প্রকৃতিত্বঞ্চ সৰ্বস্ত গুণত্রয়বিভাবিনী।

কালরাত্ৰিৰ্মহারাত্রিৰ্ম্মোহরাত্রিশ্চ দারুণ ।

ত্বং শ্রীস্ত্বমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্বং বুদ্ধির্ব্বোধলক্ষণা ॥ 

লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিং শান্তিঃ ক্ষান্তিরেব চ।

তুমি গুণত্রয়স্বরূপিণী, অতএব সকল পদার্থের কারণরূপা।তুমি প্রলয়রাত্রিস্বরূপা এবং মরণরাত্রি ও মােহরাত্রিরূপা,তুমি ভয়ঙ্করী। 

তুমি লক্ষ্মী, তুমি ঈশ্বরী, তুমি লজ্জারূপা, তুমি বােধলক্ষণ।তুমিই লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, ক্ষমা এবং শান্তি।

তিনি কখনো উমা , কখনো গৌরী, পার্বতী হয়ে শিবানী, তিনি বিনম্রা মাতৃস্বরূপা। তিনিই মহামায়া, স্বাহা , স্বধা , তিনিই যুদ্ধংদেহী অশুভনাশিনী  কৌশিকী, কালিকা, চন্ডিকা, বারাহী। তিনিই মহাবিদ্যা , মহামেধা , মহালক্ষ্মী। তিনি কখনো দ্বিভুজা , অষ্টভুজা , দশভুজা,  অষ্টাদশভূজা, বিংশভূজা রূপে পূজিতা। তিনিই এক এবং তিনিই অদ্বিতীয়া। 

যিনি ব্রহ্ম, তিনি আদ্যাশক্তি। যখন নিষ্ক্রিয়, তখন তাকে ব্রহ্ম বলি। পুরুষ বলি। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এসব করেন তাকে শক্তি বলি। প্রকৃতি বলি। পুরুষ আর প্রকৃতি। যিনি পুরুষ তিনি প্রকৃতি। আনন্দময় আর আনন্দময়ী।  পিতা আর জননী। যিনি জগৎরূপে আছেন- সর্বব্যাপী হয়ে তিনি মা।

তিনি তাই কোথাও নদী রূপে, কোথাও বৃক্ষরূপে, কোথাও দূর্বা রূপে, কোথাও ভুমিরূপে ,কোথাও অগ্নিরূপে, কোথাও শিলারূপে পূজিতা। 

সাধকানাং হিতার্থায় ব্রহ্মণো রূপকল্পনা …

দেবী কখনো শুভ্র বর্ণা , কখনো স্বর্ণ বর্ণা, কখনো অতসীপুষ্প বর্ণা,  কখনো নীল বর্ণা , কখনো তিনি শ্যামা , ক্ষেত্র বিশেষে তিনি রক্ত বর্ণা।  

খড়িগনী শূলিনী ঘােরা গদিনী চক্রিণী তথা।

শঙ্খিনী চাপিনী বাণ-ভুশুণ্ডীপরিঘায়ুধা :

সৌম্য সােমতরাশেষসৌম্যেভ্যস্থতিসুন্দরী।

পরাপরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।।

তুমি খড়গ, শূল, গদা, চক্র, শঙ্খ, ধনু, বাণ, ভুলুণ্ডী এবং পরীঘ অস্ত্রধারিণী।

তুমি সুন্দরী, সুন্দরীতরা এবং নিখিল সুন্দর বস্তু হইতে সুন্দরী, ব্ৰহ্মা, ইন্দ্র প্রভৃতির কর্ত্রী  তুমিই “”পরমেশ্বরী”” । 

দশভুজা দুর্গা স্বর্ণ বর্ণা। কিন্তু তিনিই যেহেতু চন্ডিকা তাই রক্ত বা লাল বর্ণা হয়েও এই বঙ্গের কোনো কোনো স্থানে তিনি পূজিতা হন। যেমন – সুপ্রাচীন  নবদ্বীপের লাল দুর্গা। এক বিখ্যাত ব্রাহ্মণ পরিবারে তিনি দেবী রক্তবর্ণা রূপে পূজিতা। 

আজি হতে প্রায় তিন শতাধিক বৎসর পূর্বে এই ব্রাহ্মণ পরিবারের আদি নিবাস ছিল পূর্ব বঙ্গের মানিকগঞ্জে #মিতরা নামক স্থানে। এই ব্রাহ্মণ বংশ অর্ধকালী বংশ নামে বিখ্যাত ছিল। কিন্তু এমন নাম কেন হল ? কেনই বা এই বংশ রক্তবর্ণা দুর্গার উপাসনা করেন ?

