( লেখাটা বেশ বড়ো। একটু ধৈর্য্য সহকারে পড়ে দেখো। অনেক দিন বিরক্ত করিনি, তাই না?)
আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমন ছিলো বৈশাখী ঝড়ের মতো। সেই আক্রমন ভারতীয় জনজীবনে বা সামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনে কোন সুদুর প্রসারী প্রভাব ফেলেনি। সনাতনি হিন্দু সমাজ সামান্য কিছু সময়ের মধ্যেই সেই অভিঘাত থেকে দাঁড়িয়ে উঠে পুনরায় নিজ ছন্দে ফিরে গিয়েছিলো। পরবর্তী হিন্দু রাজারা (মৌর্য এবং গুপ্ত সম্রাটেরা) সমস্ত ভারতকে , ভারতীয় জনজীবনকে, সনাতনী বৈদিক সমাজ কে এক সুত্রে মালার মতো গেথে রেখেছিলেন। সেই বৈদিক সমাজ, কোনো রকম কলুষতার দ্বারা প্রভাবিত, পরিবর্তিত বা বিষাক্ত হয়ে ওঠেনি। বৈদিক জীবন এবং সমাজ ছিলো স্বয়ং সম্পুর্ন। জ্ঞান বিজ্ঞান, ধর্মীয় জীবন, চিকিৎষা-স্বাস্থ্য, শিক্ষা, রাজনৈতিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, এর কোনো কিছুর জন্য সনাতনি হিন্দুকে পরমুখাপেক্ষী হতে হয় নি বা বাইরের কোনো সমাজ বা সংষ্কৃতি থেকে ধার করতে হয়নি। সনাতনি বৈদিক সমাজ বিদেশী দের শিখিয়েছে, দিয়েছে; নেয়নি কিছু। কারন বিদেশীদের থেকে নেবার বা শেখার কিছুই ছিলো না। ‘সনাতনী / বৈদিক সভ্যতার রেনেশাঁস এইভাবে চলেছিলো প্রায় এক হাজার বছর। ৩২৭ খ্রীষ্ট পুর্বাব্দ (আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমন) থেকে ৭১২ খ্রীষ্টাব্দ ( মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়, ‘রাজা দাহির’অবধি ) ভারতীয় হিন্দুদের জ্ঞান বিজ্ঞানের জয় জয় কার। আর্য ভট্ট, বারাহ মিহির, চরক – শশ্রুত, কৌটিল্য, বাৎসায়ন—কতো নাম লিখবো????
সনাতনি সমাজে সর্ব প্রথম ‘কাল মেঘের’ ঘনঘটা শুরু হলো ৭১২ সালে। শুরু হলো “অসভ্য, দস্যু শক্তি, ‘আরবী বর্বরতা”র তান্ডবী ঝড়ের শুরু, ঘুর্নি ঝড়, সেই সংগে অবিরাম দাপুটে বর্ষাপাত। অমানবিক, অমানুষিক, ‘ধর্মের খোলষে মোড়া’ এক ঔপনিবেশিক বিষধর কাল সাপ, আরবের রুক্ষ মরুভুমির বেদুইন দস্যু দের উন্মত্ত রিরংসা, ভারতীয় জন জীবনে ছিলো অভাবিতপুর্ব, অজানিত এবং কল্পনাতীত। অশালীন, মানুষের আদিম প্রবৃত্তির প্রতিভু, রক্তপিপাসু মনোবৃত্তি দিয়ে তৈরী, সেই বর্বর শক্তি বিষ ছড়াতে ছড়াতে, সাধারন মানুষের গলার নলী কাটা রক্তে হাত রাঙ্গিয়ে, একে একে ধংস করলো প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (ইরাক), ইরান। শেষে এসে উপস্থিত হলো আর এক প্রাচীন সভ্যতা এবং সংষ্কৃতির পীঠস্থান, সনাতনি হিন্দু জাতির মাতৃভুমি ভারতবর্ষের দোড় গোড়ায়, আফগানিস্তানে। সেই কালসাপের ঝরানো বিষের প্লাবনে