গরিব মানুষের জীবনে খিদে কখনও কখনও শত্রু হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যেসব সহায়সম্বলহীন মানুষ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন তাঁদের ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশি করে সত্যি। চিকিৎসার খরচ তাে আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে রােগীর খাওয়া-দাওয়ার খরচ। দূরদূরান্ত থেকে আসা রােগীর বাড়ির লােকেদেরও দিনের পর দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। তাদেরও খাওয়া দাওয়ার একটা খরচ আছে। সব মিলিয়ে বেশ করুণ অবস্থা। এই পরিপ্রেক্ষিতে পি. ইউ. টমাসের নামটা স্মরণযােগ্য। কারণ আজ থেকে কয়েক দশক আগে তিনি এই মানুষগুলােকে মর্যাদাসম্পন্ন জীবন উপহার দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। এবং এখনও তাঁর জীবনযাপন এই মানুষগুলােকে নিয়ে।
সত্তর ছুঁই ছুঁই মানুষটির দিন কাটে চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে। বস্তুত এক কাপ চা খাওয়ারও সময় থাকে না। তাঁর দিন শুরু হয় নিজের প্রতিষ্ঠিত নবজীবন ট্রাস্টের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়ের মাধ্যমে। এই আলাপচারিতার পর প্রায় দ্বিশতাধিক মানুষ আসেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। শীত গ্রীষ্ম বারােমাস এই নিয়মের নড়চড় হয় না। টমাস তাঁদের সঙ্গে ইতিবাচক কথাবার্তা বলেন। অনুপ্রেরণা দেন, সাহস জোগান। এরপর শুরু হয় আসল কাজ। তিনটি ভিন্ন ভিন্ন হাসপাতালের রােগী এবং তাঁদের বাড়ির লােকের জন্য রােজ তৈরি করতে হয় বাড়িতে তৈরি খাবারের পাঁচ হাজার প্যাকেট। এরপর শুরু হয় চা তৈরি এবং রাতের খাবার তৈরির কাজ। বলা বাহুল্য, এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞে হাত লাগান টমাসও।
কবে থেকে শুরু হলাে টমাসের এই সেবাকাজ? কেনই বা হলাে? পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা। একবার টমাসের পেপটিক আলসার ধরা পড়ল। সেবার ২২ দিন টমাসকে কোট্টায়মের সরকারি হাসপাতালে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। হাতে টাকাপয়সা না থাকায় কষ্ট আরও বেড়েছিল। হাসপাতালে থাকার সময়েই তিনি লক্ষ্য করেন অধিকাংশ রােগীই একবেলার খাবার জোটাতে পারেন না। এই কঠিন বাস্তবের মুখােমুখি হয়ে ১৯ বছরের টমাস রীতিমতাে মুষড়ে পড়েছিলেন।
কুড়ি বছর বয়েসে টমাস কোট্টায়াম মেডিকেল কলেজের বয়েজ হস্টেলে একটা চাকরি পান। তখনকার দিনে বেতন ছিল একশাে একান্ন টাকা। জীবনের প্রথম বেতন পাবার পর থেকেই তিনি মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসাধীন গরিব দুঃস্থ রােগীদের ওষুধ কেনার জন্য প্রত্যেক মাসে পাঁচ টাকা করে খরচ করতেন। এছাড়া তিনি প্রতিদিন দুটি খাবারের প্যাকেট কিনতেন। একটি তার নিজের জন্য, অন্যটি কোনও গরিব রােগীর জন্য।
কিছুদিন পর এক আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটল। টমাসের সেবাকাজ দেখে বয়েজ হস্টেলে বসবাসকারী মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা এগিয়ে এলেন। তাঁরা যে শুধু টমাসকে অর্থসাহায্য করা শুরু করলেন, তাই নয়, আশেপাশের হােটেল থেকে খাবার সংগ্রহ করেও সাহায্য করলেন। এর কয়েক বছর পর টমাসের পদোন্নতি ঘটল। তিনি মেডিক্যাল কলেজের অ্যাটেন্ড্যান্ট নিযুক্ত হলেন। যার ফলে তাঁর সঙ্গে ডাক্তার এবং রােগীদের যােগাযােগ আরও বেড়ে গেল। তাঁর সেবার কথা যতই লােকমুখে ছড়িয়ে পড়ছিল, কোট্টায়াম এবং তার আশেপাশের বহু মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। নবজীবন ট্রাস্টের ভিতও রচনা হচ্ছিল একটু একটু করে।
ট্রাস্টের অন্যতম প্রধান কাজ গৃহহীন এবং মানসিক প্রতিবন্ধী রােগীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের নবজীবন ভবনে নিয়ে আসেন এবং পরের দিনই তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করে দেওয়া হয়। বেশিরভাগ রােগীই কিছুদিন পর সুস্থ হয়ে ওঠেন। তখন তাঁদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তবে, যদি কোনও কারণে বাড়ির লােক তাঁদের ফিরিয়ে নিতে অস্বীকার করে তখন তাঁরা হয়ে ওঠেন নবজীবনের স্বেচ্ছাসেবক। টমাস বলেন, পরিত্যক্ত মানসিক রােগীদের আত্মীয়স্বজনকে আমরা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি। যদি খুঁজে বের করা যায় এবং যদি তাঁরা রােগীকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হন তাহলে তার থেকে বেশি খুশির কিছু হয় না।
এখন নবজীবনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় দ্বিশতাধিক মানুষ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ২৫ জন সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। ভিন্ন ভিন্ন মাতৃভাষার মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে অসুবিধে হয় কিনা জানতে চাইলে টমাস বলেন, “আমার কোনও অসুবিধে হয় না। কারণ ভালােবাসার থেকে হৃদয়স্পর্শী ভাষা আর কিছু নেই। এই ভাষায় কথা বলতে পারলে সকলেই তা বুঝতে পারে।”
নিজস্ব প্রতিনিধি