আজ হতে প্রায় চারশতাধিক বৎসর পূর্বে পূর্ববঙ্গের ঢাকা #বাচরা গ্রামে – এই ব্রাহ্মণবংশের #পদ্মনাভ নামে এক সুসন্তান ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র ছিল – গোবিন্দরাম এবং মহেশ। গোবিন্দরামের একমাত্র পুত্র রাঘবরাম। বংশের এই ধারার আদি পুরুষ হিসাবে রাঘবরাম ভট্টাচার্যকেই ধরা হয়। রাঘবরাম তাঁর শিক্ষাগুরু দ্বিজদেব ভট্টাচার্যের গৃহে অধ্যয়ন করতে যান।  দ্বিজদেবের বাটী ছিল ময়মনসিংহ জেলার পন্ডিতবাড়ি গ্রামে। তিনি ছিলেন নিষ্ঠাব্রতী মাতৃসাধক। তাঁর গৃহে দেবী দুর্গা অধিষ্ঠিতা ছিলেন।  তাঁর নিত্যাসেবা ,পূজা ও ভোগ হতো। প্রতিদিন মহামায়াকে পূজা করে তাঁকে কন্যা রূপে প্রাপ্ত করবার জন্য প্রার্থনা জানতেন দ্বিজদেব। অতঃপর তাঁর মনোস্কামনা পূর্ণ হয়। তাঁর একটি কন্যা এবং একটি পুত্র সন্তান হয়। ভূমিষ্ঠ হবার পরে দেখা যায় সেই কন্যার গাত্র বর্ণ অদ্ভুত। সেই কন্যা না তো গৌরঙ্গী না তো শ্যামাঙ্গী।  সেইজন্য তাঁকে লোকসমাজ অর্ধকালী নামে ডাকতেন। তবে তাঁর পিতৃদত্ত নাম ছিল #জয়দুর্গা। 

এদিকে গুরুগৃহে রাঘবরামের অধ্যয়ন সম্পূর্ণ হলো। রাঘবরামের মধ্যে অসাধারণ পণ্ডিত্যের স্ফুরণ লক্ষ্য করে শিক্ষাগুরু দ্বিজদেব ছাত্রের গৌরবে গৌরাবান্বিত হলেন।  তিনি তাঁর এই সুযোগ্য ছাত্রের হাতে দেবীর করুণায় প্রাপ্ত কন্যা জয়দুর্গাকে সম্প্রদানে ইচ্ছুক হলেন।গুরুর ইচ্ছাকে গুরুর আদেশ মেনে বিয়েতে সম্মত হন রাঘবরাম। ধূমধাম করে বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। গোল বাঁধে বিবাহের পর…

আপন প্রিয় শিষ্য এবং জামাতাকে দ্বিজদেব ঘরজামাই কতে রাখার প্রস্তাব দেন। রাঘবরাম এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।  তিনি গুরু অর্থাৎ শ্বশুরমহাশয়কে বলেন – 

“অবলুপ্ত হবে ইথে মম বংশ পরিচয়।” 

এই কথা শুনে দ্বিজদেব অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন –

“আমার কন্যা অর্ধকালীর নামে হবে বংশ পরিচয়। “

এই কথা শুনে রাঘবরাম বলেন – 

” ইহা অভিশম্পাত নহে , আমার নিকট আশীর্বাদ বটে।” 

