গায়ে খাঁকি পোশাক, নানান রঙের তালি-তাপ্পি দেওয়া জামা, মাথায় লাল পাগড়ি, কপালে বড়ো একটি সিঁদুরের টিপ, এক হাতে বালা ও মরচে ধরা হাতলবিহীন ছুরি, অন্য হাতে লাঠি, গলায় রঙ-বেরঙের পুঁতির মালা—এই হলো পুরুষের বেশ। আর মেয়েদের হাতে কাঁচের চুড়ি, কাঁধে হরেক কিসিমের তালি মারা থলি এবং পিঠে কাপড়ের থলিতে বাচ্চা রাখা। হাতের বালা আর চুড়ির টুং টাং শব্দ আর তার সঙ্গে মাতৃভাষায় রামগান।

১০/১২ জনের দল বেঁধে ভিক্ষায় বেরিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘোরাঘুরি। তারপর রাতের বেলায় কোনো বটগাছের তলায়, নয়তো পুকুর পাড়ে, কিংবা কোনো পোড়ো বাড়ি বা ভাঙা মন্দিরে আশ্রয়। একটি জায়গায় ১০/১৫ দিন বসবাস। তারপর অস্থায়ী বাস তুলে ফের পথ চলা অন্য জায়গার উদ্দেশ্যে।

প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় খোলা আকাশের নিচে বসবাসের সময় আফিং সেবন। সকালে ভিক্ষায় বেরিয়ে সন্ধ্যায় অস্থায়ী ডেরায় ফেরা। মোটামুটি এই ছিল জীবন যাপনের দিনলিপি। কারা ওরা? ওরা “কাকমারা।”

একসময় কাক উপদ্রুত অঞ্চলে কাক মেরে কাকের উপদ্রব দূর করা ছিল তাদের উপজীবিকা। সেজন্য তাদের নাম “কাকমারা।”

এখন পরিবেশ দূষণের কারণে কাকের সংখ্যাও যেমন কমে গেলে উল্লেখযোগ্যভাবে, তেমনি হারিয়ে গেছেন কাকমারার দল।

জানা যায়, তাঁরা আদতে দক্ষিণ ভারতের দ্রাবিড় সম্প্রদায়ের মানুষ। পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কাকদ্বীপে কাকমারাদের বসবাস।

এক সময় কাকমারাদের দল গান গেয়ে ভিক্ষা করতেন, তাদের গাইতেন:

“ওউম নুল সিনি তুলছি মানু মাড়ানা শ‍্যাম

রামা যেই যেই রামা

বুঁডএলি নাই ভূলোক দান‍্যম্

রামা যেই যেই রামা

বল্ বলো তাপ্পারা

কুলি কুড়ি কাসা

ইঙ্কা নানগা লেগ বইয়োয়

নামুন্দু কৃষ্ণা

ইঙ্কা নানলো লেগ বাইয়োয়।”

কাকমারাদের ভাষা তেলেগু। কেউ কেউ এদের তামিলনাড়ুর অধিবাসী বলে থাকেন। তবে কাকমারারা নিজেদের অন্ধ্রপ্রদেশের অধিবাসী বলে পরিচয় দেন।

গবেষকদের মতে, মুসলমান আমলে যে সব মাদ্রাজী সৈন্য বাংলায় নিযুক্ত ছিলেন, এঁরা তাঁদের বংশধর। ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বের প্রথম দিকে এঁরা তাঁদের সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত ছিলেন। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে নবাব জাফর খাঁ-র সময় প্রায় তিনশো তেলিঙ্গা সৈন্য নবাবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যোগ দেন বীরভূমের রাজার সেনাবাহিনীতে। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলে তাঁরা রাজা-জমিদারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত হোন এবং এরপর অনেকেই ফিরে যান তেলেঙ্গানায়। আর কিছুজন বাংলায় থেকে যান। আর তাঁদের উত্তর পুরুষরাই বাংলার কাকমারা।

