ভারত গরিব দেশ। উন্নয়নশীল দেশ। অনেকে বলে থাকেন India is rich country consisting of poors. কথাটা আরও স্পষ্ট করে বলতে হলে বলা যায় India is rich country shouldering by poors। বাস্তবটি হলাে এই যে গরিবের কাধে ভর করে ধনীরা নাচছেন। এটা আসলে মনকে চোখ ঠারা।
ভারত রশম্ বা রেওয়াজের মান বাঁচাতে কেরানিরূপী গরিবের থেকে রাজস্ব নিয়ে স্বচ্ছল, সঙ্গতিপন্নদের সন্ত্রান্তপনার মান বাঁচাচ্ছে। কর্ম করে যারা অবসর নিচ্ছে তাদের পেনশন বা ভাতার নামে আমরণ অর্থ দিয়ে যাচ্ছে। যদিও ভারতে সাংবিধানিক নিয়ম আছে No Work no Pay।
ভারত প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্র। প্ৰজাই প্রজাকে শাসন করছে, প্রজার উপর কর চাপাচ্ছে, কর না দিলে দণ্ডেরও ব্যবস্থা রয়েছে। অর্থাৎ রাজা ও প্রজা, শাসক ও শাসিতের সম্পর্কের দূরত্ব মুছে যাচ্ছে না। আচার আচরণ, সম্ভাষণেও তার ছবি ফুটে ওঠে—হুজুর, মহাশয়, সাহেব ইত্যাদি। সাহেবকে আসন পেতে বা চেয়ার টেনে দেওয়া হয়। সমাদরে জল খাবারেরও ব্যবস্থা করা হয়। নির্দেশনামায় সেই আজ্ঞাবাহকের মতাে ভাষা–ওরে এই, এ দিকে আয়। এটা করিস ওটা করিস। অনেক সময় গরিবের আবেদনও নেওয়া হয় না, তাচ্ছিল্যভরে ফেলে দেওয়া হয়। ইত্যাদি নানা রকম পদের অধিকার ব্যবহার করা হয়।
কর্ম করা, রােজগার করা, খাওয়া দাওয়া করা আর বেঁচে থাকা এটা মানুষের প্রকৃত জন্মগত অধিকার। খাটবে, পারিশ্রমিক নেবে, কেনাকাটি করবে। পারিশ্রমিকও মালিকের হাতে, দয়ার দানের মতাে। ধর্মশাস্ত্রে বলেছে—“কর্মণ্যে বাধিকারাস্তে মা ফলেষু কদাচন। আরও বলা হয়েছে যে, কর্ম তুমি ত্যাগ করতে অর্থাৎ ছাড়তে পারাে না। কর্মীর কর্ম করাই অধিকার—পারিশ্রমিকের অধিকার নেই। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার অধিকার কর্মীর নেই। মালিকের ইচ্ছায় ফল দেরিতে দেওয়া মানে কর্মীর অনাহারে থাকা। না খেয়ে মরে গেলেও ক্ষতি নেই। কর্ম করা, পারিশ্রমিক নেওয়া, খেয়েদেয়ে জীবনে বেঁচে থাকা কি ধর্মের মধ্যে পড়ে না? যদি এগুলি ধৰ্ম হয় তা হলে এমন পক্ষপাতের বাণী কেন? যদি বলা হয় অধ্যাত্ম বিচারের কথা—তাহলে এ ব্যাখ্যা শাশ্বত নয়। খালি পেটে হরিনাম কেউই গাইতে পারবে না।
অন্যভাবে দেখলে দেখা যায়, পারিশ্রমিক মালিকেরাই নির্ধারণ করেন। এটি জানালা থেকে সমুদ্র দেখে সমুদ্র মাপার ঘটনার মতাে। যাই হােক, কর্ম করলে মজদুরির কিছু একটা অঙ্ক দেওয়া হয়ে থাকে। তবে মজদুরি বা বেতনের তত্ত্ব বিভিন্ন রকমের। এখানে স্থায়ী কর্মচারী আছে, অস্থায়ী কর্মচারী আছে, ঠিকা শ্রমিক আছে, দিনমজুর আছে, চাকর-বাকরও আছে। স্থায়ী কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয় অর্থ কমিশন বসিয়ে বেতন ঠিক করে। তারা স্থায়ী কর্মচারীদের অবসরকাল ঠিক করে দেন এবং মাসিক পেনশনও ঠিক করে দেন। অস্থায়ী ও ঠিকা শ্রমিকদের GDP-র উপর ভিত্তি করে বেতন ঠিক করা হয়। Minimum Wages Rules আছে। তবে পেনশনের কোনও প্রশ্ন নেই। তবে আজকাল Provident Fund-এর আওতায় এনে কিছু মালিক পেনশন যা যৎকিঞ্চিৎ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দিনমজুর বা শ্রমিক ও চাকর বাকরদের কোন নিশ্চিত মজুরি নেই। তাদের পেনশনের কথা তাে ভাবাই হয় না। অন্তত Minimum Wage Rules-এর মধ্যে এনে তাদেরকেও Provident Fund-এর আওতায় এনে পেনশন ভুক্ত করা যেতে পারে। তবে সর্বত্রই একই নিয়ম No Work No Pay। Pension দেবার ক্ষেত্রে চাকুরির বয়স ও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রে তা প্রযােজ্য নয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে জনসেবায় যারা পদাধিকারি রয়েছেন তারা কোনও রকমে মন্ত্রকে কম করে তিন বছর থাকলেই পেনশন পাওয়ার উপযােগী। রাজনীতিকদের ক্ষেত্রে বয়সের কোনও সীমারেখা নেই।