সেই থেকে  আলোচ্য ব্রাহ্মণ বংশের রাঘবরামের অধস্তন বংশ #অর্ধকালী_বংশ নামে বিখ্যাত। 

মেয়ে জামাই নৌকাযোগে যাত্রা করবেন। দ্বিজদেব নৌকা বোঝাই করে যৌতুক দিলেন। অধিক পরিমান যৌতুক দেখে রাঘবরাম অতীব অসন্তুষ্ট হলেন।তিনি তৎক্ষণাৎ সব যৌতুক নৌকা হতে নামিয়ে দিলেন। তারপর দ্বিজদেবকে গাঢ় স্বরে রাঘবরাম বললেন –

” যদি যৌতুক দিতেই হয় তবে আপনার উপাস্য দেবী দুর্গার মূর্তিটি আমাকে দিন। এছাড়া আমার আর কিছু কাম্য নয়। “

কিন্তু তা কি করে সম্ভব ? অষ্টধাতুর দেবী দ্বিজদেবের বংশের কুলদেবী। তিনিই গৃহলক্ষ্মী স্বরূপ। তাঁকে যৌতুক হিসাবে জামাতাকে প্রদান ? অসম্মত হলেন দ্বিজদেব। কিন্তু রাঘবরামও এক প্রতিজ্ঞায় অটল। যদি শ্বশুরমহাশয় জামাতা কন্যাকে যৌতুক দিতেই চান তবে দেবীকে দিন নচেৎ কিছুই চাই না । এদিকে যৌতুক ছাড়া সম্প্রদান সম্পূর্ন হয় না।  ফলে, বহু বিবেচনা করে তিনি জামাতাকে দেবীর বিগ্রহ দিয়ে দিলেন –

জামাতা যৌতুক যত করি পরিহার

শুধু সেই দশভুজা যাচে বারংবার,

অযৌতুক কন্যাদান একান্ত নিষ্ফল,

কুলের কল্যাণ আর গৃহের সম্বল- 

দেবতা দুহিতা দুই একহাতে দিয়া

শূন্যঘরে অবসন্ন চলিনু ফিরিয়া।

তবে পন্ডিত রাঘবরাম পুনরায় পিতৃগৃহে ফিরে গেলেন না। মনে মনে সংকল্প করলেন , রাত্রি অন্তিম প্রহরে নৌকা ছেড়েছেন। পরদিবসের সূর্য পাটে বসবেন যেস্থানেই, সেই স্থানেই তিনি বসবাস শুরু করবেন।

“যেইখানে দিবসান্তে ,           পৌঁছে যাব সেই প্রান্তে

                     ভিড়াইব তরী । “

ব্রহ্মময়ীর কৃপায় বা ইচ্ছায় দিবসান্তে তরী এসে ভিড়লো #চন্দ্রাবতী নদীর এক বিশাল চরে।  কার্তিক মাস , বাতাসে হিমেল পরশ, রাত হলে রূপশালী ধানের গায়ে হিম পড়ে ; কিন্তু  চরভূমি শুভ্র কাশবনে আকীর্ণ হয়ে আছে। সেখানে জরন শরৎদেবী গিয়েও যান নি , অথচ হেমন্তলক্ষ্মী তাঁর স্নিগ্ধতা নিয়ে বিরাজ করছেন। কাশফুলের মনোমুগ্ধকর শ্বেতশুভ্র সৌন্দর্য দেখে রাঘবরামের হৃদয় মাতোয়ারা হয়ে গেল। নৌকা থেকে নেমে চরের ভিতর প্রবেশ করে কিছুটা স্থান পরিষ্কার করে রাত্রি যাপনের মতো ব্যবস্থা হলো। নদীতে স্নান করে এসে নববধূ জয়দুর্গা মায়ের পূজার সকল যোগাড় করে দিলেন। সঙ্গে থাকা মুড়ি, মুড়কি, চিঁড়ে, নাড়ু , দৈ, ক্ষীর ভোগ দিয়ে রাঘবরাম শুদ্ধভাবে দেবী দুর্গার পূজা করলেন।