চালচুলোহীন অনিশ্চিত জীবন। আর ছিল ভাষার সমস্যা। তারপর একসময় শূকর পালন করতে শুরু করেন। কিন্তু ভিক্ষার জন্য গ্রামে গ্রামে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে সে পেশা ঠিকমতো টেকেনি। শেষে শ্মশানের আধপোড়া কাঠ দিয়ে রান্না করতে করতে একসময় তাঁদের মন হয়ে যায় সংস্কার মুক্ত। তবে এজন্য সমাজের কাছে তাঁরা অচ্ছ‍্যুৎ হয়ে গেলেন।

এরপর তাঁরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাকের হাড়ের টুকরো, তাবিজ, কবচ, মাদুলি, তামার পয়সা ইত্যাদি বেচতেন। কাক, নেউল, ভোঁদড়, ইঁদুর, কাঠবিড়ালি শিকার করে খেতেন। কাক মারতে মারতে তাঁদের নাম হয়ে গেল “কাকমারা।”

তবে এ বিষয়ে অন্য একটি কথাও চালু আছে। তা হলো, বিচিত্র বিদঘুটে পোশাক পরা অপরিচিত ১০/১২ জনের দলকে গ্রামে দেখে শিশুরা ভয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে যেতো আর তাঁদের সম্পর্কে জানতে চাইতো। তখন তাদের মা-বাবারা বলতেন, এরা সব দোখনা (দক্ষিণ) দেশের লোক। পাখি-টাখি, কাক-টাক মেরে খায়। তখন থেকেই লোকমুখে তাঁরা হয়ে গেলেন “কাকমারা।”

এক অদ্ভূত উপায়ে তাঁরা কাক ধরতেন। মাটিতে বিছানো থাকে একটি জাল। জালের এক প্রান্ত একটি খুঁটির সঙ্গে বাঁধা থাকে এবং অন্য প্রান্ত থাকে শিকারির হাতে। জালের একটা দিক তুলে তার নিচে ছড়িয়ে দেয় ভিজে চাল। কাক চাল খেতে গেলেই শিকারি দড়ি ধরে মারেন টান। তাতেই জালে আটকে যায় কাক।

১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের জনগণনায় কাকমারারা নিজেদের মাদ্রাজী বলে নথিভুক্ত করিয়েছেন। এখন তাঁরা আর নিজেদের “কাকমারা” বলেন না, তপশীলি উপজাতি বলে পরিচয় দেন।

কাকমারাদের দুটি গোষ্ঠী, একটি—রাম সিং ও অন্যটি নারায়ণ দাস। রাম সিং ও নারায়ণ দাস—এঁরা দু’জন ধর্মগুরু। এই দুই গোষ্ঠীর লোকজন যথাক্রমে সিং ও দাস বা সর্দার পদবি ব‍্যবহার করেন, যা অন্ধ্রপ্রদেশের পদবি নয়, এসব বাংলার প্রচলিত পদবি। তাই বলা যায়, এসব পদবির ব‍্যবহার বঙ্গ সংস্কৃতির সংস্পর্শের ফলশ্রুতি।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, কাকমারারা ক্রমশ বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছেন। আর তামিল ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে। যেমন, ভাকু (বোকা), মাল (উঁচু জায়গা), পালো (ভাত), পিলে (ছেলে), কাবুয়া (উঁচু ঢিবি), পাঁড়ুয়া (অলস), ল‍্যাদামারা (অলস)—এসব শব্দগুলি একসময় ছিল কাকমারাদের কথ‍্য ভাষা এবং বর্তমানে এগুলি বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে।

এঁদের মধ্যে এখন অসবর্ণ বিয়ে প্রচলিত আছে। ব্রাহ্মণ, জেলে, বৈষ্ণব প্রভৃতি জাতির সঙ্গে এঁদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। এর ফলে এঁরা আরও নিবিড়ভাবে বাংলা সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছেন।

এঁরা এখন আর ভিক্ষুক নন। কৃষি, ব‍্যবস্থা, শিক্ষকতার পেশাতেও এঁরা এখন যুক্ত। এভাবেই শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে তাঁদের প্রতিষ্ঠার জগতে উত্তরণ ঘটেছে।

তথ‍্যসূত্র:

১) ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বাংলার ব্রাহ্মণ: অমিয় কুমার চট্টোপাধ্যায়।

২) বাঙালি জাতি পরিচয়: শৌরীন্দ্র কুমার ঘোষ।

৩) রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ড: মানিকলাল সিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.