(পূর্ব অংশের পর)

।।১১।।


১৭১৩ সাল, দিল্লির সলতানতে তখন ফারুক শিয়ার, এদিকে গুরুদাসপুর নোঙ্গলের বাতাসে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠল। নানা স্থান থেকে স্বাধীনতা যোদ্ধাগন আসতে লাগলেন গুরুদাসপুর নোঙ্গলে যুদ্ধে আহুতি দেবার নিমিত্ত।মুঘল সেনা বাহিনী গুরুদাস পুরকে নজরবন্দি করেছিল কিন্তু আনন্দলোনের অগ্নিকে নষ্ট করতে পারে নি। ছত্রপতি শিবাজীর মত বান্দা বাহাদুর গেরিলা যুদ্ধকে নিজের শিরায় ধারণ করেছিলেন।

খুব কম সংখ্যক সেনা নিয়ে বান্দা বাহাদুর বাইরে আসতেন। মুঘল সেনাদের অকস্মাৎ আক্রমন করতেন। মুঘল সেনারা কিছু বোঝার পূর্বেই আক্রমন সম্পূর্ণ করে বান্দা ও তাঁর সেনাবাহিনী অদৃশ্য হয়ে যেতেন। অনেকবার এরম কথা রটনা হল , যে বান্দা বাহাদুর কে এক সঙ্গে অনেক স্থানে দেখা গেছে…বান্দার জনপ্রিয়তা, যুদ্ধনীতি, লৌকিক থেকে অলৌকিক হয়ে ওঠা, এই সব কিছু মুঘল সেনাদের হোশ উড়িয়ে দিয়েছিল।

দিল্লির সালতানাত বান্দার এই প্রচন্ড পরাক্রম নিতে পারেনি। অনেক পূর্বেই বান্দার মাথার দাম নির্ণয় হয়েছিল। ফারুক শিয়ার পুনশ্চঃ ঘোষণা করল কোনো না কোনো ভাবে বান্দাকে জীবিত অথবা মৃত দিল্লির দরবারে উপস্থিত করতেই হবে..

দিল্লিপ্রাসাদকূটে
হোথা বারবার বাদশাজাদার
তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।
কাদের কণ্ঠে গগন মন্থে,
নিবিড় নিশীথ টুটে —
কাদের মশালে আকাশের ভালে
আগুন উঠেছে ফুটে!

বান্দা সিং তো মাথা নোয়াবেন না। আট মাস অবধি তিনি তাঁর কেল্লা বন্ধ করে রাখলেন। আট মাস কেল্লায় একটা খাদ্যের দানা পর্যন্ত ঢুকল না। খাদ্য শেষ হল, পাহাড়ি অঞ্চলে পানীয় জলও কেল্লায় নেওয়া সম্ভব হল না। দুর্গের মধ্যে মানুষ অভুক্ত রইল…তবু মাথা নোয়াল না। কিন্তু হায়, শয়তান বোধয় অন্য দিকে মুচকি হাসছিল…কেল্লা মধ্যে মানুষ দুর্ভিক্ষে , রোগে মারা পড়তে লাগল।

নভেম্বর ১৭১৫ পর্যন্ত লুক্কায়িত হয়ে সৈনিকদের ক্ষুধার্ত মৃত্যুকে তিনি সহ্য করলেন। গুরুদাস নোঙ্গলে মুঘলদের অবরোধ আরো শক্ত হচ্ছিল। কিন্তু যিনি এই সৈন্যদের সন্তানের মত করে তৈরি করেছিলেন , তিনি কি করে তাদের মৃত্যু দেখবেন… এর থেকে যুদ্ধ করে গর্বিত মৃত্যু অনেক ভালো। বন্দা সিং বাহাদুর ১৭ই ডিসেম্বর কেল্লার দ্বার উন্মুক্ত করলেন। শিখ বীর গন অভুক্ত থেকেও ঝন ঝন শব্দে তরবারি নিয়ে, গম গম শব্দে বলে উঠল…” বাহে গুরু কি ফতে, বাহে গুরু কি খালসা… জো বলে সো নিহাল….”


পঞ্চনদীর তীরে

ভক্তদেহের রক্তলহরী
মুক্ত হইল কি রে!
লক্ষ বক্ষ চিরে
ঝাঁকে ঝাঁকে প্রাণ পক্ষীসমান
ছুটে যেন নিজনীড়ে।
বীরগণ জননীরে
রক্ততিলক ললাটে পরালো
পঞ্চনদীর তীরে।

।।১২।।

অন্তিম রণক্ষেত্রে শেষ মহারন সূচিত হল… জয় গুরুজী, গর্জন আকাশ বাতাসকে কম্পিত করল…হৈ হৈ শব্দে রনভূমি হল মুখরিত..