সন্ধ্যায় চতুর্দশী ছেড়ে পূর্ণিমা তিথি শুরু হলো। আকাশে সোনার থালার মতো গোল চাঁদ, জ্যোৎস্নায় বিশ্বচরাচর উদ্ভাসিত। দেবীর নিকট উৎসর্গকৃত ভোগ প্রসাদ গ্রহণ করে রাত্রি আহার সম্পন্ন হলো।

সেই অঞ্চলের অধিপতি ছিলেন রাজা দর্পনারায়ণ রায়। নির্জন নদী চরভূমিতে সন্ধ্যায় শঙ্খ ঘন্টার শব্দ, উলুধ্বনি শুনে কয়েকজন অনুচর সহ সেই স্থানে উপস্থিত হলেন। রাঘবরামের পান্ডিত্য, ব্যবহার এবং  ব্যক্তিত্বের পরিচয় পেয়ে তিনি খুব খুশি হলেন। সেই চরভূমি তিনি রাঘবরামকে বসবাসের নিমিত্ত দান করলেন। রাঘবরামের নিমিত্ত সেই চরভূমিতে ক্রমে জনবসতিও গড়ে তোলেন দর্পনারায়ণ। চন্দ্রাবতী নদীর এই সুবিশাল চরটি লোকমুখে #মাতরা_র_চর বলার পরিচিত ছিল।  রাঘবরাম এখানে বসবাস শুরু করলে নাম হয় #মিতরা। 

চন্দ্রাবতী বলয়িত বিশাল প্রান্তর

লোক রটনায় নাম মাতরার চর।

এই আখ্যা অহেতুক আকর্ষণে ভরা।

অবলুপ্ত করি নাম রাখহ মিতরা।।

খুব স্বল্প দিনের মধ্যেই  মিতরা চরভূমি লোকবসতি পূর্ণ একটি সুন্দর গ্রামে পরিণত হলো।

রাঘবরাম এবং জয়দুর্গার ( অর্ধকালী)চারটি পুত্র সন্তান হয় , যথা – রামদেব, রাজেন্দ্র, রামেশ্বর, রামভদ্র। 

রাঘবরাম সংবৎসর গৃহদেবীর ধাতব মূর্তির উপাসনা করলেও শারদীয়া দুর্গা পূজার সময় প্রতিষ্ঠিত দেবী ছাড়াও তিনি মৃন্ময়ী মূর্তি পূজা করতেন।  

একবার রাঘবরাম তাঁর চারপুত্রকে নিয়ে পূজায় বসেছেন।  প্রতিমা দক্ষিণমুখী। রাঘবরাম উত্তরমুখী হয়ে চন্ডী পাঠ ও পূজা করছিলেন।  পুত্রগণ পূবমুখী হয়ে বসেছেন। রাঘবরাম চন্ডীপাঠ করছিলেন। চণ্ডীপাঠের করার সময় এক স্থানে তাঁর উচ্চারণ ভুল হয়ে যায়। জ্যেষ্ঠ পুত্র রামদেব পিতার ত্রুটি ধরিয়ে দিলে , রাঘবরাম অতীব ক্ষুব্ধ হন। নিজে চণ্ডীপাঠ বন্ধ করে পুত্রকে চণ্ডী পাঠ করতে বলেন। 

পিতৃআজ্ঞা পালন করে জ্যেষ্ঠপুত্র রামদেব চণ্ডীপাঠে বসেন এবং বিশুদ্ধ উচ্চারণ করে সুললিত কণ্ঠে অতীব সুন্দরভাবে  চণ্ডীপাঠ করতে থাকেন। আজও লৌকিক কিংবদন্তি আছে যে , তাঁর উচ্চারণ এবং পাঠের ধরন এতই সঠিক ছিল যে , পরিতুষ্ট হয়ে দেবী দুর্গা দক্ষিণমুখী থেকে ঘুরে পশ্চিমমুখী হন আর কাঁচা হলুদ বর্ণা দেবী রক্তবর্ণা রূপ ধারণ করেন। অর্থাৎ , রামদেবের দিকে ঘুরে যান। 