ধুয়ে মুছে প্রায় সাফ হয়ে গেলো, সারা মধ্য এশিয়ার প্রাচীন জন জাতিগোষ্টির জীবন যাত্রা, নিজস্ব বাস্তু ভিটে, নিজস্ব ধর্ম এবং সংষ্কৃতি। সেই বিষাক্ত প্লাবনের ঢেউ আছড়ে পড়লো ভারতবর্ষে, সমস্ত ভারতীয় জন জীবন, ভারতীয় কৃষ্টি, সংষ্কৃতি ধ্বংস হতে শুরু হলো । তৈরী হতে শুরু হলো এক উন্নত সভ্যতাকে নিম্ন মুখী করে ধীরে ধীরে গ্রাস করার প্রক্রিয়া, যা আজো চলছে।।
সাধারন বন্যার জল সরে যায়, পড়ে থাকে পলিমাটি। সেই পলিমাটিতে শষ্য ভালো হয়, পুনরায় জেগে ওঠে সমাজ জীবন। কিন্তু সুনামীর জলে ভেসে আসে সমুদ্রের তলায় পড়ে থাকে পচা গলা কাদা মাটি। সেই মাটিতে কোনো ফসল হয় না। গাছ পালা মরে যায়। (দেখে আসুন আন্দামানে, নারকেল গাছে থেকে শুরু করে সমস্ত জমি চাষ বাসের অযোগ্য হয়ে আছে সেই ২০০৪ সাল থেকে)। সেই থেকে শুরু ‘সনাতনী বৈদিক সভ্যতার ধীর গতির মৃত্যু।
৭১২ সাল থেকে আজ অবধি, ভারতীয় জন জীবনে যে ধারাবহিক সুনামী চলছে সেই সুনামীতে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে সনাতনী শিক্ষা, ধর্ম, সমাজ ব্যাবস্থা। সেই কাহিনী বড়ো করুন। হিন্দুরা সেই কাহিনী শুনতে চায় না,জানতেও চায় না। তার কারন আর কিছুই নয়, দুঃখ কষ্ট, বেদনার কথা মানুষ ভুলে যেতে চায়। মনে পড়লে কষ্ট আরো বাড়ে। তাই না জানা এবং জানলেও ভুলে যাওয়া ভালো।
পিতৃপুরুষের বিচরন ভুমি, জ্ঞানদীপ্ত মুনি ঋষীদের সাধনস্থল, তাদের গুরুকুল, বিদ্যার ভান্ডার, পুথি পুস্তক, আশ্রম সব ভেংগে গুড়িয়ে, পুড়িয়ে ছারখার করে দিলো সেই অসভ্য শয়তানের দল বল। আর সেই “তান্ডব” যার কেতাবী নাম ‘জিহাদ’, লালষা পুর্ন, তামসিক মস্তিষ্ক প্রসুত, ‘পরাস্ব অপহরনের’ ধর্মীয় কৌশল, ভারতীয় জন জীবনে ছিলো সম্পুর্ন অজ্ঞাত, অভাবনীয়, অদৃষ্টপুর্ব। জ্ঞানী তপস্বীরাও কোনোদিন তাদের কাল্পনিক শক্তি দিয়েও এই শয়তানি শক্তিকে পরিমাপ করতে পারেননি। হতচকিত, হতভম্ব, শারীরিক এবং মানসিক আঘাতে দিশাহারা হয়ে পড়লো ভারতীয় হিন্দু সমাজ। সমাজ নেতারাও (জ্ঞানী ব্রাহ্মনেরা), রাজারা (ক্ষাত্র শক্তি) এমনকি ব্যবসায়ী সমাজ (বৈশ্য) তখন কিং কর্তব্যবিমুঢ়। শ্রী রামচন্দ্রের যুগে ‘দানবী তাড়কা’ র তান্ডব বন্ধ করতে শ্রী রাম চন্দ্র এবং ভাই লক্ষন ছিলেন। এই সময় আর কেউ রইলেন না।