মোগল – শিখর রণে
মরণ – আলিঙ্গনে

কণ্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি
দুইজনা দুইজনে।
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ
যুঝে ভুজঙ্গ – সনে।
সেদিন কঠিন রণে
‘ জয় গুরুজির’ হাঁকে শিখ বীর
সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মোগল রক্তপাগল
‘ দীন্‌ দীন্‌’ গরজনে।

শত শত শিখ যোদ্ধা ঝাঁপিয়ে পড়লেন যুদ্ধের মধ্যে…তারা মৃত্যুঞ্জয়ী। তারা মৃত্যুকে ভয় পায়না।নিজের ভূমি রক্ষাই এক মাত্র ধর্ম , কর্ম .. এই কর্মের নিমিত্তে যিনি প্রাণ দেবেন তিনি হবেন মহান…তাই..

পড়ি গেল কাড়াকাড়ি,
আগে কেবা প্রাণ করিবেক দান
তারি লাগি তাড়াতাড়ি।

প্রবল লড়েও বিশাল মুঘল বাহিনীর নিকট বান্দার সমর বাহিনী রঙ কৌশলে হেরে গেলেন।বহু শিখ বীর দেহ রাখলেন যুদ্ধে। বান্দার গলায় ,হাতে পায়ে লৌহ শৃঙ্খল পড়িয়ে যুদ্ধ বন্দী করা হল…

গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দা যখন বন্দী হইল
তুরানি সেনার করে,
সিংহের মতো শৃঙ্খল গত
বাঁধি লয়ে গেল ধরে
দিল্লিনগর – ’পরে।
বন্দা সমরে বন্দী হইল
গুরুদাসপুর গড়ে।

বিধির অদ্ভুত পরিহাস…একে একে তিনশো শিখ বীর বন্দী হলেন। তাদের প্রত্যেকে জোড় করা হল বেণী কেটে ধর্ম ত্যাগের নিমিত্ত। কিন্তু সিংহ হৃদয় শিখরা ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করলেন সেই সব প্রস্তাব , বদলে দিলেন পুরো বেনীর সঙ্গে মাথা। নিষ্ঠুর ,ক্রুর সাম্রাজ্যবাদী মুঘল সৈন্য সেই তিনশো মুন্ড নিয়ে প্রেত নৃত্য করতে করতে পথের রাঙা ধুলো উড়িয়ে চলল দিল্লির …. বান্দার প্রজাগন সেই দৃশ্য দেখে থাকতে পারলেন না। তাঁরা যে যেখানে ছিলেন চিৎকার করে উঠলেন গুরুজীর জয় … আকাশ বাতাস গুরুর নামে ধ্বনিত হয়ে উঠল…

সম্মুখে চলে মোগল – সৈন্য
উড়ায়ে পথের ধূলি,
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া
বর্শাফলকে তুলি।
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে,
বাজে শৃঙ্খলগুলি।
রাজপথ – ’পরে লোক নাহি ধরে,
বাতায়ন যায় খুলি।
শিখ গরজয়, ‘গুরুজির জয়’
পরানের ভয় ভুলি।
মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে
দিল্লিপথের ধূলি।

বাকি , প্রায় সাতশো বীর শিখ যোদ্ধা সহ বান্দা বাহাদুর লৌহ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে চললেন দিল্লির পথে। ২৯ শে ফেব্রুয়ারি ১৭১৬ বন্দী বীর ও তাঁর যোদ্ধা গন দিল্লি পৌঁছলেন। গুরুদাসপুর থেকে দিল্লি এই দীর্ঘ পথে বন্দী বীরদের উপর মুঘলদের সেনারা যথেচ্ছ অত্যাচার করেছিল। প্রায় দিনই রাস্তায় খোলাখুলি ভাবে কোনো না কোনো যোদ্ধাকে শিরচ্ছেদ করে হত্যা করা হত…

দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে
বন্দীরা সারি সারি
‘জয় গুরুজির’ কহি শত বীর
শত শির দেয় ডারি

দুর্গেশনন্দিনী

(ক্রমশ)

(পরবর্তি অংশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.