করা আর কোন পরিস্থিতিকে বিশ্ব পরিসরে ঢাক ঢোল পিটিয়ে তুলে ধরে তাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকা আদৌ এক জিনিস নয়। দেশের দৃষ্টিকোণকে বিশ্ব পরিসরে তুলে ধরা আর আন্তর্জাতিকীকরণের মধ্যে আমূল পার্থক্য আছে। তবু এই পরিপ্রেক্ষিতে পররাষ্ট্র নীতি বিশেষজ্ঞ রাজ মোহন একটু হালকা মেজাজেই বলেছেন—“যাইহোক কাশ্মীর নিয়ে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ঘুম ছুটে যাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।” আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের পক্ষে দাঁড়ানোর ও দ্রুত উঠতি বাজারের নাগাল পেতে আজ বহু দেশই উগ্রীব, তাই কাশ্মীর নিয়ে যে অযথা আতঙ্ক তাও বহুলাংশেই তিরোহিত হয়েছে। এই খেই ধরেই বলা যায় কাশ্মীরই হোক বা অন্য যে কোনো বিষয়ের ক্ষেত্রেই ভারতের সব থেকে জোরের জায়গা ও সর্বাপেক্ষা মহার্ঘ প্রদর্শনের বস্তু হলো দেশের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক পরম্পরা। ভারতের হয়ে যারা বিদেশে দৌত্য করতে যান তাঁদের হাতেও থাকে দেশের গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডল ও খোলামেলা রাজনৈতিক আবহ বিদ্যমান থাকার আয়ুধ দুটি। সে কারণেই স্বাভাবিক রাজনীতির টানা পোড়েনকে আপনগতিতে চলতে দেওয়াই অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সেপটি ভাবের কাজ করবে।
মানতেই হবে, ৩৭০ ধারা বিলোপের পর যে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে তাতে হিংসা ও প্রাণহানি রোধ করা গেছে। কিন্তু ভিন রাজ্যের ট্রাকচালক বা পরিযায়ী শ্রমিক তাদের যেভাবে লক্ষবস্তু করে মারা হচ্ছে তা চিন্তার উদ্রেক করে। বিশেষ করে বিদেশি প্রতিনিধিদের সফরের সময়ই এমন হিংসার ঘটনা ঘটেছে যা অত্যন্ত অস্বস্তিকর। যে সমস্ত ভিন রাজ্যের শ্রমিক নিহত হয়েছেন তারা দীর্ঘদিন ধরেই কাশ্মীরে কর্মরত ছিল। এর অর্থ এই দাঁড়ায় সন্ত্রাসবাদীরা কাশ্মীরে অবশিষ্ট ভারতকে প্রবেশ করতে দিতেই রাজি নয়। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার Terrorism Portal-এর তথ্য অনুযায়ী এ বছরে কাশ্মীরে ২৬৭ জন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন। ২০১৭ সালে ৩৫৭ জন, ২০১৮ সালে ৪৫২ জনের মৃত্যুর প্রতিতুলনায় এবারের সংখ্যাটি নিশ্চয় নিম্নমুখী। কিন্তু মনে রাখতে হবে কাশ্মীরি মানসিকতা বড় দ্রুত বদলায়।
চিরাচরিত মানসিকতা অনুযায়ী যেমন চলছে চলুকের আপাত নিরাপদ পথ থেকে সরে এসে এ যাবৎকাল যা অচিন্ত্যনীয় ছিল সরকার সেই চরম সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহস দেখিয়েছে। ধারা ৩৭০ ধারা এক ধাক্কায় উঠিয়ে দিয়েছে। কাশ্মীর ছাড়া ভারতের অবিশিষ্টাংশে এ নিয়ে বিরোধিতাও কম বেশি থিতিয়ে এসেছে। এখন কঠিনতম পর্যায়টি শ্রীনগরে অনুষ্ঠিত হবে। ২০০০-২০১৬-এর মধ্যে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যগুলিকে দেওয়া ১.১৪ লক্ষ কোটি টাকার সামগ্রিক অনুদানের ১০ শতাংশ কাশ্মীরে গেছে। এখন সব চেয়ে ভালো কাজ হবে এইটাকা সারা রাজ্যে সঠিকভাবে উন্নয়নের কাজে ছড়িয়ে দেওয়া। ভারতীয় গণতন্ত্রিক পরম্পরার শ্রেষ্ঠ উদাহরণগুলিকে সেখানে সঠিকভাবে তুলে ধরা এবং একই সঙ্গে মানুষজনকে বৈরিতা ভুলিয়ে একটি আবেগময় স্পর্শ পৌঁছে দেওয়া।
নলিন মোহতা
(লেখক প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক)