“What is Mathematics? It is only a systematic effort of solving puzzles posed by nature.”
— শকুন্তলাদেবী
অঙ্ক। নাম শুনলে হৃদকম্প হয় না, এমন মানুষের সংখ্যা বোধহয় খুব বেশি নয়। “তেল মাখা বাঁশে, উল্লাসে, উঠেছে মাঙ্কি/ সে ব্যাটা চড়ছে ১৩ মিমি, তো পড়ছে ১৪ কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?” এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয় প্রায় সব ছাত্রছাত্রীদেরকেই। চক্রবৃদ্ধি সুদের নাগাল পাওয়া কিংবা স্টেশনে ট্রেনেদের মোলাকাত দেখে তাদের দৈর্ঘ্য বলে দেওয়ার চেষ্টায় কেটে যায় ছুটির দুপুরগুলো। কিন্তু অঙ্ক ছাড়া তো জীবন চলে না। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি তো বটেই, দৈনন্দিন ব্যবহারিক জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অঙ্কের হিসাবনিকাশ। শোনা যায়, বেশ কিছু আফ্রিকান অধিবাসী নাকি তিনের বেশি গুণতে জানেন না। আমাদের সঙ্গেও তেমনটা হলে কী হতো, সহজেই অনুমেয়। তাছাড়া, অঙ্কের নান্দনিক দিকের প্রভাবও বিশাল। স্থাপত্য, ভাস্কর্য, ছবি আঁকা আর চিত্রকলার যে নিঁখুত মাপজোক, তার আড়ালেও সেই অঙ্ক। আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পেরিয়ে বাঙালির কাছে সেই অঙ্কেরই সমার্থক হলেন কেশবচন্দ্র নাগ ওরফে কেসি নাগ (KC Nag)। যাঁর অঙ্কের বইগুলো দশকের পর দশক, বাঙালিকে অঙ্কের প্রাথমিক পাঠ দিয়ে চলেছে। আজ তাঁর ১৩০তম জন্মদিবস।
প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক গ্যালিলিও গ্যালিলেই বলেছিলেন, “Mathematics is the language, in which God has written the Universe.” সত্যিই তো তাই! হাজার কোটি বছর ধরে মহাকাশে নিঁখুত রাস্তায়, পরস্পরের গা বাঁচিয়ে, ছুটে চলেছে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র, তার মূলে কী নিঁখুত অঙ্ক! প্রকৃতির বড়ো প্রিয় ফিবোনাচ্চি সিরিজ (Fibonacci Series) আর গোল্ডেন রেশিও (Golden Ratio)। তাই তার ছায়া দেখা যায় ফুলের পাপড়িতে, গাছের ডালের বিন্যাসে, সাইক্লোনের গড়নে, গ্যালাক্সি, এমনকি আমাদের কানের গড়নেও! ভাবলে অবাক হতে হয়, এই গভীর, বিস্তৃত বিষয়ের মূল এবং প্রাথমিক দিকগুলিকে কী সহজে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউশনের প্রাক্তন শিক্ষক প্রয়াত কেশবচন্দ্র নাগ। নাহলে কি এমন সব অঙ্কের বই লেখা সম্ভব হতো? বাংলা ভাষায় অঙ্কচর্চা সম্ভব নয় বলে যাঁরা মনে করেন, অন্তত স্কুলস্তরের অঙ্কের ক্ষেত্রে তাঁদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে আসছে কেসি নাগের অঙ্ক বইগুলো।