উক্ত ঘটনার পর থেকে এই অর্ধকালী বংশের দুর্গাপূজায় চণ্ডীপাঠ বন্ধ হয়ে যায় এবং দেবী রক্তবর্ণা রূপে পূজিতা হন । দেবী ক্রমে লোকমুখে লাল দুর্গা নামে পরিচিত হন। 

রাঘবরাম হতে নবম পুরুষ শিবনাথের গঙ্গাবাসের ইচ্ছা প্রবল হয়। তিনি সপরিবারে কাশিবাসী হন । পরবর্তীকালে তাঁর পুত্রগণ – কেদারনাথ , উপেন্দ্রনাথ, যোগেন্দ্রনাথ, সুরেন্দ্রনাথ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে কাশী হতে প্রাচীন বিদ্যাপীঠ নবদ্বীপে এসে বাস শুরু করেন। সেখানেও শারদীয়া দুর্গাপূজায় লালদুর্গার পূজা করেন। নবদ্বীপে ভট্টাচার্যদের বাটীটি #লালদুর্গা_বাড়ি নামে খ্যাত। লালদুর্গা উপাসনা প্রায় তিনশতাধিক বৎসরের অধিক অবশ্যই, তবে নবদ্বীপে এর বয়স প্রায় ১০০ বৎসর।

দেবীর রক্তাভ , কিন্তু দুর্গার  ধ্যানেই তাঁর পূজা হয়। পূজার প্রতিদিন চালকুমড়াদি বলি হয়। এই পরিবারের দীক্ষিত অভিজ্ঞ বয়স্ক এবং সক্ষম ব্যক্তিরাই পূজায় ব্রতী হন । পূজায় প্রাপ্ত দক্ষিণা , প্রণামী, বস্ত্রাদি গুরুদেবকে দান করা হয়। পরিবারের সদস্যদের দেওয়া অর্থেই প্রতিবছর লালদুর্গা পূজার ব্যয় নির্বাহ হয়। 

প্রতিমার উচ্চতা বরাবর চালা সমেত হয় তিন /  সাড়ে তিন হাত । প্রথমে নবদ্বীপের মহেন্দ্র পাল এবং তার পুত্র খোকা পাল ও বলাই পাল এবং বর্তমানে মহেন্দ্র পালের পৌত্র নানু পাল প্রতিমা তৈরি করেন। দেবী ঘোর রক্ত বর্ণা। লক্ষ্মী, সরস্বতী ,কার্তিক , গণেশ প্রত্যেকে একই চালায় স্ব স্ববর্ণে বিরাজমান থাকেন।

লালদুর্গা পূজার একটি বিশেষত্ব আছে , যা সাধারণত অন্যকোনো দুর্গা পূজায় দেখা যায় না। এই পূজায় মহানবমীর দিন মা কে থোর দিয়ে বোয়াল মাছ রান্না করে ভোগ দেওয়া হয় ।  কেন ? সেখানেও আছে একটি কিংবদন্তি । কি সেই কিংবদন্তি ?

সেই যে চন্দ্রাবতী নদীর তীরস্থ রাজা  দর্পনারায়ণ তাঁর ছিল প্রবল প্রতাপ। তিনি দিল্লি নবাবের প্রধান কানুনগো ছিলেন। তাঁর কাজের জন্য তাঁকে কখনোও মালদহ ,কখনো বা ঢাকায় থাকতে হতো। পূর্বেই বলেছি তিনি রাঘবরামের চন্দ্রাবতী নদীর চড়ে থাকার যাবতীয় ব্যবস্থা তিনি করে দেন। ওইসময় তিনি ঢাকায় ছিলেন। তাছাড়াও বয়সকালেও তিনি রাঘবরামের পন্ডিত জ্যেষ্ঠ পুত্র রামদেবের গুণমুগ্ধ ও অনুরাগী ছিলেন।  তিনি রামদেবের নিকট দীক্ষাগ্রহনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু রামদেব পিতার অনুমতি চাইলে , পিতা রাঘবরাম আপত্তি করেন। 

ইতিমধ্যে একটি মহৎ সভায় রামদেবের  কুলমর্যাদা নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলে তাকে অপমান করা হয় ।রামদেবের কুলমর্যাদা ছিল – 