তাই ধীরে ধীরে তৈরী হলো এক পলায়নী মনোভাব। “য পলায়তি স জীবতি” এই মন্ত্র ছড়িয়ে পড়লো দিক বিদিকে। ‘জিহাদী’ বিষের হাত থেকে সমাজ সংসার বাচাতে হিন্দু সমাজ হয়ে পড়লো বিভ্রান্ত। ক্ষুধার জ্বালায় মা যেমন তার সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করে, তেমনি পরিবারের,সমাজের অসহায় নারী দের রক্ষায় অসমর্থ হয়ে, তাদের বিষ পান করে মৃত্যু বরন করার পরামর্শ দিতে থাকলো। স্বামী মরে গেলে স্ত্রীকে একই চিতায় জ্বালানো শুরু হলো (সতীদাহ), জন্মানোর পর পরই কন্যা সন্তানের বিবাহ দিতে থাকলো (বাল্য বিবাহ)। সমাজে ঢুকে গেলো কুসংষ্কার। সেই কুসংষ্কার থেকে আজো হিন্দুরা পুর্ন ভাবে বেরিয়ে আসতে পারলো না।
হিন্দু সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং বুদ্ধিমত্তায় দুর্বল শ্রেনী, যারা কোন না কোন ভাবে শিক্ষা, রক্ষা এবং অর্থ উপার্জনের জন্য ব্যাবসায়ী শ্রেনীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতো এবং সাহায্য চাইতো, সেই শুদ্র শ্রেনী হয়ে পড়লো অবিভাবক হীন। ব্রাহ্মন শ্রেনী প্রান ভয়ে পলাতক, ক্ষত্রীয় শ্রেনী যুদ্ধ ক্ষেত্রে মরছে, ব্যাবসা মন্দা, হাত বদল হয়ে চলে চলে যাচ্ছে ভীন দেশী , ঔপনিবেশিক আরবী এবং তুর্কিদের হাতে। সমাজের নিম্ন বর্গের মানুষের মাথার ওপরে ছায়া দেবার ছাতা চলে গেলে তারা কোথায় যাবে??????? দলে দলে প্রান ভিক্ষা করে নাম লেখালো সেই বর্বর বিদেশীদের দলে। তাদের ভুল বোঝানো , ভুল শেখানো হলো, “আমরা সবাইকে ভাই বলে মানি, সবাই সমান” এসো আমাদের কাছে । সেই সংগে ভয় দেখানোও চললো,–“নইলে দেখেছো তো আমাদের কথা যারা শোনেনি তাদের পরিনতি” ?—– মরতে হবে।
হিন্দু সমাজের আমুল পরিবর্তন হতে শুরু করলো। সমাজ আর সমাজ রইলো না। প্রবাহমান নদীর স্বাভাবিক গতি বন্ধ হয়ে নদীর জল চলে গেলো এদিকে ওদিকে। গুরুকুল, আশ্রম হারিয়ে শিক্ষাবিদ ব্রাহ্মনেরা হলো ভিকিরি। শুরু করলো মানুষ ঠকানোর ভ্রান্ত কৌশল, নামীর শুরু হলো বদনাম যা আজো সমানে চলছে। ক্ষত্রিয় তার ক্ষাত্র শক্তি ভুলে হয়ে গেলো বিদেশীদের পদ লেহন কারী। বৈশ্যরা যেন তেন প্রকারেন দুর্নীতি পরায়ন হয়ে চালালো ব্যাবসা যা এক প্রকারের মানুষ ঠকানোর এক অভনব পদ্ধতি। এই তিন শ্রেনীর দুর্দশা দেখে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেনী ও চুপসে গেলো।
সেই শুরু হলো, ভারতে বিদেশী শাসন। নিজের ভুমে পরবাসী হিন্দুদের দাসত্বের কাহিনী। সেই দাসত্ব আজো চলছে, আরো বেশী করে জাকিয়ে বসার তৈরী চলছে সেই হাজার বছরের বৈদেশিক শক্তির। বাধা দেবার মতো হিন্দু শক্তি আজো ভয়ে জড়ো সড়ো হয়ে মুখ লুকিয়ে আছে মা বোনের শাড়ীর আঁচলের নীচে।