তাঁর ক্লাস যাঁরা করেছেন, তাঁরা বলেন, অঙ্কের ধারণা এবং সিদ্ধান্তগুলি বোঝাতে কেসি নাগের জুড়ি ছিল না। অঙ্ক কষতে দিয়ে ছাত্রদের ডাকতেন বোর্ডে সেই অঙ্ক সমাধান করতে। কোথাও ভুল হলে পুরো অঙ্ক নতুন করে না কষে শুধু সেই জায়গাটা শুধরে দিতেন। একই রকমের অনেকগুলো অঙ্ক কষতে দিতেন, যাতে সেই বিষয়ের মূল সূত্রগুলো ছাত্রদের মনে গেঁথে যায়। কাগজ কেটে বিভিন্ন জ্যামিতিক বস্তুর আকার দিয়ে ছাত্রদের হাতেকলমে দিতেন জ্যামিতির প্রাথমিক পাঠ। আজকের অনলাইন টিউটোরিয়াল যুগের বহু আগেই তিনি ছাত্রদের হাতেকলমে অঙ্ক শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু অঙ্কে ভুল করলে? ছাত্রদের মারধর নৈব নৈব চঃ। তবে মাঝে মাঝেই অঙ্কে কমজোরি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ‘গাধা’ কথাটি নাকি ছিল তাঁর অতিপ্রসিদ্ধ সম্বোধন। শোনা যায়, একবার এক অঙ্ক-অবুঝ ছাত্রের অভিভাবককে মজার ছলে বলেছিলেন, “ওকে কালীপুজোর দিন বাইরে বেরোতে দেবেন না, লোকে ধরে বলি দিয়ে দিতে পারে।” তাঁর সরসতার আভাস মেলে আর একটা ঘটনায়। একবার ক্লাসে এসে বোর্ডে বৃত্ত এঁকে কেন্দ্র O বিন্দু থেকে বৃত্তের উপর X বিন্দু পর্যন্ত লম্বা সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করছেন, এটাকে কী বলে। ছাত্রদের মুখে উত্তর হিসাবে ‘ব্যাসার্ধ’ শুনে বললেন, O থেকে X জুড়লে হয় OX, মানে ষাঁড়। সহজ অঙ্ক থেকে কঠিন অঙ্কের দিকে যেতেন, ক্লাসে পড়ানোর সময়। সেই ধারা লক্ষ্য করা যায় তাঁর লেখা বইতেও। যাতে অঙ্কের সূত্রগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। প্রথমে ভয় লাগলেও তার সুফল মেলে পরীক্ষার দিন। ওঁর ছাত্রতালিকায় ছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
তবে শুধু গণিত বিশারদই নন, খেলাধূলায় ছিল প্রবল উৎসাহ। কট্টর মোহনবাগান সমর্থক কেসি নাগ নাকি উপোস রাখতেন, মোহনবাগান হারলে রাতে খেতেন না। ছিলেন শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগান ক্লাবের আজীবন সদস্য। ক্রিকেটেও ছিল অদম্য আগ্রহ। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সারদাদেবীর একনিষ্ঠ ভক্ত। স্বয়ং সারদাদেবীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। অনুবাদ করেছিলেন ভগিনী নিবেদিতার শিব ও বুদ্ধ গ্রন্থটি। জানা যায়, ডায়েরি লেখার অভ্যেস ছিল। সে ডায়েরিতে নাকি আছে স্বরচিত কবিতাও। গান্ধীজীর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এ যোগ দিয়েছিলেন। আবার ছিলেন উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন জুটির একনিষ্ঠ ভক্ত। জন্মস্থান হুগলির গুড়াপে তৈরি করে দিয়েছিলেন স্কুল, লাইব্রেরি, রাস্তা।
এত বছর পেরিয়েও তাঁর অঙ্কের বইয়ের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি। বাংলাতে জনপ্রিয় তো বটেই, বিদেশেও রপ্তানি হয় তাঁর বই। দেশে-বিদেশে থাকা বাঙালিরা তাঁদের পরের প্রজন্মকে অঙ্কের প্রাথমিক পাঠ শেখাতে ভরসা রাখেন কেসি নাগের অঙ্ক বইয়ের উপরে। শোনা যায়, কলকাতায় মেসে থাকার সময়ে যে দোকানে খেতেন, তার মালিক অঙ্কে কাঁচা ছিলেন বলে অনেকেই তাঁকে ঠকাতো। সেই মানুষটিকে হিসাব শিখিয়ে তাঁকে ঠকার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন কেশবচন্দ্র নাগ। এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম, বাঙালিকে ‘জীবনের অঙ্ক’ শিখিয়ে চলেছেন বাঙালির চিরকালীন অঙ্কের শিক্ষক কেসি নাগ।