” সর্বদ্বারী সিদ্ধ শ্রোত্রিয়”।

এই মর্যাদাকে সেই সময় কৌলিন্যের সর্বোচ্চ মর্যাদা থেকে নিম্নতর বলে গণ্য করা হতো । দর্পনারায়ণ ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন ।তিনি রামদেবকে অপমানিত হতে দেখে অত্যন্ত ব্যথিত হন । এই সভাতেই রামদেবের সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান করার প্রতিশ্রুতি দেন । সেই সঙ্গে তিনি ওই সভাতেই রামদেবের নিকট হতে দীক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাতে রামদেব সম্মত হন।  রামদেবের সর্বোচ্চ সামাজিক মর্যাদা এবং দর্পনারায়ণকে দীক্ষা দানের ঘটনা বাড়িতে এসে জানালেন। রাঘবরাম সব শুনে মনে মনে খুব ব্যথিত হন । কারণ দীর্ঘদিন এক ব্রাহ্মণ দীক্ষা গ্রহণের জন্য রাঘবরামের নিকট যাতায়াত করছিলেন। কিন্তু কেবলমাত্রই অনৈতিক ভাবে বংশ পরম্পরায় কোনোদিনই তিনি বংশ পরম্পরায় গুরু গিরি করতে চান নি। তাছাড়া রাঘবরাম সদাই আধ্যাত্ম সাধনায় তন্ময় থাকতেন। তাই তিনি নিজে দীক্ষা দিতে রাজি হন নি। এদিকে দীক্ষা গ্রহণ করতে না পারায় সেই ব্রাহ্মণের প্রচন্ড রাগ হয় এবং রাঘবরামকে অভিশম্পাত দেন। 

পিতাকে অখুশি দেখে রামদেব প্রতিকারের পথ নির্দেশের জন্য পরামর্শ প্রার্থনা করেন । পিতা বললেন – ” মাতৃদর্শনের  জন্য কঠোর সাধনা করো। ” 

তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রামদেবকে কামাখ্যা গিয়ে ভৈরবী মন্দিরে বর্ষপুরশ্চরণ করতে বলেন । তিনি আরো বলেন এক বৎসর পুরশ্চরণ করে সিদ্ধ না হলে “কৌল সংখ্যা চতুর্গুণাঃ” এই নিয়মে চার বৎসর পুরশ্চরণ করে মাতৃদর্শন করতে হবে। পিতার নির্দেশ শিরোধার্য করে রামদেব কামাখ্যাধামে ভৈরবী মন্দিরে বর্ষপুরশ্চরণ করতে ব্রতী হন।

পুরশ্চরণ অনুষ্ঠান অত্যন্ত ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান। এক বৎসর ধরে পুরশ্চরণ অনুষ্ঠা কোনো বিত্তবান ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতা ব্যতীত সম্ভব নয়। কারণ নিয়ম অনুযায়ী এক বৎসর ব্যাপী প্রতিদিন – ষোড়শোপচারে ইষ্ট দেবীর পূজা , হোম ,জপ, তর্পণ , অভিষেক , কুমারী পূজা, ব্রাহ্মণ  ভোজন ইত্যাদি করতে হয় । রাজা দর্পনারায়ণ রামদেবের পুরশ্চরণের  সমস্ত ব্যয়ভার নিজে হাতে গ্রহণ করলেন । 

এক বছর সম্পূর্ণ হলো কিন্তু মাতৃদর্শন হলো না। এইভাবে চতুর্থ বর্ষ শেষ হতে চলল তবুও মাতৃদর্শন হল না। পুরশ্চরণের চতুর্থ বর্ষের মহানবমীর দিন তাঁর মন বিষন্ন হয়ে উঠলো । তাঁর  গ্রামের বাড়িতে কত ধুমধাম করে মাতৃ আরাধনা চলছে।  তিনি দূর-বিভুঁইয়ে পড়ে আছেন।  চার বৎসর অতিক্রান্ত হতে চলল। অথচ , মাতৃ দর্শন হলো না। মাতৃদর্শনের নিমিত্ত তাঁর হৃদয়  ব্যাকুল হয়ে উঠলো। 