Pension যারা পাচ্ছেন তাঁরা Commissioned Salary পান এবং তা GDP হিসেবের কয়েকগুণ বেশি। চাকুরির বয়সসীমা ৬০ বছর বা ৩৫ বছর হলে তবেই অবসর পান। অর্থাৎ ৬০ x ১২ = ৭২০ মাসের মাইনে হাতে পায়। এই বেতন তাদের সংসার গড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। তা ছাড়া কর্মজীবনে ঋণ ইত্যাদি মিলিয়ে অনেক সুবিধা পান। কাজেই তাদের পেনশনের নামে বেতনের ৫০ শতাংশ যুক্ত DA দেবার কোনও অর্থই হয় না। সেই পেনশনের টাকা দিয়ে বেকার যুবক যুবতীদের কাজে নিয়ােগ করলে দেশের অনেক সমস্যা সমাধান হতে পারে। তা ছাড়াও পিতা-মাতা ও সন্তান সন্ততিদের মধ্যে একটা Generation Gape থাকে। বাবা পঞ্চাশ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করতে থাকলে ছেলের বয়স হয় পঁচিশ বছর। অর্থাৎ একুশ-বাইশ বছরে স্নাতক, তেইশ বছরে এম.এ. পাশ ও দু’বছর অন্য কোনও প্রযুক্তি শিক্ষা নিয়ে পাঁচিশ বছর বয়সে যে কোন চাকুরি কাজের জন্য সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ওঠে। এবার বাবাকে পঞ্চাশ বছর বয়সে কিছু Gold handsum দিয়ে অবসরে পাঠালে বাবাও সংসারে ফিরে এসে সে টাকা দিয়ে ছােট ছােট Project তৈরি করে তুলতে পারে। কারণ এই বয়সে সে কর্মক্ষম থাকে এবং টাকাকে নয়ছয় না করে যে কোনাে ভাবে বিনিয়ােগ করে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের ব্যবস্থা অবশ্য করে থাকবে। চাকুরিজীবনে মেনে চলা বিধিবিধান স্মরণ থাকার জন্য অপরাধমূলক কাজের থেকে বিরতই থাকবে। সেও তার কাজের মধ্যে অনেক দিন মজুরদের পেটের ভাতের ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু এমন হয় না। কারণ জনতার সার্বিক পরিস্থিতি বা অবস্থান বিচার করে হিতকর বা মঙ্গলজনক ব্যবস্থা কেউ করতে চায় না। তাই সেই উপনিবেশিক ধারায় বয়ে যায়। তাই আজ কাজ না করলেও পেনশনের নামে অর্থ দিয়ে রাজসেবক বা রাজকর্মী হিসেবে তুলে ধরে রাখে।
অন্যদিকে ভারতের সােনা। আজও ভারত ‘সােনেকি চিড়িয়া’। ভারতবর্ষে এত লুটপাট হওয়া সত্ত্বেও ভারতে সােনার অভাব নেই। নেই নেই করে এখনও লক্ষ টনেরও বেশি সােনা আছে। সম্প্রতি একটি পত্রিকায় ভারতীয় স্থাপত্যের ‘বিস্ময়ের আড়ালে সােনার ভান্ডার’ শিরােনামে একজন বেশ কিছু মুখ্য সােনার ভাণ্ডারের কথা লিখেছেন। প্রথম কেরলের পদ্মনাভস্বামী মন্দির। ছয়টি খিলানের মধ্যে স্বর্ণ রত্ন মানিক ভরা আছে। ২০১১ সালে জুন মাসে একটি খিলান খুলে দেখা যায় তার মধ্যের অলঙ্কারের মূল্য ছিল বাইশ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ১৪, ১৬,৬৯০০,০০,০০০ টাকা। দ্বিতীয় মােক্কাম্বিকা মন্দির কর্ণাটক। এখানে স্বর্ণভাণ্ডার আছে যার মূল্য ১০০ কোটি টাকার বেশি, এই মন্দিরের বার্ষিক আয় সতেরাে কোটি টাকা। তৃতীয় বালাকিলা, আলওয়ার রাজস্থান। জাহাঙ্গির নির্বাসিত হবার সময় তার ধনভাণ্ডার বালাকিলার জঙ্গলে লুকিয়ে রাখেন। খোঁজার জন্য অনুসন্ধান চলছে।