আজ প্রায় হাজার বছর ধরে ভারতীয় হিন্দুরা সেই সব কাহিনী বেমালুম ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু — ভুলে গেলে চলবে না। নিজের সমাজ, নিজের শিক্ষা, নিজের কৃষ্টি,নিজের ধর্ম ভুলে গেলে মানুষ আর মানুষ থাকে না। মনো বিদ্যায় একে বলে “ Uprooting Syndrom”. একটি গাছকে এক জায়গা থেকে তুলে আর এক জায়গায় বসিয়ে দিলে সেই গাছ বহুদিন নেতিয়ে থাকে, তা সে যতোই সার বা জল দিন। ধাক্কা দিয়ে, আঘাত করে ছিড়ে দিলে সে বেশ কিছুদিন মন মরা হয়ে নেতিয়ে থাকে। কিন্তু সময়ে আবার উঠে দাঁড়ায়, বেঁচে যায়, বড়ো হয়, ফল ফুল দেয় । এটাই প্রকৃতির ধর্ম। বর্তমান হিন্দুকে সেই প্রাকৃতিক ধর্ম থেকে সরে এলে চলবে না। তাকে জানতে হবে, কেনো তাদের আজ এই অবস্থা। কেনো এবং কি ভাবে তাদের পুর্ব পুরুষদের মহান জীবন আজ এক পচাগলা জীবনে পরিনত হয়েছে। এর জন্য কে বা কারা দ্বায়ী???? আমাদের পুর্ব পুরুষের অক্ষমতা না শয়তানের শয়তানী দক্ষতা। শকুনি রা, এই সৃষ্টিতে নতুন কিছু নয়। এরা যুগে যুগে আসে । আবার এটাও ঠিক যুগে যুগে শ্রীকৃষ্ণের বেশে ঈশ্বর ও আসেন।
হাজার বছরের (তার আগে আমি যাচ্ছি না) আগেকার প্রগতিশীল সনাতনি হিন্দুরা হাজার বছর ধরে (৭১২ সাল থেকে) সমস্ত ভাবে অত্যাচারিত। হিন্দু সমাজ এক পাশবিক শক্তি দ্বারা ধর্ষিত হয়ে চলেছে সেই ৭১২ সাল থেকে এক অপশক্তি, অপসংষ্কৃতি, এক বিদেশী ঔপনিবেশিক শক্তির দ্বারা। ভারত মাতার চোখের জলে ভারত সাগরের জল আজ মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। হিন্দু সমাজ অবক্ষয়ের শেষ প্রান্তে এসে দাড়িয়েছে??? একে কে বাচাবে????? কোনো বিদেশী শক্তি?????? না , তারা এই ঘোলা জলে মাছ ধরবে। মিষ্টি কথা বলবে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুতেই হবে না। একমাত্র হিন্দু কেই হিন্দুর পাশে দাড়াতে হবে। এক হয়ে ,এক সুরে বলতে হবে , “এই দেশ, এই সমাজ, এই ধর্ম আমাদের ,হিন্দুদের। আজ আমরা জানছি কে,কারা,কি ভাবে আমাদের সর্বনাশ করেছে। না,আর নয়। আমরা ফিরে পেতে চাই আমাদের শিক্ষা দীক্ষা, সনাতনি সমাজ এবং সনাতনি জীবন দর্শন”। এগিয়ে আসতে হবে হিন্দু যুবক যুবতীদের—- এই সমাজ এই দেশ, এই সমাজ তাদের ভবিষ্যত, তাদের সন্তান সন্ততিদের ভবিষ্যত। একে রক্ষা করা এবং লালন পালন করা বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষিত ‘যুব শক্তি’র ।
আমাদের জানা উচিত, আমাদের পুর্ব পুরুষ রা এর প্রতিরোধ করতে গিয়ে তাদের নিজেদের জীবন দিয়েছেন, কি ভাবে আমাদের মাতা, ভগ্নী রা আগুনে আত্মাহুতি দিয়েছেন, হাজারে হাজারে বিষ পান করে (জহর ব্রত) ,শুধু মাত্র নিজেদের নারী সম্মান রক্ষা করতে জীবন দিয়ে বলে গেছেন তাদের করুন কাহিনী।
মাত্র একটি বিদেশী শব্দ এবং সেই একটি মাত্র শব্দের প্রভাবে আজ ভারতীয় হিন্দু সমাজ প্রায় নিশ্চিন্ন। সেই শব্দটি হচ্ছে “জেহাদ”।
ডাঃ মৃনাল কান্তি দেবনাথ