পুরশ্চরণ প্রতিদিনের মতো সমাধা করে ভৈরবী মন্দির সংলগ্ন পুকুরের বাঁধানো সিঁড়িতে বসে তিনি এইসব ভাবছিলেন । সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে। এমন সময় তমিস্রা বিদীর্ণ করে আলোয় আলোকময় হয়ে উঠলো । সেই জ্যোতির মধ্যে থেকে দিব্যজ্যোতির্ময়ী জগৎ জননী মা দূর্গা লাল পাড় শাড়ি পরিহিতা বালিকা রূপে দেখা দিলেন। দেখা দিয়ে অনুশোচনা করতে নিষেধ করে বললেন  – ” আমি এইমাত্র তোর বাড়ি থেকেথোর বোয়াল মাছের ভোগ খেয়ে এলাম। থোর দিয়ে রান্না করা বোয়াল মাছের ওই ভোগ আমি খুব তৃপ্তি করে খেয়েছি । তুই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে সেই প্রসাদ গ্রহণ কর । গিয়ে দেখবি এখন আমার মূর্তির মুখে থোর বোয়াল মাছের অংশ লেগে আছে। ” 

আকস্মিকভাবে মাতৃদর্শনে রামদেব বিহ্বল ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন । তিনি মাকে তাঁর ক্ষেত্র ক্ষেত্রসন্ন্যাস ব্রতের কথা বললেন । তখনও পুরশ্চরণের চার 

বৎসর পূর্ণ হতে দিন কয়েক বাকি আছে । এমতাবস্থায় স্থান ত্যাগ করা যাবে না। তাছাড়া কামাক্ষ্যাধাম থেকে মিতরা গ্রামে যেতে বেশ কয়েক দিনের পথ , অসম্ভব ব্যাপার…. তখন মা তাঁকে বললেন , “তোকে কোথাও যেতে হবে না। এই পুকুরে ডুব দিয়ে তোর বাড়ির পুকুরে গিয়ে উঠবি । প্রসাদ গ্রহণ করে বাড়ীর পুকুরে ডুব দিলেই এই পুকুরে এসে উঠবি।”

 রামদেব আদ্যাশক্তির আদেশ পালন করলেন। মিতরা পুকুরের ঘাটে উপস্থিত হতেই বাড়ির  আত্মীয়-স্বজনরা ” ঠাকুর কর্তা আসছেন ” বলে তাঁকে ঘিরে ধরলেন । কারো কথায় কর্ণপাত না করে রামদেব সোজা মন্দিরে গিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিগ্রহ দর্শন করতে লাগলেন আর দেখলেন মায়ের মুখে থোর বোয়াল মাছের অংশ লেগে রয়েছে । রামদেবের আনন্দের আতিশয্যে আপ্লুত মায়ের গৃহীত প্রসাদ অন্ন , থোর বোয়াল মাছ গ্রহণ করলেন ।তারপর মন্দিরে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে দেবীকে প্রণাম করে পরিবার-পরিজনদের স্বল্পভাষনে পরিতৃপ্ত করে মিতরা পুকুর ঘাটে ডুব দিয়ে কামাখ্যাধামের ভৈরবী মন্দিরের পুকুরে উঠলেন।  অবশিষ্ট কয়েকদিন নিবিষ্ট মনে পুরশ্চরণ ব্রত সমাধা করে বাড়ি ফিরে এলেন।

 সেই থেকে প্রতিবছর নবমীরদিন মা দুর্গাকে থোর বোয়াল মাছের ভোগ দেওয়া হয় । এই পরিবারের লোকজন শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নেই, ভারতের বিভিন্ন স্থানে এমন কি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সর্বত্রই তাঁরা লাল দুর্গাপূজা করেন এবং থোর বোয়াল মাছের ঝোল ভোগ দেন। 

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ১. নবদ্বীপের লাল দুর্গা

২. শ্ৰী শ্ৰী চণ্ডী

৩. বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.