চতুর্থত জয়গড় দুর্গ। জয়পুরে কথিত আছে যে মানসিংহ ১৫৮০ সালে আফগান জয় করে ফেরার সময় সমস্ত ধনসম্পদ জয়গড় দুর্গের আঙিনায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। খোঁজার জন্য অনুসন্ধান চলছে। পঞ্চমত অন্ধপ্রদেশের বেঙ্কটেশ্বর ভগবানের তিরুপতিমালা মন্দির। এটি ভারতের সবথেকে ধনী মন্দির। মন্দিরটি পুরাে প্রায় সােনার পাত দিয়ে মােড়া। ২০১৬-র হিসেবে এই মন্দিরের রােজগার প্রতি দিন ১,০০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। এখানে টন টন সােনা আছে।
আধাসামরিক বিভাগে কাজ করতে করতে এগুলির মধ্যে অনেকগুলি নিজের চোখে দেখেছি। এর সঙ্গে আমার নিজের দেখা আরও স্থানগুলির কথা বলছি। পাদুচেরিতে অম্বা মন্দিরের গম্বুজটি সােনা দিয়ে আবৃত। মাদ্রাজ থেকে ১০/১২ কিলােমিটার দুরে ভেলােরির শ্রীপুরের লক্ষ্মী মন্দির। মন্দিরটি প্রায় তিনশতক জায়গা জুড়ে। নয় থেকে দশ ফুট উঁচু এবং এই মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে সােনার পাত দিয়ে মােড়ানাে। পঞ্জাবে গুরুদ্বারা, দিল্লির শিসমহলের উপরটি সােনা দিয়ে মােড়ানাে। মহাক্ষেত্র পুরীর মন্দিরে প্রচুর সােনা তিনটি খিলানের মধ্যে ভরা আছে। ইদানীং একটি খিলান খােলার চেষ্টা করেও পারেনি। সােমনাথ মন্দিরেও নেই নেই করে এখনও পাঁচ ছয় টন সােনা আছে। কথিত আছে। বিক্রমাদিত্যের তুলারাশি পুষ্কর লগ্নে স্থাপিত গৃহে মা মহালক্ষ্মী রাজার উপর সন্তুষ্ট হয়ে রাজ্যে স্বর্ণবণ্টন করিয়েছিলেন। সেই সােনা আজমিরের ফয়সাগড়ে রাখা হয়েছিল। ফয়সাগরে তৈরি ছাতার মধ্যে ওই গড় খােলার চাবিকাঠির হিসাব আছে। খোঁজার জন্য অনুসন্ধান চলছে। জয়পুরের রাজবাড়ি থেকে পাওয়া কয়েক টন সােনার বিস্কুট দিল্লিতে এনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাই সােনার নিলাম করেছিলেন। ইদানীং সত্য সাই বাবার আশ্রমেও প্রচুর সােনা পাওয়া গিয়েছে। এইসব হিসাব করলে বােঝা যায় ভারতে সােনার অভাব নেই। লক্ষ লক্ষ টন সােনা এখনও আছে। তবুও ভারত এক গরিব দেশ।
ভারত গরিব দেশ। কারণ ওই সােনা ভারত সরকারের অধীনে নেই। এই সােনা উদ্ধার করে ভারত সরকারের অধীনে রাখলে ভারত এই বিশ্বে প্রথম সমৃদ্ধিশালী দেশ হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। মাত্র ৫৫০ টনের মতাে সােনা ভারত সরকারের রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত আছে মাত্র।
ভারতে এত সােনা, তবুও বিশ্ববাজারে ক্রয়-বিক্রয়ে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ডের ডলার, পাউন্ড, ইত্যাদিকে ৬০, ৬৫, ৬৮, ৭০ টাকায় কিনতে হয়। দুর্ভাগ্য। অবশ্য এটি আন্তর্জাতিক শােষণ পদ্ধতিও বলা চলে। বিশ্ববাজারে ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যম যখন সােনা তখন সবদেশের সােনার মূল্য একই হওয়া উচিত। ভারতের টাকাও তাে রিজার্ভ ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সােনা চাঁদির মুল্যায়নের উপর মূল্যায়িত এবং টাকার মধ্যে অঙ্গীকারও করা থাকে I promise to pay the bearer the sum of one hundread Rupees. সুতরাং অসুবিধা কোথায়? ডলার, পাউন্ড, টাকা এগুলি তাে হুন্ডির মতাে। সােনাকে ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাবার জন্যই এইসব token value সবদেশেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ কী জন্যে গড়ে তােলা হয়েছে। শােষণকে প্রশ্রয় দেবার জন্য কি? দেশের মানুষ বিচার করুন।
অষ্টম কুমার মাঝি